আমিই ফোন করছি, শিবতোষ উঠে গিয়ে ফোন করতে লাগলেন।
ফোন করে আবার ফিরে এসে বললেন, তোমার মার কাছে গিয়ে বসে থাক।
স্মৃতি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমি একবার তিনতলাটা ঘুরে আসি শিবতোষবাবু।
যান।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল!
নির্বাণীতোষের ঘরের সামনে যে পুলিসটি প্রহরায় নিযুক্ত ছিল, সে চিনত কিরীটীকে, ওকে দেখে বললে, সাব—আপ!
ব্রিজনন্দন, তোমারা ডিউটি হ্যায় হিঁয়া?
জী সাব–আপ অন্দর যায়েঙ্গে?
হ্যাঁ।
যাইয়ে সাব।
কিরীটী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। দুটি নরনারীর জীবনে প্রথম মিলন-উৎসব রাত্রি, আয়োজনের কোন ক্রটিই রাখেননি শিবতোষ। দুটি হৃদয়ও উন্মুখ হয়ে ছিল পরস্পর পরস্পরকে গ্রহণ করবার জন্য, কিন্তু অকস্মাৎ মৃত্যু এসে সে মিলনেছেদটেনে দিয়েছে। পরস্পর পরস্পরের দীর্ঘদিনের পরিচিত, তবে তাদের জীবনের আকাঙিক্ষত রাতটি এমন করে ব্যর্থ হয়ে গেল কেন?
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা, তারা কি একবারও টের পায় নি তাদের পেছনে পেছনে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলে এগিয়ে আসছে।
ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করল কিরীটী। শুধু শয্যাই নয়, সমস্ত ঘরটাই ফুলে ফুলে সাজানো। এখনও ফুল ও ফুলের মালাগুলো বাসি হয়নি, শুকিয়ে যায়নি। এখনও রজনীগন্ধার গন্ধ ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে আছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে মহার্ঘ্য একটি পালঙ্ক, তার ওপরে দামী শয্যা বিস্তৃত। অন্যদিকে একটি তিন আয়মাওয়ালা ড্রেসিং-টেবিল, নানা প্রসাধন দ্রব্য তার ওপর সাজানো। একপাশে একটি সোফা-কাম-বেড। দুদিককার দেওয়ালে সুদৃশ্য ব্র্যাকেট আলো বসান, টিউব আলো। উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। ঘরের দেওয়াল হালকা ক্রিম কালারের প্লাস্টিক ইমালশন করা, দেওয়ালেগোটা দুইল্যান্ডস্কেপ! আর বাঁ দিককার দেওয়ালে একটি যুগল ফটো। দুটি হাসিভরা মুখ পাশাপাশি।
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা।
খোলা জানলাপথে রাত্রিশেষের হাওয়া ঝিরঝির করে এসে ঢুকছে। বাথরুমের দিকে তাকাল কিরীটী-দরজাটাখোলা, ভেতরে আলো জ্বলছেতখনও। আলোটানেভানো হয়নি। নেভানোর কথা হয়তো কারও মনেও হয়নি।
বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল কিরীটী। ভিতরে পা দিতেই নজরে পড়ল নির্বাণীতোষের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটা। পাঞ্জাবীর উপর থেকেই একটা ক্ষতস্থান নজরে পড়ে।
কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিরীটী ভূলুণ্ঠিত নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে।
বেসিনের ঠিক সামনেই দেহটা একেবারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বেসিনের ট্যাপটার মুখটা খোলা ছিল, বীরেন মুখার্জী বন্ধ করে দেন, কাঁচের গ্লাসটা বেসিনের ওপরেই রয়েছে। একবার বেসিন ও একবার ভূলুণ্ঠিত দেহটার দিকে তাকাল কিরীটী। গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে, পরীক্ষা করতে গিয়ে নজরে পড়ল গ্লাসটার গায়ে চিড় খেয়ে ফেটে গেছে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আবার সামনে তাকাল কিরীটী।
