- বইয়ের নামঃ অহল্যা ঘুম
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃগোয়েন্দা কাহিনী
০১. তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ
তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় সানাইয়ের ক্লান্ত রাগিণী মিলন-রাত্রির কথাই জানিয়ে দিচ্ছিল।
নিমন্ত্রিতের দল একে একে চলে গিয়েছে। শূন্য বিরাট প্যাণ্ডেলটায় জ্বলছে চোখ-ধাঁধানো শক্তিশালী বিদ্যুত্বাতিগুলো। সারি সারি তখন সাজানো রয়েছে টেবিল-চেয়ারগুলো। এখানে-ওখানে ফুলের মালা আর ছিন্ন পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে, উৎসবের চিহ্ন।।
সন্ধ্যার আগে থাকতেই সারি সারি যে গাড়িগুলো বাড়ির সামনের রাস্তাটায় ভিড় করেছিল, সেগুলো আর এখন নেই, রাস্তাটা একেবারে খালি।
কেবল বাড়ির সামনে রাস্তার উপরে এঁটোপাতা-কাগজ-গ্লাস-প্লেটগুলো নিয়ে গোটা দুই কুকুর মহোৎসব লাগিয়েছে। আর কিছু ভিখারী—তারাও যোগ দিয়েছে সেই ভোজন-উৎসবে।
বাড়ির সবাই প্রায় তখন ক্লান্ত, কেউ কেউ শোবার ব্যবস্থা করছে।
বাড়ির কর্তা শিবতোষবাবু তাঁর শয়নঘরে পাখার হাওয়ার নীচে বসে একটা সিগারেট টানছিলেন।
হঠাৎ একটা দীর্ণ চিৎকার যেন সানাইয়ের রাগিণী ছাপিয়ে শিবতোষবাবুর কানের গোড়ায় এসে আছড়ে পড়ল। জ্বলন্ত অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা আঙুলের ডগা থেকে খসে নীচে পায়ের কাছে কার্পেটের উপর পড়ে গেল শিবতোষের।
চিৎকারটা একবারই শোনা গেল। সানাই তখনো বেজে চলেছে। সোফা থেকে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি কোনমতে স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে সামনের বারান্দায় শিবতোষবাবু।
সামনেই পড়ে গেল শিখেন্দু।
কে অমন করে চিৎকার করল শিখেন্দু!
ধরতে পারলাম না কাকাবাবু, শিখেন্দু বললে,মনে হল, যেন তিনতলা থেকেই—
যারা তখনও জেগেছিল দোতলায়, তাদেরও কারও কারও কানে চিৎকারের শব্দটা পৌঁছেছিল—শিবতোষবাবুর বোন রাধারাণী দেবী, তাঁর স্ত্রী কল্যাণী, বড় মেয়ে স্মৃতি–
শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে নির্বাণীতোষের বৌভাত ছিল।
ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল তিনতলায় নির্বাণীতোষেরই ঘরে।
সবাই যেন কেমন হতম্ব, কেমন যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কেউ কোন কথা বলে না, কিন্তু সকলেরই চোখেমুখে যেন একটা প্রশ্ন স্পষ্ট, কিসের চিৎকার শোনা গেল? কে চিৎকার করে উঠেছিল একটু আগে?
শিখেন্দুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আমি দেখে আসি একবার তিনতলাটা।
কথাগুলো বলে শিখেন্দু আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে তিনতলায় উঠে গেল।
ওরা সকলে দাঁড়িয়েই থাকে। একটা অজ্ঞাত বোবা ভয় যেন ওদের সকলের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অকস্মাৎ। কিসের ভয়, কেন ভয়—তা জানে না ওরা। বোধ হয় ভাবতেও পারে না কেউ কথাটা। ভয় বস্তুটা এমনিই একটা ব্যাপার। এমনই সংক্রামক—এক মন থেকে অন্য মনে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ মিনিট দশ মিনিট পনেরো মিনিট প্রায় হতে চলল, এখনও কই শিখেন্দু তো উপর থেকে নীচে নেমে এল না, কি করছে এখনো ও উপরে! সকলেই যেন ঐ প্রশ্নটা করতে চায়, কিন্তু কেউ করছে না কাউকে। কারও মুখেই কোন কথা নেই তখনও।
শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই যেন অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা উচ্চারণ না করে আর পারে না। বললে, শিখেন্দু কি করছে ওপারে? আসছে না কেন? ওপরে গিয়ে দেখে আসব আমি একবার বাবা?
শিবতোষবাবু যেন কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন একবার, তারপর কোন কথা না বলে নিজেই পায়ে পায়ে এগুলেন সিঁড়ির দিকে।
ঝকঝকে চওড়া মোজাইক করা সিঁড়ি। সিঁড়ির পথ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। কিন্তু ক্ষণপূর্বের সেই ভয়টা যা তখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেটাই যেন পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাঁর গতি শ্লথ করে দিচ্ছে প্রতি পদবিক্ষেপে।
উপরে তিনতলাতেও ঠিক দোতলার মতই টানা বারান্দা—আগাগোড়া ডিজাইন টালিতে সব তৈরী। উপরের বারান্দাতেও আলো জ্বলছিল।
বারান্দাটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে, উপরের তলায় চারখানি ঘরের মধ্যে, শেষের দুটি ঘর নিয়েই নির্বাণীতোষ থাকত। তার শয়নকক্ষেই ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল।
ঘরের দরজাটা খোলা।
কোন সাড়া শব্দ নেই, কেবল সানাই তখনও বেজে চলেছে, ইমন কল্যাণের সুর।
খোলা দরজাপথে ভিতরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন শিবতোষ।
শিখেন্দু স্তব্ধ হয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার ঠিক সামনেই দামী কার্পেটে মোড়া মেঝের উপরে পড়ে আছে নববধূ, নির্বাণীতোষের সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী দীপিকা।
পরনে দামী আকাশ-নীল রংয়ের বেনারসী, হাতে চুড়ি, জড়োয়ার চূড়। কানে হীরের দুল-সিঁথিতে সিঁথিমৌর।
কাত হয়ে পড়ে আছে দীপিকা।
একটা হাত তার প্রসারিত, অন্য হাতটা দেহের নীচে চাপা পড়েছে, ঘোমটা খুলে গিয়েছে, জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা বেণীটা কার্পেটের উপরে লুটোচ্ছে।
দুটি চক্ষু বোজা। কপালে চন্দন, সিঁথিতে সিঁদুর।
পদশব্দে ফিরে তাকাল শিখেন্দু। কি ব্যাপার বৌমা, কথাটা শেষ করতে পারলেন না শিবতোষ। গলাটা তাঁর কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। শেষ কথাটা উচ্চারিত হল না।
বুঝতে পারছি না কাকাবাবু। ঘরে ঢুকে দেখি এখানে এইভাবে দীপিকা পড়ে আছে—
খোকা—খোকা কোথায়?
তাকে তো ঘরের মধ্যে দেখি নি। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, হাত দিতেই খুলে যেতে ভেতরে ঢুকে দেখি ঐভাবে দীপিকা পড়ে আছে–।
কিন্তু খোকা! খোকা কোথায় গেল? এবারে যেন আরও স্পষ্ট করে প্রশ্নটা উচ্চারণ করলেন। শিবতোষ।