কবি মধুসূদন শেষ জীবনে কৃতকর্মের ফলে শোচনীয় ভাবে মরণ বরণ করেছিলেন। জনৈক সহৃদয় বান্ধব স্বীয় লাইব্রেরির গৃহে পীড়িত কবি, তার পত্নী এবং ছেলেপেলেগুলিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সাহায্য করে করে সবাই সরে গেছে। আর এখন কেউ সাহায্য করে না। সেবাকারিনী যখন ঔষধ-পথ্য নিয়ে তার পত্নীর কাছে উপস্থিত হলেন, মহৎ হৃদয় প্রেমিকা পত্নী বললেন–আমার জন্যে কোনো সেবাযত্নের প্রয়োজন নাই–আমার স্বামীর জীবন রক্ষা করুন। এই কথা বলেই তিনি প্রাণত্যাগ করলেন।
০৬-১০. বাঁধন হারা
০৬. বাঁধন হারা
এক শ্রেণীর যুবক আছে। তারা খুব যে বড়লোক তা নয়। এমন কি তাদের পিতা-মাতা হয়তো খুব কষ্ট করেই সংসার চালাচ্ছেন, পরিবারস্থ নির্ভরশীলদের অন্ন-বস্ত্র দিচ্ছেন। এইসব পরিবারের দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবকেরা সিঁথি কেটে, ছেঁড়া কাপড়খানি কুঁচিয়ে ছিন্নপথ ঢেকে, পথে পথে দলবদ্ধ হয়ে, বাড়ি বাড়ি খেলা করে, গল্প করে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। খাবার সময় খেতে আসে, বাকি সময় ইয়ার্কি দিয়ে বেড়ায়, তাস খেলা, জটলা বেঁধে বেড়ান এদের কাজ।
সংসারের কোনো ধার এরা ধারে না। উপায় উপার্জনের কোনো চেষ্টা নাই। যেন পরম নির্ভরশীল সাধু দরবেশ! ভবিষ্যৎ চিন্তা এদের মোটেই নাই।
পরস্পরে এদের বন্ধুত্ব খুব বেশি–একজন আর একজনের জন্য প্রাণ দিতে পারে।
পিতা-মাতার ভর্ৎসনা, কোনো গুরুজনের উপদেশ, এদেরকে সজাগ সতর্ক করে না। বৃদ্ধ তার পীড়িত পিতা এদের সঙ্গে পেরে ওঠেন না। মা কথা বলে ছেলের কাছে অপমানিতা হন। এরা লেখাপড়া বিষ চোখে দেখে।
এইসব যুবকের ভবিষ্যৎ যে কত ভয়ানক তা বলা যায় না। চিরদিন এ সুখের দিন থাকে না, ক্রমশ দুঃখের দিন ঘনিয়ে আসে। পিতা-মাতার অন্তর্ধানে সংসারের সু-কঠিন চাপে এদের দুর্দশার সীমা থাকে না–তখন ঘোর অনুতাপ ও মর্ম যন্ত্রণায় এরা অস্থির হয়ে ওঠে–কিন্তু সে অনুতাপ ও অস্থিরতায় কোনো লাভ হয় না। বড় বড় শহরে এই শ্রেণীর যুবকেরা বাড়ি ঘর ছেড়ে চুরি, লাম্পট্য, জুয়াচুরি এবং অতি মন্দ পথ অবলম্বন করে। ক্রমশ এইভাবে কিছুকাল চলতে থাকে, কেউ জেলে যায়। এদের যতই আঘাত করা যায়, ততই এরা যেন ভয়ানক এবং হিংস্র হতে থাকে।
আলস্যে যৌবন কাটিয়ে দিলে জীবনে দুঃখের অন্ত থাকে না। যদি লেখাপড়া না হয়ে থাকে, তবে অনুতপ্ত হও, কুসঙ্গ ত্যাগ কর। আকাশ ভেঙ্গে গুড়ো করবো, পাহাড় ভাঙ্গবো–এইসব আস্ফালন ত্যাগ কর। কোনো শিল্প শিক্ষা কর, তাহলে জীবনে সুখী হতে পারবে। ইতর লোকদের হাতে বহু লাভজনক শিল্প আটকা পড়ে আছে। সেগুলি যদি ভদ্র সন্তানেরা নিজ হাতে গ্রহণ করে, তবে অর্থের অভাব থাকবে না।
নীচ-হীন পন্থা, চুরি, দুষ্কার্য, প্রতারণা, ছলনা, ঘুষ, পল্লী গ্রামের লোকদের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে, নারী বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা বড়ই ঘৃণিত কথা। যদি শরীরে শক্তি থাকে, তবে কৃষি কাজও করতে পার। বন্ধুদের সঙ্গ লাভে জীবনটা নষ্ট করো না। বিপদকালে কোনো বন্ধু তোমার কাছে আসবে না। পরম আত্মীয় যারা, তারাই তোমার দুঃখ-বিপদের সময় সহায় হবে। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে জীবনকে মূল্যবান করে গড়ে তুলতে চেষ্টা কর। কাজে লেগে যাও। কারো সঙ্গে জল্পনা কল্পনা, পরামর্শ করে সময় নষ্ট করো না–কাজে লেগে যাও। পথে পথে ঘুরে বেড়ান, সংসারের কোনো ধার না ধারা, গুরুজনদের অবাধ্য হওয়া, গুরুজনদের সঙ্গে তর্ক করা, এসব বড়ই খারাপ।
যৌবনকালে ছেলেরা কুসঙ্গে পড়ে নেশা করতে শেখে। শহরের ছেলে হলে এমন কি বেশ্যাবাড়ী যেতে শেখে। যুবকেরা গুরুজনের অগোচরে সর্বনাশের পথে হাঁটে। একবার পাপের পথে যাওয়া আরম্ভ করলে সেই অভ্যাস আর কাটে না। এক নারী ছেড়ে আর এক নারী, এক বেশ্যা ছেড়ে আর এক বেশ্যার কাছে যেতে প্রাণ চায়! বেশ্যাদের ব্যাধিপূর্ণ শরীরের সংস্রবে এসে সোনার শরীর ধ্বংস হয়–গণোরিয়া, উপদংশ প্রভৃতি পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাতে হয়! দূর থেকে মনে হয় বেশ্যাদের কাছে যেন কী স্বর্গীয় বস্তু আছে–কিন্তু অমন সর্বনেশে ভয়ানক বিপদ-উৎস আর নাই। দূর থেকে বেশ্যাদের রূপ, আগুন মনে করে পালিয়ে আসবে।
কতগুলি যুবক মনে করে, চাকরি করলে জীবনের হীনতা প্রকাশ পায়। সেবার দ্বারা জগৎ চলবে। যে কোনো চাকরি কর–উপরের কর্মচারীকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি কর। চাকরিতে কখনও জীবনের হীনতা মনে কারো না। তুমি সামান্য চাকরি করেও যদি ঐখানে তোমার কর্তব্য পালন করতে পার, তা হলে তুমি মহৎ এবং শ্রেষ্ঠ বলে গণিত হবে। ইতালীর যে নগরদ্বয় আগ্নেয়গিরির ভস্মপাতে ধ্বংস হয়েছিল, সেই ভস্ম মধ্যে অনেককাল পরে দেখা গিয়াছিল, এক কর্তব্যনিষ্ঠা সৈনিক বন্দুক হস্তে শেষ পর্যন্ত আপন কর্তব্য পালন করে জীবন দিয়েছেন। তিনি সামান্য সৈনিক হয়েও মহৎ এবং নমস্য।
একজন সামান্য পিয়ন হয়েও তুমি জীবনের মহত্ত্ব বজায় রাখতে পার। উপরের কর্মচারীর অবাধ্য হওয়া, তাকে অশ্রদ্ধা করা প্রকৃত সজ্জন ব্যক্তির কার্য নহে। যুবকদের মনে অবাধ্যতা, ঔদ্ধত্য একটা বিশেষ আদরের জিনিস।
অপরিচিত গুরুজন, বয়োজ্যেষ্ঠ নরনারীকে ‘তুই তুই’ করে কথা বলা, হঠাৎ ক্রুদ্ধ হয়ে দুর্বল নর-নারীকে অপমান করা, প্রহার করা বড়ই অসভ্যতা। যৌবনকালেই অধিকতর বিনয়ী, সভ্য ও ভদ্র হওয়া উচিত। গায়ের জোর চিরদিন সমান থাকে না। যৌবন-শক্তি দুর্বলকে রক্ষা করে, সাহায্য করে সার্থক ও সুন্দর হয়। মারামারি ও অত্যাচারে যদি যুবকের ঐ মুষ্টির অপব্যবহার হয়, তাতে ঈশ্বরের দানের ঘোর অপচয় হয়–যুবকেরা তা বিশ্বাস করবে কি?