বেসিনের ওপরে একটা আয়না বসানো। কিন্তু বেসিনটা ঘরের দেওয়ালে এমনভাবে বসানো যে শয়নঘর থেকে কেউ বাথরুমে প্রবেশ করলেও বেসিনের সামনে আয়নায় কোন প্রতিচ্ছবি পড়বে না, মেথরদের যাতায়াতের দরজাটার দিকে তাকাল একবার কিরীটী, দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজাপথে কেউ এলেও আয়নায় প্রতিচ্ছবি পড়বে না।
মৃতদেহের অবস্থান দেখে মনে হয়, এই বাথরুমের মধ্যে কেউ নির্বাণীতোষকে পশ্চাৎদিক থেকে ছোরার সাহায্যে চরম আঘাত হেনেছে।
বাথরুমের মেঝেতে একটা কোডোপাইরিন ট্যাবলেটের স্ট্রিপ পাওয়া গিয়েছে। বেসিনের ওপরে একটা কাঁচের গ্লাসও আছে, মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে বন্ধুদের শেষ ব্যাচ খাবার পর নির্বাণীতোষ ওপরে চলে এসেছিল। রাত তখন পৌনে এগারটা। অন্ততঃ শিখেন্দুর কথা যদি ঠিক হয়, ঐ ঘরে তখন কেউ ছিল না, মানে বাড়ির কেউ ছিল না, নতুন বৌ নিচের তলায় তখনও ছিল এবং সেখানেই নতুন বৌকে ঘিরে ছিল ভিড়।
নতুন বৌকে স্বাতী ওপরে ঘরের সামনে যখন ছেড়ে দিয়ে যায়, রাত তখন পৌনে বারোটা কি বারোটা। তার মানে প্রায় একঘণ্টা সময়, পৌনে এগারটা থেকে পৌনে বারোটা, যা কিছু ঘটবার ঘটেছিল, ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কেউ ওপরে এসেছিল কিনা! যদি কেউ এসে থাকে তো সে কে? তারপর শিখেন্দু কখন ওপরে আসে? সম্ভবতঃ বারোটার কয়েক মিনিট পরে ও ওপর থেকে চিৎকারের শব্দটা শোনার পর। শিখে ওপরে এসেও জানায়নি কিছু। চেঁচামেচি বা ডাকাডাকি করেনি কাউকে। শিবতোষ ওপরে এসে দেখেন শিখেন্দু দাঁড়িয়ে আর মেঝেতে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে দীপিকা।
০৩. শিখেন্দু কেন চেঁচিয়ে সকলকে ডাকল না
শিখেন্দু কেন চেঁচিয়ে সকলকে ডাকল না!
হতভম্ব বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল? স্বাভাবিক, হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়। দীপিকাকে ঐভাবে অচৈতন্য অবস্থায় ঘরের কার্পেটের ওপরে পড়ে থাকতে দেখে তার হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।
তবু একটা প্রশ্ন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে উঁকি দেয়। শিবতোষের সঙ্গে একত্রে বাথরুমে প্রবেশ করার আগে শিখেন্দু বাথরুমে ঢুকেছিল কিনা, সে আগেই দুর্ঘটনাটা আবিষ্কার করতে পেরেছিল কিনা। যদি পেরে থাকে, পারাটা এমন কিছু অসম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, হয়ত ঘরে ঢুকে মেঝের ওপরে অচৈতন্য দীপিকাকে পড়ে থাকতে দেখে, সে বাথরুমে আলো জ্বলতে দেখে (?) ঢুকেছিল, তারপর সেখানে বন্ধুর মৃতদেহটা আবিষ্কার করবার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
বুঝে উঠতে পারেনি হয়ত, কি করবে এখন সে? কি করা উচিত? মনেও হয়ত পড়েনি কথাটা ঐ মুহূর্তে। কিংবা এও হতে পারে, ঘরে ঢুকে কাউকে সে দেখতে পায়নি। তখন ওদের খোঁজে বাথরুমে এসেঢোকে। ঐবাথরুমের মধ্যেই দুজনকে পড়ে থাকতে দেখে—একজন মৃত, অন্যজন অচৈতন্য। তখন সে দীপিকার অজ্ঞান দেহটা তুলে এনে সবে যখন ঘরের মেঝেতে নামিয়ে রেখেছে, শিবতোষ ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢোকেন।