সূর্য অস্ত যাবার তখনও বাকি।
এক খন্ড কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে সূর্যকে।
চারদিকে সন্ধ্যার আগেই নেমেছে সন্ধ্যার বিষণ্ণতা।
সেই বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে গোয়াদেল কুইভারের বুকে। গোয়াদেল কুইভারের নিরব স্রোত যেন বেদনার অশ্রু। আর তার দু’তীরে দাঁড়ানো কার্ডোভা নগরী যেন বিধ্বস্ত এক মুখচ্ছবি।
গোয়াদেল কুইভারে বয়ে চলেছে সেই বিধ্বস্ত মুখচ্ছবিরই অশ্রুর প্রস্রবণ।
গোয়াদেল কুইভারের তীরে দাঁড়ানো স্পেনে ৮শ’ বছর রাজত্বকারী খলিফাদের প্রাসাদ আল কাজার থেকে যন্ত্রণার বিলাপ উঠছে। সে প্রাসাদ মৃদু বিধ্বস্ত-উলংগ নয়, অপমানের আগুনে দগ্ধ করার জন্যে তাকে বানানো হয়েছে জেলখানা।
আল-কাজারের অল্প দূরে এক ফোঁটা তপ্ত অশ্রুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কর্ডোভার বড় মসজিদ। ১২৯৩টি স্তম্ভ, যাকে ষ্ট্যানলি লেনপুলও স্তম্ভ অরণ্য বলে অভিহিত করেছেন, এর ওপর দাঁড়ানো যে মসজিদটির বুক আবৃত থাকতো ৪৭ হাজার ৩শ কার্পেটে, যার বুক আলোকিত করতে ১০ সহস্র আলোক শিখা, তার সুউচ্চ মিনার আজ ভগ্ন, দরজা-জানালা লুন্ঠিত, দেয়াল-গাত্রের সৃদৃশ্য পাথর অপসৃত, মেঝে ক্ষত-বিক্ষত, তার সমগ্র বুকটি জমাট অন্ধকারে আবৃত, মুয়াজ্জিন নেই, আজানের অনুমতিও নেই, নামাজী নেই, নামাজীদের পদক্ষেপও সেখানে নিষিদ্ধ। আসন্ন সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকারে মুখ গুঁজে ক্ষত-বিক্ষত দেহ আর হৃদয়ের অসীম যন্ত্রণা নিয়ে মসজিদটি যেন গুমরে কাঁদছে! এই কান্নার রোল উঠছে দশ মাইল দীর্ঘ কর্ডোভার ২ লাখ ৬০ হাজার বিশ্বস্ত ভবনের অন্তরদেশ থেকেও।
গোয়াদেল কুইভারের সেতুতে দাঁড়ানো আহমদ মুসার দু’কান দিয়ে মর্মে প্রবেশ করছে সেই কান্নার রোল। এক তীব্র যন্ত্রণা দলিত মথিত করছে তার হৃদয়কে, সমগ্র সত্তাকে। যে কান্না সে শুনতে পাচ্ছে কর্ডোভার কন্ঠ থেকে তা তো শুধু কার্ডোভার নয়, গোটা স্পেন থেকেই উঠছে কান্নার করুণ আর্তনাদ। ৫শ’ বছর ধরে অসহায় মুসলমান যারা কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে গেছে তাদের সবার অশ্রু-বিলাপ ধ্বনি আর দীর্ঘশ্বস মিশে আছে স্পেনের বাসাসে এবং তার অসংখ্য বালুকণায়। তারা সবাই আজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কর্ডোভার বড় মসজিদের ভাঙা মিনারের অশ্রুধারার মধ্য দিয়ে তাদের সবাইকেই আহমদ মুসা দেখতে পাচ্ছে।
অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল আহমদ মুসার চোখ দিয়ে। গোয়াদেল কুইভার সেতুর রেলিংয়ে কনুই দু’টি ঠেস দিয়ে আহমদ মুসা এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গোদেল কুইভার নদীর তীরে দাঁড়ানো কর্ডোভার দিকে। তার স্বপ্নের কর্ডোভাকে আজ সে প্রথম দেখল। কর্ডোভার সামনে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।
সে দেখতে পাচ্ছে কর্ডোভার অতীতকে, কর্ডোভার মধ্য দিয়ে স্পেনের মুসলিম অতীতকে। সমগ্র ইউরোপ অজ্ঞতার অন্ধকারে যখন নিমজ্জিত, তখন মুসলমানদের হাতে প্রজ্বলিত জ্ঞানের শিখায় স্পেন ছিল সূর্যকরোজ্জ্বল মধ্যদিনের মতো দেদীপ্যমান। স্ট্যানলি লেনপুল (Moors in Spain)-এর ভাষায় ‘খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর কথা। তখন আমাদের স্যাকসন পূর্বপুরুষগণ কদর্য কুটিরে বসবাস করতেন, তখন আমাদের ভাষা গঠিত হয়নি; লেখা-পড়া প্রভৃতি অর্জিত গুণাবলীও অত্যল্প সংখ্যক মঠাধ্যক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, ইউরোপ তখন বর্বরোচিত অজ্ঞতা ও অসভ্যোচিত আচার-ব্যবহারে নিমগ্ন ছিল, আন্দালুসিয়ার রাসধানী (কর্ডোভা) সে সময় বিম্ময়কর বৈসাদৃশ্যের পরিচয় দেয়।’ এ কর্ডোভা নগরীতেই তখন ৩৫০টি হাসপাতাল ও ৮০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। অসভ্য ইউরোপীয়রা যখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বুঝত না এবং পানি স্পর্শ না করাকেই কৃতিত্বের মনে করতো, তখন এক কর্ডোভাতেই ছিল ৯০০টি পাবলিক হাম্মামখানা জনগনের গোসলের জন্যে। কর্ডোভাতে যখন মানুষ সরকারী বাতির আলোকে উজ্জ্বল রাস্তায় আনন্দে চলাফেরা করত, তার সাতশ’ বছর পরেও লন্ডনের রাস্তায় সরকারী বাতি জ্বলেনি। ইউরোপ যখন বিদ্যালয় কাকে বলে জানতো না, তখন স্পেনের মুসলিমরা জ্ঞান চর্চার জন্যে যে অগণিত বই ব্যবহার করতো তার নামের তালিকাটাই ছিল ৪৪ খন্ডে বিভক্ত। তাতে হেনরী স্মীথ ইউলিয়ামস বলেছেন, ‘মুসলমানরাই স্পেনকে সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল করেছে, তারা স্প্যানিশদের শিল্পকলা, দর্শন, চিকিৎসা বিজ্ঞান, অংক ও জ্যোতির্বিদ্যা।’
এই মুসলমানদেরকে সীমাহীন বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। এই বর্বরতার চিহ্ন পাওয়া যায় সমগ্র স্পেনে, পাওয়া যায় মালাগা, গ্রানাডা, শেভিল প্রভৃতি অসংখ্য শহরে, সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কার্ডোভায় এলে। আহমদ মুসা সেই কর্ডোভাকেই দেখছে অশ্রুসজল চোখে।
হঠাৎ আহমদ মুসার কনুই -এর চাপে ব্রীজের রেলিং এর এক টুকরো আস্তরণ খসে পড়ল। আহমদ মুসা মনোযোগ আকৃষ্ট ব্রীজের দিকে। ব্রীজে ওঠার সময় সে দেখেছে, ১৭টি খিলানে ওপর দাঁড়িয়ে আছে ব্রীজটি। ভূমিকম্প ও শত সহস্র প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে টিকে আছে হাজার বছরেরও বেশি কাল ধরে। সে সময়ের মুসলিম ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশলের অতুলনীয় এক সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্রীজটি। আহমদ মুসার পলক পড়ছে না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ব্রীজের দিকে। মনে হচ্ছে তার, সে এক ইতিহাসের অংশ। এক প্রান্তে সে দাঁড়িয়ে, অন্য প্রান্ত চলে গেছে অতীতের বুকে প্রায় তেরশ’ বছরের লম্বা পথ ধরে। স্পেনে প্রথম মুসলিম খলিফা আবদুর রহমান, মহামতি তৃতীয় আবদুর রহমান, হাকাম প্রমুখ একদিন এভাবেই হয়তো দাঁড়িয়েছিলেন এই ব্রীজের রেলিং-এ। তারিক বিন যিয়াদ, মু’সা বিন নুসায়েরের মতো সহস্র বীর সেনাধ্যক্ষ ও সৈনিকের স্পর্শ এ ব্রীজের গায়ে ঘুমিয়ে আছে। সহস্র বছর হলো, সোনালি অতীতের সবচেয়ে অক্ষত, সবচেয়ে সক্রিয় এই ব্রীজটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে মুসলিম কৃতিত্বের জয় ঘোষণা করছে। আহমদ মুসা মুখ নিচু করে তার দু’টি ঠোঁট স্পর্শ করল ব্রীজের গায়ে এবং মনে মনে বলল, স্পেনে মুসলিম সভ্যতা ভেঙে পড়েছে, পড়েছে ভেঙে আল-কাজার ও প্রিয় বড় মসজিদটির সুউচ্চ মিনারও, কিন্তু তুমি ভেঙে পড়নি। আহমদ মুসার দু’ফোঁটা অশ্রুও খসে পড়ল ব্রীজের গায়ে।
আহমদ মুসার মনে হলো ব্রীজটি যেন হঠাৎ কোন কথা বলে উঠল। কথা কান্নায় জড়ানো। বলল, ‘তোমার দুই ঠোঁটের আদরের স্পর্শ আমাকে কশাঘাত করেছ, তোমার কথা আমার বুকে শেল বিদ্ধ করেছে। আমি ভেঙে পড়িনি এটা আমার জন্যে অভিশাপ। এই অভিশাপ আমি বয়ে বেড়াচ্ছি আজ ৫০০ বছর ধরে। আল-কাজার বড় মসজিদ- ওদের বুকে শত্রুর পদচারণা নেই, শত্রুরা ওদের ব্যবহার করতে পারেনি, কিন্তু আমি ব্যবহৃত হচ্ছি আমি শত্রুদের পিঠে করে বয়ে বেড়াচ্ছি। আল-কাজার, বড় মসজিদ- ওরা শহীদ, কিন্তু আমি দুর্ভাগা ওদের স্বাথের ঘানি টানছি। তুমি কি পার না বিপ্লবী অতিথি, আমাকে ধ্বসিয়ে দিতে গোয়াদেল কুইভারের বুকে। দু’পাশের শত সাথীর লাশের মিছিলে আমার এই বেঁচে থাকাটা বড় দুঃসহ, বড় দুঃসহ।’
আহমদ মুসার দু’চোখ থেকে ঝর ঝর করে নেমে এলো অশ্রু। ব্রীজের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে বলল, ‘তোমার বেদনা আমি বুঝেছি, তোমার যন্ত্রণা আমি উপলদ্ধি করেছি, কিন্তু তোমার ভেঙে পড়া চলবে না, আরেক তারিক বিন যিয়াদ, আরেক মুসা বিন নুসায়ের ও আরেক আবদুর রহমানের জন্যে তোমকে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কতদিন, সেটা আমি জানি না।’
বলে আহমদ মুসা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
ব্রীজের অপর প্রান্ত থেকে তখন দু’টি ছোট্ট পকেট দূরবীনের চারটি চোখ আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ। এ চারটি চোখ আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ। এ চারটি চোখ বহুক্ষণ ধরে দেখছে আহমদ মুসাকে।
দু’টি দূরবীনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল আহমদ মুসা। জেন ব্রীজে উঠে ব্রীজের মাঝখানে দাঁড়ানো আহমদ মুসার দিকে চোখ পড়তেই তাকে চিনতে পেরেছে। চিনতে পেরে ভূত দেখার মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে জেন!
জোয়ান বলে ওঠে, ‘কি হলো?’
‘ঐ দেখ।’ আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল।
‘কে?’
‘জগতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী, তোমার স্বপ্ন আহমদ মুসা।’ আহমদ মুসা দিক থেকে চোখ না সরিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বলল জেন।
জোয়ান কোন কথা আর বলতে পারেনি। তার দু’টি চোখ আটকে গেছে আহমদ মুসার মুখে। জোয়ানের দৃষ্টির সমস্ত শক্তি, হৃদয়ের সমস্ত আগ্রহ ঝাঁপিয়ে পড়েছে আহমদ মুসার মুখের ওপর।
‘জোয়ান, দেখছ ওর চোখে অশ্রু?’
‘হ্যাঁ, উনি তাকিয়ে আছেন বিধ্বস্ত আল-কাজারের দিকে।’
তারপর দু’জন বসে পড়ছে ব্রীজের ঐ প্রান্তে এবং চোখ রেখেছে আহমদ মুসার ওপর।
আহমদ মুসার ঠোঁট দু’টি যখন ব্রীজের গা স্পর্শ করল তা তারা দেখেছে এবং যখন ব্রীজে তার মাথা রেখে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল তা তারা দেখল।
বিশ্ব-বিশ্রুত আহমদ মুসার এই একান্ত রূপ, যার রিপোর্ট কখনও খবরের কাগজে আসেনি, অভিভূত করল জেন ও জোয়ানকে।
‘চল, ওর কাছে যাই।’
‘না, জোয়ান, ওর এই আত্মস্থ অবস্থা থাক, ওঁকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না।’
আহমদ মুসা ব্রীজ থেকে মাথা তুলে আবার তাকাল আল-কাজারের দিকে। তাকাতে গিয়ে হঠাৎ আহমদ মুসার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল শতবর্ষের এক বৃদ্ধের ওপর। সফেদ চুলের ও ঝুলে-পড়া চামড়ার ঐ বৃদ্ধেরও দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল বিধ্বস্ত আল-কাজারের দিকে।
হঠাৎ আহমদ মুসার মনে পড়ল, বৃদ্ধটি হাসান সেনজিকের সেই বৃদ্ধ নয় তো?
আহমদ মুসা এগোলো বৃদ্ধের দিকে। বৃদ্ধের কাছে পৌঁছে দেখল, সত্যিই বৃদ্ধের চোখে অশ্রু! হাসান সেনজিকের বলা সেই ভাবলেশহীন মুখ। যেন এ পৃথিবীতে সে নেই!
আহদম মুসা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
বৃদ্ধ চোখ ফেরাল আহমদ মুসার দিকে। গভীরভাবে যেন পাঠ করছে আহমদ মুসাকে!
‘বহুদিন থেকে আপনি কাঁদেন, কেন আপনার এই কান্না?’ বলল আহমদ মুসা।
‘তোমার চোখে এই অশ্রু কেন?’ পাল্টা প্রশ্ন করল বৃদ্ধ।
‘আমি তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসায়েরের জন্যে কাঁদছি। তারা কবে আসবে আবার, কবে তাদের বন্দুক আবার গর্জন করে উঠবে গোয়াদেল কুইভারের তীরে, তারই অপেক্ষায় কাঁদছি।’
‘তুমি বোধ হয় স্পেনে নতুন?’
‘কেন?’
‘তোমার এই আবেগ দেখে মনে হচ্ছে।’
‘কেন? এই আবেদ এখানে নেই?’
‘এমন আবেগের জন্যে, যে আশা দরকার তা কোথাও কারো মধ্যে বর্তমান নেই। সবটা জুড়ে আছে হতাশা।’
‘আপনি কাঁদছেন কেন?’
‘কাঁদছি কারো আশায় পথ চেয়ে নয়। আমি এক বিধ্বস্ত অতীত, কাঁদছি আশার কবরের ওপর দাঁড়িয়ে।’
‘বুঝলাম না।’
‘বুঝে কাজ নেই।’
‘না, আমাকে বুঝতে হবে, আশার কবর রচিত হয়েছে আমি মানি না।’ রুখে দাঁড়ানোর মতো অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথার মধ্যে এক অপরিচিত শক্তির প্রকাশ যেন দেখতে পেল বৃদ্ধ! তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসাই কথা বলল আবার। বলল, ‘যে জাতি নিজেকে সাহায্য করে না, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন না। জনাব, আমি মনে করি, রাণী ইসাবেলা কিংবা ফার্ডিনান্ডের হাতে আমাদের পরাজয় ঘটেনি। আমাদের ভাগ্যের দরজা আমরাই বন্ধ করেছিলাম।’
‘তোমার কথা ঠিক, কিন্তু সবটুকু ঠিক নয়।’
‘আমিও স্বীকার করি, কিন্তু ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতন মুহূর্তে জীবন উৎসার্গীকৃত ‘মুসা’ ছিল একজন, আর আত্মসমর্পনকারী ‘আবু আবদুল্লাহ’ ছিল লাখ লাখ।
জেন ও জোয়ান অনেক্ষণ আগে এসে বৃদ্ধ ও আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়িয়েছিল। তারাও গোগ্রাসে গিলছিল এই কথোপকথন। ‘রাণী ইসাবেলা বা কিং ফার্ডিনান্ডের হাতে আমাদের পরাজয় ঘটেনি, আমাদের ভাগ্যের দরজা আমরাই বন্ধ করেছিলাম, ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতন মুহূর্তে জীবন উৎসর্গকারী ‘মুসা’ ছিল একজন আর আত্মসমর্পণকারী ‘আবু আবদুল্লাহ’ ছিল লাখ লাখ! আশার কবর রচিত হয়েছে আমি মানি না! প্রভৃতি আহমদ মুসার অপরূপ নতুন ও প্রত্যয়দীপ্ত কথাগুলো ইতিহাস সচেতন জেন ও জোয়ানকে এক নতুন জগতের মুখোমুখি করছিল।
আহমদ মুসা থামলেও বৃদ্ধ তখনও মুখ খোলেনি। বিস্মযে বৃদ্ধের চোখ দু’টি বড় বড় হয়ে উঠেছিল। তার বিস্ময় বিস্ফরিত চোখ অনেক প্রশ্ন! বৃদ্ধ তার লাঠিতে শরীরের ভারটা আরেকটু ন্যাস্ত করে বাঁকা কোমরটটা সোজা করার চেষ্টা করে বলল, ‘তুমি কে নওজোয়ান? স্পেনে তো এমন কন্ঠ, এমন কথা শুনিনি?’
‘বলব, কিন্তু এই ব্রীজে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনের আপনার এই কান্না কেন তা বলেননি।’
বৃদ্ধ গম্ভীর হলো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বৃদ্ধের বুক থেকে। বলল, ‘আমি প্রতিদিন এই ব্রীজে এসে বিরান আল কাজার, আর ভাঙা শূন্য হৃদয় কর্ডোভা মসজিদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কারণ বিধ্বস্ত আমার সাথে ওদের বড্ড মিল আছে। আমি ওদের সব হারানো মর্মস্পর্শী আর্তনাদ, যেভাবে বুঝতে পারি, আর কেউ তা পারে না। উঁচু ব্রীজের এখানে যখন এসে দাঁড়াই, তখন ওরা ও আমি এক হয়ে যাই। আমার দীর্ঘশ্বাস, ওদের দীর্ঘশ্বাস এক হয়ে যায়। এক সাথে আমরা কাঁদি। মনে অনেক শান্তনা পাই।’ থামল বৃদ্ধ।
‘আল-কাজার ও বড় মসজিদের সব হারানোর কথা জানি, কিন্তু আপনাকে তো জানি না!’ বলল আহমদ মুসা।
‘বলছি’, শুরু করল বৃদ্ধ, ‘আমার বলতে ছিল আমার ৪টি তাজা প্রাণ ছেলে, আর ফুলের মতো দু’টি মেয়ে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে একদিন বিকেল বেলা। আমি তখন ভীষণ অসুস্থ, শুয়েছিলাম। আমার চার ছেলে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, আব্বা, আর সহ্য করতে পারছি না। আজ ওরা বড় মসজিদে নাচ গানের আসর বসিয়েছে, সারা রাত ধরে চলবে। আপনি জানেন, সেখানে কি হবে। আমি বললাম, তোমরা কি করবে? তারা বলল, আমরা বাধা দেব। আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তারা বলল, আব্বা আমাদের আর ধরে রাখবেন না। বলে ছুটে বেরিয়ে গেল চারজন। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল, ফিরে এলো না ওরা। ক্রন্দনরত দু’বোন এসে আমাকে বলর, আব্বা, একটু খোঁজ নিয়ে আসি।’ আমি ওদেরও বাধা দিতে পারিনি। ওরাও বেরিয়ে গেল। ফিরে এলো না ওরাও। সারা রাত গড়িয়ে গেল, ছটফট করলাম সারা রাত বিছানায়। সকালে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঘর থেকে বেরুলাম। খোঁজ করলাম।
ব্রীজের এই স্থানেই উঁচু মঞ্চে হত্যা করে টানিয়ে রাখা হয়েছিল আমার চার ছেলেকে। আর আমার ফুলের মতো মেয়ে দু’টির কথা, বলতে পারব না বুক ফেটে যায়। ওদেরও রক্তাক্ত দেহ লাশ হয়ে এখানেই পড়েছিল।’ থামল বৃদ্ধ। ক্লান্তিতে ধুঁকতে লাগল।
আহমদ মুসার ঠোঁট দু’টি দৃঢ়সংবব্ধ, মুখ শক্ত। তার শূন্য দৃষ্টি গোয়াদেল কুইভারের বহমান স্রোতের দিকে।
অল্প দূরে ব্রীজের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো জেন ও জোয়ানের মুখ ভারি। চোখ তাদের ভিজে উঠেছে। জোয়ানের মনে স্মৃতির ভিড়। তার পূর্বপুরুষের ইতিহাস এবং তার সাথে মিলিয়ে নিচ্ছে বৃদ্ধের কাহিনীকে।
বৃদ্ধ চোখ মুছে বলল, ‘আমি রোজ এখানে আসি। কারণ আমার ছয়টি সন্তানের সঙ্গ এখানে এলে পাই। তারা আমাকে ঘিরে থাকে এখানে এলে। শূন্য মনটা যেন অনেক ভরে ওঠে!’ থামল বৃদ্ধ।
থেমেই আবার বলল, ‘এবার বলো তুমি কে? এত কথা আমাকে বলালে যা কাউকে বলিনি গত ৩০ বছর।’
‘আমার নাম আহমদ মুসা, জাতির একজন সেবক।’
‘না হলো না, কিছু বুঝলাম না। বলল বৃদ্ধ।
এই সময় এগিযে এলো জেন, তার পেছনে জোয়ান।
তারা আহমদ মুসা ও বৃদ্ধের সামনে দাঁড়াল।
‘মাফ করবেন আমাকে আপনাদের মাঝে এসে পড়ার জন্যে।’ তারপর একটু থেমে জেন বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জনাব, ইনি আহমদ মুসা, ফিলিস্তিন, মিন্দানাও, মধ্যএশিয়া, ককেশাস ও বলকান বিপ্লবের নায়ক- সেখানকার মুসলমানদের মুক্তিদাতা, তাদের স্বাধীনতার জনক।’
বৃদ্ধের মুখে একটা আলো জ্বলে উঠল নেচে উঠল তার চোখটা। তার পর তা পলকহীনভাবে স্থির হলো আহমদ মুসার মুখে। তার চোখ দু’টো যেন আটকে গেছে আহমদ মুসার চোখে!
চোখ ঐভাবে স্থির রেখেই বৃদ্ধ ধীরে ধীরে বলল, ‘এমটাই ভাবছিলাম আমি, তাছাড়া কে আর এমনভাবে কাঁদবে এসে মৃত কর্ডোভাকে দেখে, কে আর পারে স্পেনের মুসলিম ইতিহাসের গভীর থেকে চরম সত্য কথাটাকে এভাবে বের করে আনতে, কার পক্ষে আর পারা সম্ভব এমন প্রত্যয়দীপ্ত আশার বাণী উচ্চারণ করা!’
বৃদ্ধ তার ডান হাত বাড়িয়ে আহমদ মুসার হাত ধরল। বলল, ‘বিধ্বস্ত মুসলিম স্পেনের পক্ষ থেকে ইসলামের উত্থানের প্রতীক বিপ্লবী তোমাকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। তাবে হতাশার নিঃসীম অন্ধকারেও কখনও আশার প্রদীপ জ্বলতে পারে। স্পেনে এমনি একটি প্রদীপ যিয়াদ বিন তারিক। তার সাথে তোমার দেখা হয়েছে?’
‘না, সে কে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘এক প্রাণ-উচ্ছল তরুণ। ‘ফ্যালকন বল স্পেন’ বদর বিন মুগীরাকে কি তুমি জান, যে সব ছেড়ে বনে আশ্রয় নিয়েও আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন ইসাবেলা ও ফার্ডিনান্ডের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে?’
‘জানি’
‘সেই বদর বিন মুগীরার ভূলূন্ঠিত পতাকা তুলে ধরতে চাচ্ছে শপথদীপ্ত প্রানোচ্ছল তরুণ যিয়াদ বিন তারিক।’
‘কোথায় পাব তার দেখা?’ বলল আহমদ মুসা।
বৃদ্ধ চোখ বুজল। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, ‘গ্রানাডার স্বল্প দূরে ‘ফেজ আল্লাহু আকবার’ পাহাড় যাকে স্পেনীয়রা ‘মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস’ বলে। সেখানে যাবে। পাহাড়ের যে স্থানে দাঁড়িয়ে গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু্ আবদুল্লাহ শেষবারের মতো গ্রানাডোকে দেখেছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে বাদ আসর তিনবার আল্লাহু আকবর ধ্বনি দেবে। দ্বিতীয় তকবিরটি হবে দীর্ঘ, শেষটি হবে সবচেযে সংক্ষিপ্ত ও অনুচ্ছ।’
কথা শেষ করেই বৃদ্ধটি ‘আচ্ছালামু আলায়কুম’ বলে ঘুরে দাঁড়াল। চলতে শুরু করল।
জেন তাকে কিছু বলতে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা তাকে নিষেধ করল।
লাঠিতে দেহের ভার ন্যস্ত করে ধীরে ধীরে চলছে বৃদ্ধ ব্রীজের ওপর দিয়ে।
আহমদ মুসা, জেন জোয়ান তিনজনই এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
আহমদ মুসা তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ধীরে ধীরে বলর, ‘উনি শুধুই একজন সর্বহারা বৃদ্ধ নন, বিধ্বস্ত মুসলিম স্পেনের প্রতীক তিনি। সমগ্র মুসলিম স্পেন ওর কন্ঠে কথা বলে উঠেছে।’ ব্রীজ পার হয়ে চলে গেল বৃদ্ধ। হারিয়ে গেল দৃষ্টির আড়ালে। তার শূন্য ঐ জীবনের ঠিকানা কোথায় কে জানে!
আহমদ মুসা বৃদ্ধে চলার পথ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল জেন-এর দিকে। বলল, ‘হঠাৎ তোমাকে কার্ডোভায় দেখে বিস্মিত হয়েছি!’
‘অনুসরণ করছি মনে করেননি তো?’ বলল জেন।
‘ঐ প্রশ্ন সব সময় আমার সামনে আছে, কিন্তু সেই অনুসরণের কাজ তুমি করবে না জানি।’
‘আব্বা-আম্মা এসেছেন। তাঁদের সাথে এসেছি।’
‘তোমরা তো কার্ডিনাল পরিবার! কার্ডিনাল কটেজের মতো কার্ডিনাল হাউজও তো তোমাদের?’
‘হ্যাঁ, তবে কার্ডিনাল হাউজের বন্দীখানা নয়। এটা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের ।’
হাসল আহমদ মুসা, কিছু বলল না।
‘আমি মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আর এ জোয়ান। এও মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমরা এবার অনার্স পাস করেছি।’
‘অনার্স পাস করা কোন এক জোয়ানকে নিয়ে কি যেন ঘটেছে! সব সময় প্রথম হলেও সে মরিসকো একথা প্রকাশ পাওয়ায় সে নাকি প্রথম হতে পারেনি এবং তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাড়তে হয়েছে। তোমরা জান ব্যাপারটা?’
বিস্ময় ফুটে উঠল জেন ও জোয়ানের মুখে।
‘আপনি কি করে জানলেন এ ঘটনা?’ বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল জেন!
‘আমি মারিয়ার কাছে, শুনেছি।’
‘মারিয়া কে?’
‘বাস্ক গেরিলাপ্রধান ফিডেল ফিলিপের বোন মারিয়া। ওকে কিডন্যাপ করেছিল, ওকে বাঁচাতে গিয়েই ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের হাতে পড়েছিলাম আমি।’
জেন এবার জোয়ানকে দেখিয়ে বলল, ‘এই সেই জোয়ান, আর আমি হতভাগ্য জেন, যাকে অনার্সে প্রথম করা হয়েছে ওকে বাদ দিয়ে।’
‘কিন্তু দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যে এক সাথে!’ হেসে বলল আহমদ মুসা।
‘আমি ফার্স্ট হতে চাইনি।’
‘ওটা বলার দরকার পড়ে না। তোমরা পাশাপাশি সেটাই বড় প্রমাণ।’
বলে আহমদ মুসা জোয়ানের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘ভাইটি, মরিসকো বলে তুমি কষ্ট পেয়েছ?’
‘শুধু কষ্ট নয়, প্রথমে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম! কিন্তু পরে আব্বার রেখে যাওয়া পরিবারের গোপন দলিল আমাদের মরিসকো জেনারেশনের প্রথম পুরুষ আবদুল্লাহ বিন আবদুর রহমানের লেখা কাহিনী পড়লাম তখন দুঃখটা আনন্দে পরিণত হলো, লজ্জাটা পরিনত হলো গৌরবে।’
‘কিন্তু তোমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ও ছাড়তে হলো, অথচ হতে পারতে তুমি একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী।’
শুধু আমার কাছ থেকে আমার ছাত্র জীবন নয়, সপ্তাহ খানেক আগে ওরা আমার বিশাল বাড়ি ও বিরাট সম্পতি কেড়ে নিয়েছে। আম্মা অনেক কেঁদেছেন, কিন্তু আমার একটুও কষ্ট লাগেনি। আমার পূর্বপুরুষরা মরিসকো পরচিয় গোপন করে এই সম্পত্তি করেছিল, তা চলে যাওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আমি এখন নিজের পরিচয়ে নিজের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছি। এ জীবন আমার গৌরবের। আমি এখন জোয়ান নই, আব্বার দেয়া গোপন নাম আমার ‘মুসা আবদুল্লাহ! আমি এখন মুসা আবদুল্লাহ।’
আহমদ মুসা জোয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরল, বলল, ‘এই না যথার্থ মুসলিমের মতো কথা বলেছ!’
জোয়ানের মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, ‘কিন্তু আমি মুসলমানের তো কিছু জানি না। নামাজ জানি না, কোরআন জানি না।’
‘ঠিক আছে এখন সব শিখবে!’ এ অবস্থার জন্যে তো তুমি দায়ী নও!’
‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ আহমদ মুসাকে প্রশ্ন করল জেন।
‘বল।’
‘ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান আপনার পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরছে, ওরা হারিয়েছে ১ বিলিয়ন ডলার। আপনার ভয় করে না?’
‘জীবন-মৃত্যুর খেলা এটা। ভয় করলে তো খেলা হাবে না।’
‘এটা খেলা কি, খেলা তো বিনোদন!’ বলল জোয়ান।
‘এক ধরনের খেলাই বটে, জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই খেলা। তাই্এই খেলায় হার মানা যায় না। সুতরাং ভয়ের অবকাশ নেই।’
এই সময ওপারে সিঁড়ির গোড়ায় হর্ন বেজে উঠল।
আহমদ মুসা উৎকর্ণ হলো। এ হর্ন তো রবার্তোর। কিন্তু এ অসময়ে!
মুহূর্ত কয়েক পরেই একটি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল তাদের পাশে। ঠিক, রবার্তোর গাড়ি।
আহমদ মুসা ভ্রুকুঞ্চিত করে বলল, ‘রবার্তো, কিছু ঘটেছে নিশ্চয়?’
গাড়ি থেকে নামল রবার্তো। বলল, ‘এই কিছুক্ষণ আগে একজন লোক আমাকে গিয়ে বলল, তোমার গাড়িতে যে ভাড়া এসেছে তার নাম আহমদ মুসা কি না? এখানে কোথায় উঠেছে? আমি উত্তরে বলেছি, ভাড়া নিয়ে আমার কথা। নাম জিজ্ঞেস করা আমার কাজ না। জবাব না পেয়ে সে সরে গেল। এই এখনি আমি নদীতে নামছিলাম, মুখ ধোয়ার জন্যে। ঝোপের আড়ালে মানুষের কন্ঠ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। শুনতে পেলাম, কে যেন আমার গাড়ির নাম্বার বলছে, সেই সাথে বলল, ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক আছে, দেরি না হয় যেন! উঁকি দিয়ে দেখলাম ওয়াকিটকিতে কথা বলছে সেই লোকটি। তারপর নদীতে আর না নেমে আমি চলে এলাম।’
‘রবার্তো, তোমার গাড়ির নাম্বার পাল্টে ফেল।’ নির্দেশ দিল আহদম মুসা।
‘রবার্তো দ্রুত গাড়ির ভেতর থেকে নতুন নাম্বার প্লেট বের করে পাল্টে ফেলল গাড়ির নাম্বার।
আহমদ মুসা জেন ও জোয়ানকে বলল, ‘তোমরা ব্রীজ থেকে সরে পাশে কোথাও দাঁড়াও, রবার্তো তুমিও।’
বলে আহমদ মুসা গাড়ির ব্যাগের মধ্যে থেকে এক জোড়া গোঁফ ও হ্যাট বের করে আনল।
জেনরা ও রবার্তো সরে গেল ব্রীজ থেকে।
আহমদ মুসা গোঁফ পরে মাথায় হ্যাট চাপিয়ে ব্রীজের রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল গিয়ে।
বেশি সময় গেল না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্রীজের দু’দি গাড়ি এসে ব্রীজে প্রবেশ করল। ব্রীজে প্রবেশ করেই গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। দুই গাড়ি থেকে ২জন করে চার জন লোক নামল। ওরা ধীরে ধীরে পাইচারী করতে করতে আহমদ মুসার গাড়ির দিকে এগোলো।
আহমদ মুসা ব্রীজের পুব রেলিং -এ পশ্চিমমুখী হয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার দৃষ্টি ডুবন্ত সূর্যের দিকে। তবে দেখতে পাচ্ছ ওদের গতিবিধি।
ওরা মনে হয় গাড়ির নাম্বার ও আহমদ মুসাকে দেখে কিছুটা হতাশ হয়ে পাইচারী করতে লাগল। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনাও করল।
একজন আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘এই ক’মিনিট আগে একটা গাড়ি ও দু’জন লোক এখানে ছিল, কোন দিকে গেল ওরা?’
‘আমি বলতে পারব না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কতক্ষণ আছেন?’
‘অনেকক্ষণ।’
‘আপনি বিদেশি?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছেন।’
‘যারা ছিল তারা কোন দিকে কতক্ষণ আগে গেছে?’
‘আমি তো জবাব দিয়েছি।’
‘না, জবাব দেননি।’
‘আমাকে তো দেখি জেরা করতে শুরু করেছেন!’
‘আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিন। তাড়াতাড়ি।’
‘দেখুন, আপনার আচরন শোভন হচ্ছে না।’
‘শোভন আচরন ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান করে না। ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান কে চেনেন?’ বলে লোকটি পিস্তল বের করল। কিন্তু লোকটি পিস্তল ওপরে তোলার আগেই আহমদ মুসা ঐভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই তার বাম পা’টা দ্রুত চালাল লোকটির তলপেট লক্ষ্যে। লোকটি কোঁৎ করে উঠে ভাঁজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল, পিস্তলটিও ছুটে গেল তার হাত থেকে।
আহমদ মুসা তুলে নিল তার পিস্তল।
অন্য তিনজন এক সাথে দাঁড়িয়ে তর্ক শুনছিল এদিকে তাকিয়েই। হঠাৎ ঐভাবে ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মুহূর্তের জন্যে তার বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারপর তারা যখন পিস্তলের জন্যে পকেটে হাত দিচ্ছিল, তখন আহমদ মুসা পিস্তলের নল ওদের দিকে স্থির লক্ষ্যে উদ্যত। হাত ওদের আর নড়ল না।
আহমদ মুসা এগোলো ঐ তিনজনের দিকে। মুখে হাসি টেনে বলল, ‘তোমরা বুঝি হাইজাক পার্টি না? কতদিন এ পেশায়?’
‘না, আমরা হাইজাক পার্টি না? আমরা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের সদস্য।’
‘হ্যাঁ, ওরকম বড় দলের নামে পরিচয় দেয় সবাই বিপদে পড়লে। তোমরা আমার ওপর পিস্তল তুলেছিলে, হয়তো মেরেও ফেলতে গাড়িটা লুট করার জন্যে। বল, তোমরা কি শাস্তি চাও।’
ওরা কিছু বলতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বাধা দিয়ে বলল, ‘আর এক মুহূর্ত নয়, পিস্তল ফেলে দিয়ে রেলিং-এ উঠে নদীতে তিনজন এক সাথে ঝাঁপিয়ে পড়। ওকেও সাথে করে নিয়ে যাও। ও অজ্ঞানের ভান করে আছে। ঐটুকু লাথিতে ক্রিমিনালরা অজ্ঞান হয় না।’
ঠিক তাই। ওরা তিনজন রেলিং এ উঠলে সেও উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা বলল, ‘এক মাইল যাওয়ার পর তোমরা তীরে উঠবে, আমি দাঁড়িয়ে দেখছি।’
ওরা চারজন এক সাথেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
হাসল আহমদ মুসা। বেচারা ওরা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের নতুন রিক্রট।
জেন, জোয়ান ও রবার্তো সামনে এসে দাঁড়াল আহমদ মুসার।
আহমদ মুসার হাতে তখনও একটা পিস্তল, আরও তিনটা পিস্তল মাটিতে পড়ে আছে। সেদিকে ইংগিত করে বলল, ‘জেন, জোয়ান, রবার্তো তোমরা তিনজন ও তিনটা পিস্তল নিতে পার, ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যানের অনেক টাকা আছে। কিনে নিতে পারবে।’
আহমদ মুসা তখন গোঁফ ও হ্যাট খুলে ফেলছে।
‘পিস্তলে আমার ভয় করে! জোয়ান, তুমি নাও।’ বলল জেন।
জোয়ান ও রবার্তো পিস্তল তুলে নিল এবং তৃতীয় পিস্তলটা জোয়ান আহমদ মুসার হাতে দিল।
‘আমরা ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি, আপনি যাদু জানেন কানি মুসা ভাই যে, ওরা চার চারজন সশস্ত্র মানুষ এই শীতে সন্ধ্যায় একান্ত অনুগতের মতো নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল।’
বলে জেন নদীর দিকে আঙ্গুলি সংকেত করে বলল, ‘দেখুন, ওরা এখনও নির্দেশ মোতাবেক সাঁতারাচ্ছে, তীরে ওঠেনি।’
‘যাদু নয় জেন, যারা অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকে, তারা মনের দিকে থেকে খুব দুর্বল হয়, আর জীবনের ভয় ওরা খুব বেশি করে।’
‘কিন্তু ঐ যে লোকটা পিস্তল বের করেছিল, আপনি যদি ঐভাবে তাকে কাবু করতে না পারতেন তাহলে কি হতো?’
‘বলেছি তো জেন, এটা জীবন-মৃত্যুর খেলা। এখানে জীবন আছে অথবা মৃত্যু-মাঝখানে কিছু নেই।’
‘কিন্তু ওদের আপনি ছেড়ে দিলেন যে, ওরা আপনাকে ছাড়তো না।’
‘তা ঠিক, কিন্তু ওরা বেতনভোগী হুকুম পালকারী ছাড়া কিছুই নয়, কি দরকার ওদের সংসারে হাহাকার এনে!’
‘শত্রুর সংসারের কথা আপনি চিন্তু করেন?’
‘আমরা মানুষ এক পরিবারেরই তো সন্তান!’
‘ইসলাম কি এভাবেই চিন্তা করতে শেখায়?’
‘অবশ্যই। রাজা-বাদশাদের ইতিহাস নয়, ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামের যারা অনুসরণ করেছে সেই সব রাজা-বাদশার ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখ, ইসলাম মানুষকে মুক্ত করেছে, জুলুম করেনি, জুলুমকে প্রশ্রয়ও দেয়নি। তোমাদের স্পেনের দিকেই তাকিয়ে দেখ। মুসলমানেরা খৃষ্টানদের ভালোবাসা দিয়েছে, সমৃদ্ধি দিয়েছে, আর খৃষ্টানরা যখন সুযোগ পেল মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করল।’
‘এর প্রতিকার কি হবে?’
‘জালেমরা সব সময় বিজয়ী থেকেছে, একম নজির ইতিহাসে নেই।’
‘স্পেনে কি কোন পরিবর্তন আসবে?’ বলল জেন।
‘ওটা অনেক বড় কাজ, আল্লাহই জানেন।’
‘প্রশ্নটা এজন্যেই করলাম, আপনি যেখানেই পা দেন পরিবর্তন আসে।’
‘ওটাও আল্লাহরই হচ্ছা, মানুষ চেষ্টা করে, ফল তার হাতে নয়।’
‘বলতে পারি, চেষ্টা আপনি করবেন।’
হেসে উঠল আহমদ মুসা। বলল, ‘জেন, তুমি কার্ডিনাল পরিবারের মেয়ে, কিন্তু বাস্তবে তা তো মনে হচ্ছে না।’
‘কার্ডিনাল পরিবারের মেয়েরা কি অন্যায়কে অন্যায়, ন্যায়কে ন্যায় বলতে পারবে না?’
‘তোমাকে ধন্যবাদ, জেন। চল, আজকের মতো উঠি। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।’
‘আরেকটা প্রশ্ন, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার কে কে আছে, কোথায় আপনার বাড়ি?’
‘সব প্রশ্নের উত্তর একদিনে নয়।’ বলে হেসে উঠে হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়াল আহমদ মুসা। বলল, ‘আজ বড় মসজিদেই আমি নামাজ পড়তে চাই।’
আহদম মুসা পা বাড়াল সামনে।
তার পেছনে জেন, জোয়ান ও রবার্তো।
কার্ডাভার অখ্যাত একটি হোটেল।
আহমদ মুসা প্রস্তুত হয়ে ব্যাগ হাতে তার একটি কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো।
গ্রনাডা যাত্রার জন্যে তৈরি।
রবার্তো ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসেছে। তার পাশের সিটে বসেছে জোয়ান। জোয়ানও আহমদ মুসার সাথে গ্রানাডা যাচ্ছে। আহমদ মুসা প্রথমে নিতে চায়নি, বিপদের ঝুঁকি আছে বলে। আহমদ মুসা বলেছিল, জোয়ান তার মা, দাদীকে এক ঐভাবে ফেলে কোন কিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। কিন্তু জোয়ান জেদ ছাড়েনি! জেনও অনুরোধ করেছে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসার সঙ্গ জোয়ানের জন্য এক দুর্লভ পাওয়া হবে বলে জেন মনে করেছে। অবশেষে আহমদ মুসা রাজী হয়েছে।
আহমদ মুসা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতেই হোটেল মালিক জিমেনিজের সাথে তার দেখা হলো। জিমেনিজ তার কাছেই আসছিল।
হোটেল মালিক জিমেনিজ সামনে এসে আহমদ মুসার হাত চেপে ধরে বলল, ‘আপনি হোটেল ভাড়া ও খাবার বিল দিয়েছেন, এটা নিলে এ টাকা আমাকে আগুনের মতো পোড়াবে, মনের জ্বালায় আমি মরে যাব।’ প্রায় কান্নাজড়িত কন্ঠ জিমেনিজের।
হোটেল মালিক জিমেনিজ রবার্তোর পূর্ব পরিচিত। চাকুরির সন্ধানে এসে কয়েকদিন সে এখানে ছিল। তখনই পরিচয় জিমেনিজ মরিসকো। কিন্তু বাইরের কেউই তার পরিচয় জানে না। ছদ্ম পরিচয়ে সে হোটেল চালাচ্ছে।
হোটেল মালিকের সাথে পরস্পরের মরিসকো হওয়া সম্পর্কে জানাজানি হয়ে যায় ঘটনাক্রমেই। একদিন রবার্তো তার হোটেল কক্ষে শুয়ে শুয়ে ‘ম্যানসেবো ডে আরেভ্যালো’(Young man from Manccbo) পড়ছিল। ‘ম্যানসেবো ডে আরেভ্যালো’ মরিসকোদের একটা বিখ্যাত কাহিনী। গ্রস্থটি ‘আল জামিয়াতো’ (হরফ আরী, ভাষা স্প্যানিশ) ভাষায় লেখা। ম্যানসেবে নামক একজন খচ্চর চালক মরিসকো- এর আবেগজড়িত কাহিনী নিয়ে এই বইটি। এই খচ্চর চালক মরিসকো বাইরের পরিচয় খৃষ্টান, কিন্তু অন্তরে তার ঈমানের আগুন। কাবা শরীফ দর্শন ও মহানবী (স) এর মাজার যেয়ারতের জন্যে হৃদয় তার ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। গরীব খচ্চর চালক অত্যন্ত সংগোপনে কঠোর পরিশ্রম করে তিল তিল করে টাকা জমিয়েছে। স্পেন থেকে সমুদ্র পথে মক্কা সে যেতে পারবে না, ধরা পড়ে যাবে। আবার জিব্রালটার পার হয়ে উত্তর আফ্রিকায় পার হতে চাইলে ধরা পড়ার ভয় আরও বেশি। এজন্যে ম্যানসেবে সবার চোখ এড়িয়ে উত্তর স্পেনের আবাগন এলাকায় যায়। সেখান থেকে গোপনে সে ঢুকে পড়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে। তারপর সে গোপনে ইটালি পাড়ি দেয়। সেখান থেকে সে জেনোয়া যায়। জেনোয়া থেকে শ্রমিকের বেশে সে পাড়ি দেয় আরবে। পৌঁছে যায় সে তার স্বপ্নের, তার বড় সাধনার ধন কাবা শরীফে।
রবার্তো পড়ছিল এই মর্ম স্পশী কাহিনী। তার চোখ দিযে পড়ছিল অশ্রু।
ঘরের দরজা খোলা ছিল। খোলা দরজা দেখে ঘরে উঁকি দেয় হোটেল মালিক জিমেনিজ। সে দেখেতে পায় রবার্তোর অশ্রু, পুস্তকটির নামও তার চোখে পড়ে। জিমেনিজের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
রবার্তো পুস্তক থেকে মুখ তোলে। তখনও তার চোখে অশ্রু।
‘তুমি মরিসকো রবার্তো?’ উজ্জ্বল চোখে প্রশ্ন করে জিমেনিজ।
রবার্তো উঠে বসে। সুষ্পষ্ট কন্ঠে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি মরিসকো।’
জিমেনিজ পাগলের মতো বুকে জড়িয়ে ধরে রবার্তোকে, হু হু করে তার বুক থেকে উঠে আসে কান্না।
আহমদ মুসা বাঁ হাত থেকে ব্যাগটি নিচে রেখে বলল, ‘জনাব, হোটেল আপনার ব্যবসায়, আর এ ব্যবসায় আপনার জীবিকা।’
জিমেনিজের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সে নরম ও কাতর কন্ঠে বলল, ‘ব্যবসায় বলে কি আমি আমার আত্মীয়, আমার ভাইদের কাছ থেকে টাকা নিতে পারি? আপনি কী আত্মীয়ের চেয়ে বড় নন? তার চেয়ে বড় কথা হলো, আপনি যে কাজ করছেন সেটা আমারও কাজ।’
বৃদ্ধের কাতর কন্ঠ আহমদ মুসার হৃদয়টা ভিজিযে দিল। স্পেনে হতাশার জমাট অন্ধকারে এমন কত মন লুকিয়ে আছে কে জানে! আবেগের এক বন্যা এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসাকে। সে দু’হাতে বৃদ্ধের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, ‘যারা হারিয়ে গেছে বলে দূর থেকে আমরা ধরে নিয়েছিলাম সেই মরিসকোদের মনে এত আবেগ, এত বেদনা ও এত কথা লুকিয়ে আছে কল্পনা করিনি। যার সাথেই দেখা হয়েছে, আমাকে অভিভূত করেছে তারা। এই বিশ্বাস এখন আমার দৃঢ়, পাঁচশ’ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিকূলতা যে চেতনাকে মেরে ফেলতে পারেনি, সে চেতনা বিজয় লাভ করবেই।’
জিমেনিজ আহমদ মুসাকে তার টাকা ফেরত দিযে টাকার আরেকটি প্যাকেট তার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘আমি বড় কেউ নই, জাতির জন্যে কিছু করার ক্ষমতাও আমার নেই। জাতির জন্যে আমার এটুকু দান গ্রহন করলে আমার বেদনা-জর্জরিত হৃদয়ে শান্তির একটু স্বাদ পাব।’
‘কিন্তু জনাব, এই আমানতের দায়িত্ব পালন আমার জন্যে অত্যন্ত কঠিন।’
‘কোন আমানতের দায়িত্ব এর মধ্যে নেই, এ আপনার সম্পদ।’
আহদম মুসা নামিয়ে রাখা ব্যাগ তুলে নিতে যাচ্ছিল। বৃদ্ধ জিমেনিজ তাড়াতাড়ি ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলল, ‘চলুন’।
আহমদ মুসা বৃদ্ধ জিমেনিজের দিকে চাইল, কিন্তু বাধা দিতে পারল না।
পাশাপাশি দু’জন হেঁটে চলল গাড়ির দিকে।
গাড়িতে উঠল আহমদ মুসা।
জিমেনিজ ব্যাগটা গাড়িতে রেখে নিজের হাতে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল।
আহমদ মুসা বিদায়ের সময় বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তর দিল, ‘ওয়া আলায়কুম…..।’
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আহমদ মুসার গাড়ি গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়তেই সামনে থেকে এলো জেনের গাড়ি।
আহমদ মুসা গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। তার পাশে এসে দাঁড়াল জেনের গাড়ি।
জেন লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলো। ছুটে গেল আহমদ মুসার জানালায়। বলল, ‘দেরি করব না। আপনার জন্যে আমার শুভেচ্ছা। ঈশ্বর আপনাকে সুস্থ রাখুন, নিরাপদ রাখুন, দীর্ঘজীবী করুন।’
‘ধন্যবাদ, জেন। হেসে বলল আহমদ মুসা।
তারপর জেন গিয়ে জোয়ানের পাশের জানালায় দাঁড়াল। জোয়ানের হাতে একটা লাল গোলাপ ও একটা মানি ব্যাগ গুজে দিয়ে জোয়ানের ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করে বলল, ‘পারলে টেলিফোন করো, বাড়ির জন্যে ভেব না, আসি।’
বলে জেন ছুটে তার গাড়ির কাছে চলে গেল। স্টার্ট নিল তার গাড়ি।
আহমদ মুসার গাড়িও ষ্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করল।
জোয়ানের এক হাতে ফুল, আরেক হাতে মানিব্যাগ। লাল গোলাপ উপহার পেয়ে লাল গোলাপের মতোই লাল হয়ে উঠেছে জোয়ানের মুখ। আহমদ মুসার সামনে এভাবে তাকে এমন লাল গোলাপ দেয়া কি ঠিক হয়েছে! কী বুছেছেন তিনি ও রবার্তো! ওদের দিকে মুখ তুলে তাকাতে লজ্জা করেছ জোয়ানের।
আহমদ মুসা সামনে তাকিয়ে আছে স্থির দৃষ্টিতে। তার -চোখে ভাসছে গ্রানাডার চিত্র, বৃদ্ধের সেই নিউ ফ্যালকন যিয়াদ বিন তারিকের না দেখা বিমূর্ত এক অবয়াব এবং মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্স, কর্ডোভা, গ্রানাডা, মালাগার, সেভিলের শত মুসলিম স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কালো বিভীষিকার দৃশ্য। মুখ ক্রমেই গম্ভীর হয়ে উঠল আহমদ মুসার্ কোন পথে এগোবে সে এই ভয়ানক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে? নিউ ফ্যালকন যিয়াদ বিন তারিকের কাছ থেকে কি কোন আশার আলো সে পাবে? তার মনে পড়ল সামনে বসা তরুণ পদার্থ বিজ্ঞানী জোয়ানের কথাও। ষড়যন্ত্রটাও বৈজ্ঞানিক পথে। উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মুখ।
ছুটে চলছে গাড়ি আন্দালুসিয়া হাইওয়ে ধরে দক্ষিণ-পূর্ব গ্রানাডার পথে। ভাবছে আহমদ মুসা।
ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান মাদ্রিদে মুসলমানদের নতুন অস্তিত্ব ও স্পেনের সব মুসলিম স্মৃতিচিহ্নগুলো একেবারে মুছে ফেলার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে মজলুম মরিসকোরাও জেগে ওঠার জন্যে চোখ খুলছে, তার ওপর গোয়াদেল কুইভার ব্রীজের সেই বৃদ্ধ খবর দিল নিউ ফ্যালকন অব স্পেনের আশাদীপ্ত উত্থানের! মুসলিম আন্দালুসিয়ার বিরান প্রান্তরে গোয়াদেল কুইভারের তীরে কি তাহলে ঘটতে যাচ্ছে আরেকটা ঘটনা, আরেকটা পরিবর্তন! গোয়াদেল কুইভারের সেই লড়াইয়ে খৃষ্টান রডারিকের বিরুদ্ধে জিতেছিল জাবালুত্তারিক হয়ে আসা জাহাজ পুড়িয়ে ফেরার পথ করে দেয়া ইসলামের সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদ। এবার গোয়াদের কুইভারের নতুন লড়াইয়ে কে জিতবে?
গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত আহমদ মুসা।
বিরামহীন এক শোঁ-শোঁ শব্দ ছুটে চলেছে গাড়ি আন্দালুসিয়া প্রান্তরের বুক চিরে।
১৩. আন্দালুসিয়ার প্রান্তরে
গ্রানাডা থেকে দু’মাইল দূরে ‘মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস’ পাহাড়, স্প্যানিশ ভাষায় ‘Eultimo suspiro del Moro’। স্প্যানিশরা একে এই নামেই ডেকে থাকে স্পেনের শেষ মুসলিম সুলতান আবু আব্দুল্লাহর শেষ বিলাপকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য। পরাজিত ও আত্ম – সমর্পিত সুলতান আবু আব্দুল্লাহ গ্রানাডা নগরীর চাবি বিজয়ী ফার্ডিন্যান্ডের হাতে তুলে দেয়ার পর নিঃস্ব হয়ে নগরী ত্যাগ করে চলে আসেন। এই পাহাড়ে এসে ফিরে দাঁড়ান তিনি অতি সাধের গ্রানাডা কে শেষ বারের মত এক নজর দেখার জন্য। যে কান্না, যে অশ্রুকে সুলতান এই পর্যন্ত রোধ করে রেখেছিলেন, গ্রানাডার উপর শেষ নজরটি পড়ার পর তা আর কোন বাধ মানল না। শিশুর মত অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ করতে লাগলেন তিনি। আর তিনি বলতে লাগলেন, ‘আল্লাহু আকবর, আমার মত দুর্ভাগ্য কার!’ এই ঘটনা থেকে মুসলিমরা এই পাহাড়ের নাম দেয়, ‘ফেজ আল্লাহু আকবর।’ আর স্পেনীয় খ্রিষ্টানরা বলেন, ‘মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস।’
মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের আহমদ মুসা যখন পৌঁছেছিল, তখন সাড়ে তিনটা। আসরের নামাযের তখনও অনেক দেরি। শোয়া চারটায় আসরের নামায এখানে।
আহমদ মুসা নামেনি গ্রানাডায়, সোজা চলে এসেছে মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ে।
কর্ডোভা থেকে যে আন্দালুসিয়ান হাইওয়ে বেরিয়ে এসেছে, সেটা গ্রানাডার বুকের উপর দিয়ে মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের গিরিপথটি অতিক্রম করে চলে গেছে দক্ষিণে জিব্রালটার প্রণালীর দিকে। গ্রানাডা প্রবেশের অনেক আগেই আহমদ মুসা সিয়েরা নিবেদা পাহাড়ের পাদদেশে, দাঁড়ানো ‘আল হামরার দৃষ্টি মনোহর লাল প্রাসাদের একটা অংশ এবং তার ১২টি অভ্রভেদী চুড়ার একটির একটা ভাঙ্গা অংশ দেখতে পেয়েছিল। বুকে একটা প্রচন্ড খোঁচা লেগেছিল আহমদ মুসার। চোখের সামনে ভীড় করে উঠেছিল অতীতের হাজারো দৃশ্য এবং বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিল হাজারো কথা।
ভারী হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসার চোখ। হঠাৎ নিরব হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা। গ্রানাডায় পৌঁছে রবার্তো একবার বলেছিল আহমদ মুসা ভাই, গ্রানাডায় আমরা কি দাঁড়াব?
কোন উত্তর আসেনি আহমদ মুসার কাছ থেকে। রবার্টও পেছনে ফিরে আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে আর কোন প্রশ্ন করেনি।
মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের শীর্ষদেশের নিচেই প্রশস্ত একটা চত্বর আছে এখানে দাঁড়িয়েই স্পেনের শেষ মুসলিম সুলতান আবু আবদুল্লাহ, তার পরিবার এবং তার সাথীরা গ্রানাডাকে শেষবারের মত দেখেছিল। এই জায়গাটা স্প্যানিশ খ্রিস্টানদের জন্যে গৌরবের জায়গা। প্রতিবছর ২রা জানুয়ারী যখন খ্রিস্টানরা গ্রানাডা বিজয়ের উৎসব করে, তখন এখানে তারা আবু আবদুল্লাহর দু’শ পুত্তলিকা দাঁড় করিয়ে তার চোখে একটা পানির নল লাগিয়ে দেয় যেখান থেকে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে পানি। আর এই জায়গাটা মুসলিমদের জন্য কাঁদার জায়গা।
আহমদ মুসা মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ে উঠে এই চত্বরটিতে এসে দাঁড়াল।
মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়টি গ্রানাডার সোজা দক্ষিণে। তার চত্বরটি থেকে ভেগা প্রান্তরে দাঁড়ানো গ্রানাডা নগরীকে অত্যন্ত সুন্দর লাগে। দেখা যায়, গ্রানাডার গা ছুয়ে সেনিল নদী সবুজ ভেগা প্রান্তরের বুক চিরে রুপালী ফিতার মত এগিয়ে গেছে।
চত্বরটিতে উঠে উত্তর দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠল গ্রানাডা। কিন্তু লাল পাথরের নিরাভরণ আলহামরা (যাকে সারাজিনী নাইডু বলেছেন তাজমহলের চেয়ে অধিকতর অনিন্দসুন্দর এবং ঐতিহাসিক স্যার আমীর আলী যার সম্পর্কে বলেছেন আলহামরার দৃশ্য বর্ণনা অত্যন্ত শক্তিশালী কলমের দ্বারাই শুধু সম্ভব) যেন বৈধব্যের পোষাক পরে মুখভার করে দাড়িয়ে আছে।
আহমদ মুসা চোখ সরাতে পারলো না গ্রানাডার উপর থেকে। ধীরে ধীরে আজকের গ্রানাডার দৃশ্য সরে গিয়ে তার চোখে ভেসে উঠছে আরেক গ্রানাডার দৃশ্য। যে দৃশ্যে আহমদ মুসা দেখল হৃদয় বিদারক এক নাটকঃ
১৪৯১ সালের ২রা জানুয়ারী। সূর্য উঠতে তখন ও অনেক দেরী। আত্মসমর্পিত গ্রানাডার মুসলিম অধিবাসীরা তখনও ঘুম থেকে জাগেনি। আত্মসমর্পণ এর শর্ত অনুসারে গ্রানাডা ত্যাগের জন্য সুলতান আবু আবদুল্লাহ তার পরিজন ও সাথী সহ আল-হামরা প্রাসাদের পশ্চাতের এক দুয়ার দিয়ে বের হলেন এবং নগরীর সবচেয়ে জনহীন অংশ দিয়ে গ্রানাডা ত্যাগ করলেন। সুলতানের চোখে অশ্রু নেই, কিন্তু সুলতানের হেরেমের মহিলারা আত্ম-সংযম করতে পারলো না, তারা সকলেই রোদন করছিল। সুলতান চাইছিলেন, বিদ্রুপ- কঠোর তাদের এ দৃশ্য যেন না হাসে, আর শত্রু তাদের দেখে যেন জয়োল্লাস না করে, এই জন্যই এই গোপন বাবস্থা। সুলতানের এই ছোট কাফেলাটি গ্রানাডা থেকে বেরিয়ে ভেগা প্রান্তরে সেনিল নদী অতিক্রম করে আল-পুজারিশ পাহাড় পাড়ি দিয়ে এক গ্রামে এসে দাঁড়ালেন।
………ওদিকে বিজয়ী খ্রিস্টান সম্রাট ফার্ডিন্যান্ড এবং রানী ইসাবেলার বাহিনী সেনিল নদীর তীরে শহীদ পাহাড়ের কাছে এক ক্ষুদ্র মসজিদের কাছে এসে উপস্থিত হল। সুলতান আবু আবদুল্লাহ তার কয়েকজন সাথী সমেত খ্রিস্টান রাজ-দম্পতির সামনে এলেন। রাজ-দম্পতির সামনে বশ্যতা স্বীকার এর চিহ্ন ঘোড়া থেকে নামতে উদ্যত হলেন। কিন্তু ফার্ডিন্যান্ড তাকে নিষেধ করলেন। অধীনতা জ্ঞাপনের জন্য সুলতান তখন সম্রাট এর হাতে চুম্বন করতে অগ্রসর হলেন। ফার্ডিন্যান্ড তাও করতে দিলেন না। অবশেষে আবু আবদুল্লাহ নত ফার্ডিন্যান্ড এর ডান হাতকে সালাম করলেন। অতঃপর সুলতান আবু আবদুল্লাহ প্রাসাদের চাবি সম্রাট ফার্ডিন্যান্ডের হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন, ‘এই চাবি স্পেনের মুসলিম শাসনের শেষ নিদর্শন। রাজন, আমাদের রাজ্য, আমাদের ধন-সম্পদ, আমাদের প্রাণ পর্যন্ত আপনার করায়ত্ব। আপনি অঙ্গিকার করেছেন, আমাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন। আমরা আপনার সেই দয়া-ই প্রত্যাশা করি।’ …..ঠিক এই সময় আল-হামরার দূর্গ শীর্ষ থেকে মুসলিম শাসনের অর্ধচন্দ্র পতাকা ভূ-লুণ্ঠিত হল, আর তার স্থানে সকালের সোনালি সূর্য কিরণে রৌপ্য নির্মিত প্রকাণ্ড ক্রস ঝলমল করে উঠল। ক্রসটি এখানে স্থাপন করলেন একজন বিশপ। পরে সেখানে উত্তোলিত হল রাজকীয় পতাকা, উত্তোলন করলেন ফৌজের প্রধান পতাকাবাহী।
আহমদ মুসার পলকহীন চোখ থেকে দু’টি অশ্রু ধারা নামছিল তার দু’গন্ড বেয়ে। একসময় গ্রানাডার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে তাকাল জোয়ানের দিকে, রবার্তোর দিকে।
গ্রানাডার দিকে নিবন্ধ– দৃষ্টি আহমদ মুসার চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে দেখে জোয়ান এবং রবার্তো অভিভূত হয়ে পড়েছিল।
আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, জোয়ান, রবার্তো, শত শত বছর আগের গ্রানাডার ছবি দেখলাম।
‘কি ছবি?’ বলল জোয়ান।
‘ছবিটা মুসলিম গ্রানাডার অন্তিম দৃশ্য।
দেখলাম সেই দৃশ্য, কিভাবে শেষ সুলতান আবু আবদুল্লাহ আল-হামরা থেকে, গ্রানাডা থেকে বেরিয়ে এলেন, কিভাবে কি কথা বলে নগরীর চাবি তুলে দিলেন ফার্ডিন্যান্ডের হাতে, কিভাবে গ্রানাডার দূর্গশীর্ষ থেকে মুসলমানদের অর্ধচন্দ্র পতাকা ভূ-লুণ্ঠিত হল এবং তার জায়গায় উঠে এল ক্রস।’
‘আপনার চোখের অশ্রু কি এই দৃশ্য দেখে?’ বলল রবার্তো।
‘ঠিক শুধু এই দৃশ্য দেখেই নয়, সুলতান আবু আবদুল্লাহকে ফার্ডিন্যান্ডের হাতে নগরীর চাবি তুলে দিয়ে তার সামনে মাথা নত করে নিরাপত্তা ও ক্ষমা–ভিক্ষা করতে আমি যখন দেখছিলাম, তখন গ্রানাডার আরেক সিংহ–দিল তরুনের কথা আমার মনে পড়েছিল। তিনি তরুণ সেনাধ্যক্ষ মুসা। সুলতান আবু আব্দুল্লাহর আত্ন-সমর্পণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, যখন দরবারে আমির-উমরাহ ও উপস্থিত বিশিষ্ট নাগরিক আত্নসমর্পণের পক্ষে মত দিচ্ছিল, তখন প্রতিবাদের জন্যে উঠে দাঁড়িয়ে এই তরুন সেনাধ্যক্ষ বলল, ‘শেষ পর্যন্ত শত্রুর সঙ্গে লড়াই করা হোক। দরকার হয়, তাদের বর্ষার মুখে গিয়ে আমরা আত্মহত্যা করব। যেখানে শত্রু সবচেয়ে প্রবল, সৈনিকদের সেখানে নিয়ে যেতে আমি প্রস্তুত। যারা বেঁচে থেকে গ্রানাডা নগরীকে শত্রু হস্তে অর্পণ করবে, তাদের মধ্যে গণ্য হওয়ার চেয়ে যারা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবন-পাত করবে, তাদের মধ্যে গন্য হওয়াকে আমি গৌরবের মনে করি।’ কিন্তু এই তরুণের প্রতিবাদ কোন কাজে আসেনি। সুলতান এবং দরবার আত্নসমর্পণেরই সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর গোটা দরবার শিশুর মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। শুধু কান্না ছিল না ওই তরুণ সেনাধ্যক্ষের চোখে। সে কান্নার রোলের মধ্যে উঠে দাঁড়াল সেই তরুণ আবার। উচ্চ কন্ঠে বলল, ‘জাতির প্রবীণ সর্দারবৃন্দ, অর্থহীন রোদন আর বিলাপ ছেলেদের ও অবলা নারীদের জন্যে রেখে দিন। আমরা পুরুষ। আমাদের অন্তর অশ্রু বর্ষণের জন্যে সৃষ্টি হয়নি, রক্ত বর্ষণের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে। আসুন আমরা স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করতে করতে বীরের মত আত্নবিসর্জন করি। গ্রানাডার উপর যে অন্যায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার প্রতিকারার্থে মৃত্যুকে বরণ করি। আমাদের মৃত দেহকে আচ্ছাদিত করার জন্যে যদি এক মুঠো মাটিও না জোটে, উদার অন্তহীন আকাশের কখনও অভাব হবে না।’ তরুণ সেনাধ্যক্ষ কথা শেষ করে থামল। সমগ্র দরবার নিরব, নিস্পন্দ। সুলতান আবু আবদুল্লাহ আগ্রহ ভরে দরবারের মুখগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। সাহস, শৌর্য ও আগ্রহের একটি কথাও বিশাল দরবারে একটি কন্ঠ থেকেও উচ্চারিত হল না। দূর্বল চিত্ত সুলতান আবু আবদুল্লাহ কাতর কন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তকদীরের বিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে লাভ নেই। তকদীরের ফলকে অতিস্পষ্টভাবেই লেখা আছে, আমার জীবন হতভাগ্যের জীবনেই পর্যবসিত হবে। সাম্রাজ্য আমার শাসনকালেই বিলুপ্ত হবে।’ অবশেষে আত্নসমর্পণের সিদ্ধান্ত যখন দরবারে চুড়ান্ত হয়ে গেল, আত্নসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষরের জন্যে সুলতানের কলম উত্তোলিত হলো, তখন তরুণ সেনাধ্যক্ষ মুসা ক্রোধ-কম্পিত কন্ঠে শেষবারের মত চিৎকার করে উঠল, ‘আপনারা নিজেদের প্রতারিত করবেন না। মনে ভাববেন না যে, খৃষ্টানেরা তাদের অঙ্গীকার পালন করবে। যে লাঞ্ছনা এবং বিপদ আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি, তার তুলনায় মৃত্যু তুচ্ছ ব্যাপার। আমাদেরই চোখের সামনে আমাদের এই প্রিয় নগরী লুন্ঠিত হবে, আমাদের মসজিদ, এবাদতগৃহ নিগৃহীত, অপমানিত হবে, আমাদের গৃহ-সংসার বিধ্বস্ত হবে, আমাদের স্ত্রী-কন্যারা উৎপীড়িত-ধর্ষিতা হবে। নিষ্ঠুর অত্যাচার, হৃদয়হীন অসহিষ্ণুতা, চাবুক এবং শৃঙ্খল, অন্ধকার কারাগৃহ, মৃত্যুর অগ্নিকুন্ড, ফাঁসির কাষ্ট, এ সবই আমাদের ভাগ্যে জুটবে, মৃত্যুর অগ্নিকুন্ড, ফাঁসির কাষ্ট, এ সবই আমাদের ভাগ্যে জুটবে, এ সবই আমাদের দেখতে হবে, এ সবই আমাদের সহ্য করতে হবে। অন্ততঃ এই সব হতভাগ্য কাপুরুষেরা এসব দেখবে- এখন যারা সম্মানজনক মৃত্যুকে বরণ করতে কুন্ঠিত। আমি নিজের কথা বলতে পারি, ইনশাআল্লাহ, আমার চোখ দিয়ে এসব কখনও দেখবে না।’ তরুণ সেনাধ্যক্ষ মুসা কথা শেষ করে বেরিয় এল দরবার থেকে। সে নেমে এল রাজপথে। কারও সাথে কথা বলল না, কারও দিকে তাকালোও না সে। ঘরে গিয়ে অস্ত্রে-শস্ত্রে নিজেকে সজ্জিত করল, আরোহন করল নিজের প্রিয় অশ্বে। তারপর গ্রানাডা নগরীর ‘এলভিরা’ নামক সিংহদ্বার অতিক্রম করে দৃঢ় পদক্ষেপে যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে চলল।’
থামল আহমদ মুসা। শেষ দিকে তার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠেছিল কান্নায়।
জোয়ান ও রবার্তো রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল অভূতপূর্ব কথাগুলো। তাদের চোখ, বিস্ফারিত, উজ্জ্বল।
‘তারপর।’ আহমদ মুসা থামার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল জোয়ান।
‘তারপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। ঘোড় সওয়ার মুসা ফার্ডিন্যান্ডের একটি সেনাদলের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আমৃত্যু লড়েছিল সে। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছিল তার দেহ। ভারি বর্ম আচ্ছাদিত মুমূর্ষ দেহ তার ডুবে গিয়েছিল সেনিলের পানিতে।’
আহমদ মুসা থামল। থেমেই আবার শুরু করল, গ্রানাডার দিকে তাকিয়ে সুলতান আবু আবদুল্লাহর আত্ম-সমর্পণ দৃশ্যের পাশাপাশি এই তরুণ সেনাধ্যক্ষের আত্ম-বিসর্জনের দৃশ্যই আমাকে বেশী অভিভূত করে।
আহমদ মুসা মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড়ের যে চত্তরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, সে চত্তরের এক পাশে পাহাড়ের শীর্ষ চূড়া, অন্য পাশে ছোট বড় চূড়ার দীর্ঘ সারি এগিয়ে গেছে পূর্ব দিকে। চত্তরের পাশেই দু’টি ছোট চূড়া পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। চূড়া দু’টির মাঝখানে দিয়ে সংকীর্ণ একটা পথ। সে পথটির মাথায় পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে দু’জন যুবক। ওরা চত্তরেই দাঁড়িয়েছিল, তিনজন অপরিচিত যুবক অর্থাৎ আহমদ মুসাদের চূড়ায় উঠতে দেখে তারা পাথরের আড়ালে সরে গেছে।
দু’জন যুবকের কারও বয়সই বাইশের বেশী নয়। চেহারা ও দেহের গড়ন আরবীয় কিন্তু দেহের রং ইউরোপীয়দের মত সাদা, চুল ও চোখ এশীয়দের মত কাল। যুবকদের একজনের চেহারা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, শরীরটাও অত্যন্ত সুগঠিত। নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখ, কিন্তু দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা বাজপাখীর মত। এই তরুণের নাম যিয়াদ বিন তারিক। কার্ডোভার বৃদ্ধ একেই স্পেনের নতুন ফ্যাল্কন নামে অভিহিত করেছে। তার সাথের যুবক আবদুল্লাহ তার সর্বক্ষণের সাথী।
যিয়াদ বিন তারিক গ্রানাডার এক পার্বত্য গ্রামের সর্দারের ছেলে। গ্রানাডার দক্ষিণ-পূর্বে সিয়েরা নিবেদা পর্বত শ্রেণীর দক্ষিণ ঢালে পশ্চিমে গোয়াদেল ফো এবং পূর্বে গোয়াদেলজ নদীর মাঝখানে বিশাল এক বনাঞ্চল। এই বিশাল এবং গভীর বনাঞ্চলেরই একটা গ্রামে বাস করে যিয়াদ বিন তারিকের পরিবার। দুর্গম বনাঞ্চলে এই জনবসতি গড়ে উঠার একটা ইতিহাস আছে। গ্রানাডার পতনের পর মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। জোর করে তাদের খৃষ্টান করা হয়, অথবা দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। বেশীর ভাগ বাঁচার জন্যে খৃষ্টান হওয়ার মহড়া দিল, অনেকে স্পেন থেকে পালিয়ে গেল। কিন্তু অনেকে খৃষ্টানও হলো না এবং স্পেন থেকে পালিয়েও গেল না। গ্রানাডা অঞ্চলের এরাই এসে আশ্রয় নিয়েছিল সিয়েরা নিবেদা দক্ষিণ ঢালের এই দুর্গম বনাঞ্চলে। যিয়াদ বিন তারিকের পরিবার তাদের উত্তরসুরীদেরই একটা অংশ। যিয়াদ বিন তারিক খৃষ্টান ছদ্মনাম নিয়ে গ্রানাডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়েছে। সবে সে বেরিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া কালেই যিয়াদ বিন তারিক ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’ নামে তরুণদের একটা গ্রুপ গঠন করে। প্রথম দিকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছদ্মবেশী মুসলিম তরুণরাই এর সদস্য ছিল। এর সদস্যপদ এখন ছাত্র-তরুণদের বাইরেও বিস্তৃত করা হয়েছে। ‘ব্রাদার্স ফর ক্রিসেন্ট’ এর সদস্যদের নিবেদা পার্বত্যঞ্চলে নিয়ে ট্রেনিং দেয়া হয়।
পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে যিয়াদ বিন তারিক এবং আবদুল্লাহ চত্তরে উঠে আসা নতুন আগন্তুক আহমদ মুসাদের উপর চোখ রেখেছিল। যিয়াদরা প্রথমে মনে করেছিল, আগন্তুকরা কোন খৃষ্টান ভ্রমনকারী হবে, তারা মুরের দীর্ঘশ্বাস পাহাড় এবং ‘দীর্ঘশ্বাস’ এর ঐতিহাসিক চত্তরটা দেখে আনন্দ করতে এসছে। কিন্তু আহমদ মুসার এশীয় চেহারা এবং মুখভাব দেখে তাদের চিন্তা প্রথম হোঁচট খায়। তারা দেখে আগন্তুকদের মুখে হাসি নেই, বরং গম্ভীর বেদনার্ত তাদের মুখ। তাদের মুখে কথাও নেই। কিন্তু তাদের হোঁচট খাওয়া চিন্তা বিস্ময়ে রূপান্ত্মরিত হয় যখন গ্রানাডার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা আহমদ মুসার চোখ থেকে অশ্রু গড়াতে তারা দেখে। তারপর যখন জোয়ানের সাথে আহমদ মুসার কথা শুরু হলো, যখন আহমদ মুসার কন্ঠ থেকে ফার্ডিন্যান্ডের কাছে আবু আবদুল্লাহর আত্মসমর্পণের বিষাদ -ছবি বেরিয়ে এল, যখন আহমদ মুসা তরুণ সেনাধ্যক্ষ মুসার বিরত্ব ও আত্মবিসর্জনের অভূতপূর্ব মর্মস্পর্শী কাহিনী বর্ণনা করল, তখন অভিভূত যিয়াদ বিন তারিক এবং আবদুল্লাহ আর অশ্রু রোধ করতে পারেনি। তাদের চোখ থেকে নেমে আসে অশ্রু অঝোর ধারায়। পবিত্র, জ্যোতির্ময় মুখের আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে যিয়াদ বিন তারিক কাঁদতে কাঁদতেই আব্দুল্লাহকে বলে, আবদুল্লাহ স্পেনের মুসলমানদের জন্যে এত দরদ তো কারও কন্ঠে শুনিনি, এত অশ্রু তো কারও চোখে দেখেনি, হতভাগ্য সেনাধ্যক্ষের এই কাহিনী তো কেউ কোনদিন এমনভাবে বলেনি। কে এই বিস্ময়কর বিদেশী যুবক আবদুল্লাহ। উঠ, চল যাই। এরপর লুকিয়ে থাকা পাপ হবে।’
বলে যিয়াদ বিন তারিক উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল আব্দুল্লাহ। তারা গিরীপথের দূরত্বটুকু অতিক্রম করে চত্তরের উপর দিয়ে এগোয়। তাদের দু’জনেরই চোখে অশ্রু, অশ্রুতে গন্ড ভেজা।
আহমদ মুসা ওদের দেখতে পেল। দেখতে পেল তাদের চোখের অশ্রুও। বিস্মিত আহমদ মুসা কিছু বলার আগেই যিয়াদ বিন তারিক সোজা এসে আহমদ মুসাকে বলল, ‘কে আপনি বিদেশী ভাই?’
আহমদ মুসা তাকে নরম কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুমি কে ভাই।’
‘আমি যিয়াদ বিন তারিক।’ বলল আগন্তুক যুবকটি।
‘তুমি যিয়াদ বিন তারিক।’ বলে আহমদ মুসা জড়িয়ে ধরল যিয়াদকে। বলল, ‘আমি তোমার খোঁজেই এখানে এসেছি।’
‘আপনি কে তা কিন্তু বলেননি? আপনার পরিচয়ের জন্যেই আমরা আড়াল থেকে ছুটে এসেছি।’ বলল যিয়াদ।
এগিয়ে এল রবার্তো। আহমদ মুসা ও যিয়াদ বিন তারিকের সামনে এসে যিয়াদকে বলল, ‘যার পরিচয় লাভের জন্যে ছুটে এসেছেন, তিনি আহমদ মুসা।
‘আহমদ মুসা!’ বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলল যিয়াদ।
‘হ্যাঁ, সেই বহু বিপ্লবের নেতা আহমদ মুসা।’
মুখ দিয়ে কোন কথা সরলো না যিয়াদ বিন বিন তারিকের। সে এবং আবদুল্লাহ বিস্ময়-বিস্ফারিত অপলক চোখে তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। তারা মুর্তির মত স্থির হয়ে গেছে। কিন্তু অন্তরে তাদের ঝড় বইছে। যাকে নিয়ে তাদের আকাশ স্পর্শী গর্ব, যাকে ঘিরে তাদের হাজারো স্বপ্ন, যিনি কিংবদন্তীর মত মুখে মুখে উচ্চারিত, সেই আহমদ মুসা তাদের সামনে!
আহমদ মুসা যিয়াদ বিন তারিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বিস্মিত হচ্ছ? কেন আমি আসতে পারি না? এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষ যায় না?’
যিয়াদ আহমদ মুসাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘চোখকে যে বিশ্বাস হচ্ছে না! আল্লাহ আপনাকে স্পেনে আনবেন, এইভাবে আপনাকে পাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হবে, এ যে আকাশ-কুসুম কল্পনা আমাদের জন্যে। বিশ্বের মুসলমানরা যে আমাদের কথা ভুলেই গেছে, আমাদের তারা বাদ দিয়ে রেখেছে তাদের তালিকা থেকে।’
আহমদ মুসা যিয়াদের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘না বিশ্বের মুসলমানরা তোমাদের ভোলেনি। মাদ্রিদের শাহ ফয়সাল মসজিদ কমপ্লেক্স- এর কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?’
এই দান এসেছে শত শত বছর পরে। বলল যিয়াদ।
তোমার কথা ঠিক যিয়াদ কিন্তু তোমাকে একটা বিষয় স্বীকার করতে হবে। ইসলামী বিশ্বের দূর্ভাগ্য শুরু হবার পর স্পেনের দূর্ভাগ্যের সূত্রপাত। সমগ্র উত্তর আফ্রিকা তখন খন্ড-বিখন্ড এবং পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত। সুতরাং সাহায্য যেখান থেকে সবচেয়ে সহজে আসতে পারতো, সেখান থেকে আসতে পারেনি। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে তখন তুর্কি সাম্রাজ্য শক্তিশালী, কিন্তু সাগর পাড়ি দিয়ে স্পেনে পৌছা তার সামর্থ্যের বাইরে ছিল।
জানি জনাব, আমি স্পেনের দূর্ভাগা মুসলমানদের একটা আবেগের কথা বলেছি। তাদের কেউ সাহায্য করতে না পারুক, তাদের উপর শতাব্দীর পর শতাব্দী থেকে যা ঘটে আসছে, তার কোন প্রতিবাদও মুসলিম বিশ্বের কোথাও থেকে উত্থিত হয়নি। কারও চোখ থেকে অশ্রুও ঝরেনি। বলল, যিয়াদ।
এই আবেগকে আমি শ্রদ্ধা করি যিয়াদ এবং মুসলিম শক্তিগুলোর ব্যর্থতাকেও আমি স্বীকার করি। তুর্কি সাম্রাজ্যে খৃষ্টান প্রাজারা মুসলমান প্রজাদের চেয়ে বেশী সুবিধা ভোগ করছে, কিন্তু তারপরও তুর্কি সাম্রাজ্যের খৃষ্টান প্রজাদের কাল্পনিক দুঃখ-দুর্দশার শ্লোগান তুলে ইউরোপীয় খৃস্টান শক্তিগুলো চিৎকার করেছে, কিন্তু মুসলিম শক্তিগুলো মুসলমানদের উপর জলজ্যান্ত খৃস্টান নির্যাতনের বিরুদ্ধে টু-শব্দটিও করেনি। এর জন্যে আফসোস করে কোন লাভ নেই। সে সময় প্রকৃত অর্থে অনেক জায়গায় মুসলমানরা ক্ষমতায় থাকলেও ইসলাম ক্ষমতায় ছিল না। আহমদ মুসা থামল।
ধন্যবাদ জনাব। অতীতের জন্য কোন ক্ষোভ নেই, কোন দুঃখ নেই এখন আর। আজ আপনাকে পেয়ে সব যেন শেষ হয়ে গেছে, সব ক্ষতির পূরণ হয়েছে।
একটু থামল যিয়াদ। রুমাল দিয়ে চোখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বলল, এখনও আমার কাছে স্বপ্নই মনে হচ্ছে যে, আমি আহমদ মুসার সামনে দাঁড়িয়ে। ভয় হচ্ছে স্বপ্ন না ভেঙ্গে যায়। কিভাবে আপনি হঠাৎ এখানে হাজির হলেন? যিয়াদের কথাগুলো শেষের দিকে আবেগে ভারি হয়ে উঠেছিল।
হঠাৎ নয় অনেক ঘটনা পাড়ি দিয়ে আমি তোমার এখানে পৌঁছেছি। ইতোমধ্যে দু’বার আমি ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর হাতে পড়েছি, অনেক ঘটনা ঘটেছে।
ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এর হাতে দু’বার বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলল যিয়াদ।
তোমাদের মাদ্রিদ বিমান বন্দরে পা দিয়েই প্রথমবার।
তারপর?
বলব সব কাহিনী।
আমরা খুব খুশী হবো। আচ্ছা বলুন, আমার নাম জানলেন কি করে, আর আমাদের খোঁজে এই স্থানেই বা এলেন কি করে?
আহমদ মুসা কর্ডোভার গোয়াদেল কুইভার ব্রীজের সেই বৃদ্ধের সব কাহিনী শোনাল।
সব শুনে যিয়াদ বলল, হ্যাঁ, বৃদ্ধ আমার সব কথা জানে। ছাত্র জীবন থেকেই এই বৃদ্ধকে আমি দেখছি, তখন থেকেই তার সাথে আমার পরিচয়। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ আজ হতাশ বটে, কিন্তু তার ভেতরে আগুন আছে, সে আগুন আমার পথকেও অনেক খানি আলোকিত করেছে।
বৃদ্ধ আমার কাছে মুসলিম স্পেনের প্রতিকৃতি।
একটু ভেবে যিয়াদ বলল, ঠিক বলেছেন। স্পেনের মুসলমানরা সর্বস্ব হারিয়েছে, সেও। স্পেনের মুসলমানরা যেমন হতাশ, বৃদ্ধও তেমনি। লাঞ্ছনা-গঞ্জনা যেমন স্পেনের মুসলমানদের প্রতিদিনের সাথী, তেমনি তারও।
আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, নামাজ সেরে নিয়ে আমরা ফিরতে পারি। বলল, যিয়াদের সাথী আব্দুল্লাহ।
যিয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক বলেছ। নামাজের সময়ও হয়ে গেছে।
নামাজের জন্য সবাই প্রস্তুত হলো।
আহমদ মুসা ইমামের জায়গায় যিয়াদকে ঠেলে দিল। যিয়াদ দ্রুত পেছনে সরে এসে বলল, অসম্ভব, আমি ঐ জায়গায় দাঁড়াতে পারিনা। আপনি আমাদের ইমাম সব ক্ষেত্রের জন্যেই।
নামাজ শেষে আহমদ মুসা ফিরে বসল। যিয়াদ বলল, এখান থেকে দুই মাইল পূর্বে পাহাড়ের এক গুহায় আমাদের একটা আস্তানা। ওটা আমাদের একটা বিশ্রাম কেন্দ্র। কিন্তু আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে চাই সিয়েরা নিবেদার বনাঞ্চলে আমাদের আসল ঘাঁটিতে। এই ঐতিহাসিক বনাঞ্চলই ছিল ফ্যালকন অব স্পেন বশীর বিন মুগীরার কর্মক্ষেত্র।
আহমদ মুসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, খুব আনন্দের হবে এই সফর, তোমাদের ব্যবস্থাদিও দেখতে পাব। কিন্তু যিয়াদ, খুব বেশী সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। আমি যে বড় কাজটি নিয়ে এখানে এসেছি তাতে এখনও হাত দেয়াই হয়নি।
কি সেটা? সাগ্রহে প্রশ্ন করল যিয়াদ।
বলব তোমাকে? ভয়াবহ ষড়যন্ত্র এঁটেছে ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান।
চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠল যিয়াদের এবং সকলের। যে ষড়যন্ত্রকে স্বয়ং আহমদ মুসা ভয়াবহ বলে এবং যার জন্যে সে নিজে স্পেনে এসেছে সেটা নিশ্চয় খুব বড় ব্যাপার তা সকলেই হৃদয় নিয়ে অনুভব করল। সকলেই গম্ভীর হয়ে গেল।
‘বন্দর নগরী মিত্রালীতেও আমাদের একটা ঘাঁটি আছে। ওখানেই আমরা আপাততঃ যেতে পারতাম, তারপর কোন সুযোগে না হয় নিবেদায় যেতাম। কিন্তু আমাদের এক কর্মীর সামান্য এক ভুলের কারণে ঘাঁটিটি সরকারের চোখে পড়ে গেছে। আজ সকালে খবর পেয়েছি ব্যাপারটা ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানও জেনে ফেলেছে। গত সন্ধ্যা থেকেই মাথা মুন্ডিত কে একজন বাড়িটার উপর চোখ রেখেছে। আমার আম্মা অসুস্থ। আমার আম্মা ও স্ত্রী ওখানেই আছেন। আমি সকালেই জানিয়ে দিয়েছি তাদেরকে সকালের মধ্যেই নিবেদায় নিয়ে যেতে। সুতরাং সেখানে আমাদের যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। বলল, যিয়াদ।
আমি তোমাদের নিবেদায় যাব, তুমি নিষেধ করলেও আমাকে যেতেই হবে বদর বিন মুগীরা আর যিয়াদ বিন তারিকের স্বাধীন সাম্রাজ্যে। কিন্তু যিয়াদ আমি ভাবছি ক্লু-ক্লাক্স-ক্লানের নজরে যদি পড়েই থাকে তোমাদের ঘাঁটি, তাহলে কি তোমার পরিবার নিরাপদে সরতে পারবে?
দিনের বেলা, লোকজনও আমাদের আছে। অসুবিধা হবে না জনাব। বলল যিয়াদ।
আহমদ মুসার মন থেকে অস্বস্থি গেল না। উঠে দাঁড়াল সে। বলল, আমরা তাহলে এখন যাত্রা শুরু করতে পারি।
উঠে দাঁড়াল সকলে।
আহমদ মুসা যাবার আগে আরেকবার গ্রানাডার দিকে তাকাল। তার পাশে যিয়াদ।
আহমদ মুসা আনমনা হয়ে গিয়েছিল গ্রানাডার দিকে তাকিয়ে।
যিয়াদও তাকিয়েছিল গ্রানাডার দিকে। গ্রানাডা যিয়াদের আবাল্য পরিচিত। কিন্তু আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রানাডাকে তার আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম লাগছে। মনে হচ্ছে এ তার পরিচিত গ্রানাডা নয়, ইসলামের, মুসলমানদের, তাহলে কি তিনি এই সাম্রাজ্যের চাবী ঐভাবে ফার্ডিন্যান্ডের হাতে তুলে দিতে পারতেন? পারতেন না। পেরেছেন কারণ, সাম্রাজ্যটা তার ব্যক্তিগত ছিল, ইসলামের নয়, মুসলমানদের নয়। অন্যদিকে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা এই সাম্রাজ্য দখল করেছিল তাদের ধর্মের নামে, সৈন্যেরা যুদ্ধও করেছিল তাদের ধর্মের জন্য। গ্রানাডার দূর্গশীর্ষে প্রথম উঠেছিল ক্রস। এই ক্রস উত্তোলিত করেছিলেন তাদের দেশের ধর্মগুরু। ক্রসের পর উত্তোলিত হয়েছিল রাজার পতাকা। যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে গ্রানাডার নিকটে ভেগা প্রান্তরে রানী ইসাবেলার নির্দেশে একটি সুন্দর নগরী নির্মিত হয়। সকলে বলেছিল এ নগরীর নাম ইসাবেলা রাখা হোক। কিন্তু রানী তা করেননি। ঐতিহাসিক আন্টিনিও আগানিতা বলেছেন, ধর্মপ্রাণ দেশবাসী যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই নগরীর সৃষ্টি সেই উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখবার জন্যে নগরীর নাম সান্টা ফে অর্থাৎ পবিত্র ধর্মের নগরী রাখলেন। এই ধরনের গভীর ধর্মনিষ্ট মানসিকতা সুলতান আবু আব্দুল্লাহর ছিল না, তার বাহিনীর ছিল না এবং তখনকার গ্রানাডাবাসীরও ছিল না। অর্থাৎ তুমি বলতে পার যিয়াদ, ৭১১ খৃস্টাব্দে তারিক বিন যিয়াদ এবং মুসা বিন নুসায়ের ইসলামের যে পতাকা নিয়ে স্পেন জয় করেছিলেন, সেই পতাকা পরে ভূ-লন্ঠিত হয় এবং তার জায়গায় ওঠে ব্যক্তির পতাকা, গোষ্ঠীর পতাকা। তুমি হয়তো জান যিয়াদ, স্পেনে তৃতীয় আব্দুর রহমানের মত হুসিয়ারী লোকও তাঁর পাশে মহিষী জোহরার নাম অক্ষয় করে রাখার জন্য কর্ডোভার পাশে আজ-জোহরা নামক এক উপনগরী নির্মাণে এমনই মশগুল হয়ে পড়েছিলেন যে, পরপর তিন শুক্রবার তিনি জুম্মার জামায়াতে হাজির হতে পারেননি, যার জন্য প্রচন্ড ধমক খেতে হয়েছিল তাকে ইমামের কাছে।’
শত শত বছর আগের আবু আব্দুল্লাহর গ্রানাডা যেন জীবন্ত হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যিয়াদের মুখ ফেটেই যেন একটা প্রশ্ন বেরিয়ে এল, ‘গ্রানাডার কেন পতন হয়েছিল, আপনার উল্লেখিত সেই সেনাধ্যক্ষ মুসার আবেদন কেন কন কাজে আসেনি, কেন পরাজিত হয়েছিলো মুসলমানরা মুসা ভাই?’
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিল না। পরে একটু ম্লান হাসল। তারপর ধীর কন্ঠে শুরু করল, ‘এই চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে গ্রানাডার দিকে তাকিয়ে সুলতান আবু আবদুল্লাহ যখন শিশুর মত কাঁদছিল, তখন সুলতানের মা বীর নারী আয়েশাতুল হুররা কি বলেছিলেন জান? বলেছিলেন, ‘যে রাজ্য পুরুষের মত তুমি রক্ষা করতে পারনি, তার জন্যে নারীর মত অশ্রু বিসর্জন তোমারই শোভা পায়।’ অন্য দিকে আল হামরা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসে আবু আবদুল্লাহ খৃষ্টান সেনাপতিকে যখন প্রাসাদে ঢুকার পথ করে দিয়েছিলেন, দূর্গশীর্ষে পতাকা উত্তোলনের জন্যে, তখন তিনি অর্থাৎ আবু আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘সেনাপতি যান, দূর্গ আপনি হস্তগত করুন। এ বৈভব আল্লাহ আপনার শক্তিশালী প্রভূকে অর্পণ করেছেন মুরদের পাপের শাস্তির জন্যে।’ এই দুই উক্তির মধ্যে তিনটি কারণ আমরা দেখি, এক, রাজ্য রক্ষাই তখন শাসকদের কাছে ছিল মুখ্য, মুসলিম কিংবা মুসলমানদের ধর্ম রক্ষা নয়। দুই, রাজ্য রক্ষার মত পৌরুষ শাসকদের ছিল না। তিন, পরাজয় ছিল শাসকদের পাপের শাস্তি। প্রথম কারণটিই মূল কারণ। মূল কারণ থেকে শেষের দু’টি কারণ সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানদের রক্ষা ইসলাম রক্ষা যদি শাসকদের লক্ষ্য হতো, তাহলে তাদের মধ্যে বিভেদ ষড়যন্ত্রের জায়গায় ঐক্য এবং দূর্বলতার বদলে পৌরুষ সৃষ্টি হতো, ভোগ সর্বস্বতা ও পাপাচার দূরে সরে যেত এবং তাদের পরাজয় ঘটত না। ভেবে দেখ যিয়াদ, সুলতান আবু আবদুল্লাহ যদি মনে করতেন এই গ্রানাডা, এই কর্ডোভা, এই সাম্রাজ্য তার নয়।’
থামল আহমদ মুসা।
তারপর আহমদ মুসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা তো চলতে পারি।
‘আহমদ মুসা ভাই, সুলতান আবু আবদুল্লাহ তাহলে ঠিকই বলেছিল, খৃষ্টান ফার্ডিন্যান্ড ও রানী ইসাবেলার কাছে মুসলিম স্পেনের আত্মসমর্পণ মুরদের পাপেরই কথা।’ বলল যিয়াদ।
বলতে বলতে সামনে পা বাড়াল যিয়াদ বিন তারিক। আহমদ মুসাও হাঁটতে শুরু করেছিল। বলল, ‘অবশ্যই। তবে এই পাপ স্পেনের জনতার ছিল না, মুসা, বদর বিন মুগীরা, প্রমুখ ছিলেন এঁদেরই প্রতিনিধি। কিন্তু দায়ী তারা না হলেও পাপের মাশুল তাদেরকেই দিতে হয়েছে ষোল আনা।’
‘কেন মুসা ভাই, এমনটি হলো কেন, শাসকদের পাপের জন্যে নিরপরাধ মুসলমানরা মার খেল কেন?’ বলল জোয়ান।
‘এটাই নিয়ম জোয়ান। পাইলটের দোষে প্লেন ক্রাশ হলে নিরপরাধ যাত্রীরাও বাঁচে না। স্পেনের মুসলিম প্রজাদের দায়িত্ব শুধু খাজনা দেয়া ছিল না, রাজাকে সংশোধন করা, ঠিক পথে চালনা করা, রাজার সমালোচনা করা, ইত্যাদি তাদেরই দায়িত্ব ছিল। তারা সে দায়িত্ব পালন করেনি।’
‘দুনিয়ার অনেক দেশের মুসলমানরা এমন দোষে দোষী, কিন্তু স্পেনের মুসলমানদের ভুলের মাশুল হয়েছে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ ভারী কন্ঠে বলল রবার্তো।
‘ঠিক বলেছ ভাই।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল আহমদ মুসা।
চত্ত্বর থেকে তারা নেমে এল পাহাড়ের গায়ে। তারা পাঁচজন পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে লাগল ধীরে ধীরে।
পাঁচজনের এ মিছিলের সারিতে প্রথমে আহমদ মুসা, তারপর যিয়াদ বিন তারিক। পরে ওরা তিনজন- আবদুল্লাহ, জোয়ান ও রবার্তো।