- বইয়ের নামঃ মানব জীবন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ শিক্ষা জগৎ
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১-০৫. মানব-চিত্তের তৃপ্তি
০১. মানব–চিত্তের তৃপ্তি
মানব-চিত্তের তৃপ্তি অর্থ, প্রাধান্য; ক্ষমতা এবং রাজ্যলাভে নাই। আলেকজাণ্ডার সমস্ত জগৎ জয় করেও শান্তি লাভ করেন নাই। মানুষ অর্থের পেছনে ছুটছে–অপরিমিত অর্থ দাও তাকে, সে আরও চাবে। তার মনে হয় আরও পেলে সুখী হবে। সমস্ত জগৎ তাকে দাও : তবুও সে সুখী হবে না। জাগতিকভাবে যারা অন্ধ, তারাই জীবনে সুখ এইভাবে খোঁজে। দরিদ্র যে, সে আমার জীবন ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে ঈর্ষা করছে, সে আমার অবস্থার দিকে কত উৎসুকনেত্রে তাকিয়ে থাকে কিন্তু আমি নিজে কত অসুখী। পরম সত্যের সন্ধান যারা পায় নাই, মানব-হৃদয়ের ধর্ম কি, তা যারা বুঝতে পারে নাই–তারাই এইভাবে জ্বলে-পুড়ে মরে, এমন কি এই শ্রেণীর লোক যতই মৃত্যুর পথে অগ্রসর হতে থাকে, ততই এদের জীবনের জ্বালা বাড়ে। প্রতিহিংসা-বৃত্তি, বিবাদ, অর্থ-লোভ আরও তীব্রভাবে তাদেরকে মত্ত ও মুগ্ধ করে। তখনও তারা যথার্থ কল্যাণের পথ কী, তা অনুভব করতে পারে না। জীবন ভরে যেমন করে সুখের সন্ধানে এরা ছুটেছে, মৃত্যুর অব্যবহিত পরেও তেমনি তারা সুখের সন্ধান করে–পায় না, এই পথে মানুষ সুখ পাবে না। ক্রোধে তারা চিৎকার করে মানুষকে তারা দংশন করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের দুখী, আহত-ব্যথিত মন নিজের দেহ এবং পরের অন্তরকে বিষাক্ত করে। বলতে কী, মানুষ জাগতিক কোনো সাধনায় সুখ, আনন্দ এবং তৃপ্তি পাবে না। এই পথ থেকে মানুষকে ফিরতে বলি; সমস্ত মহাপুরুষই এই কথা বলেছেন। মানুষ তার জীবনকে অনুভব করতে পারে নাই; শয়তান মানুষ–চিত্তকে ধর্মের নামে ভ্ৰমান্ধ করেছে।
সত্যের সাধনাই মানব হৃদয়ের চরম ও পরম সাধনা। পরম সত্যকে দিনে দিনে জীবনের প্রতি কাজের ভিতর দিয়ে অনুভব করাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সাধনা। কত বিচিত্রভাবে তাকে অনুভব করতে হবে তার ইয়ত্তা নাই। যিনি যতটুকু এই পরম সত্যকে অনুভব করতে পেরেছেন তিনি তত বড় সাধক, সন্ন্যাসী এবং ফকির। জগতে যা কিছু কর, যত কাজেই যোগ দাও, পরিবার প্রতিপালন কর, শিশুর মুখে চুম্বন দাও–মানব-চিত্তের এই একমাত্র গুরুতর সাধনা ও আকাক্ষা এর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন রয়েছে। সত্যময় আল্লাহতায়ালাকে হৃদয়ে ধারণ করা, তাতে মিশে যাওয়া, আল্লাহময় হয়ে যাওয়া–সর্বপ্রকারের সত্য, সুন্দর, মধুর ও পূর্ণ হয়ে ওঠা–এই-ই চরম এবাদত।
আত্মার এই সিদ্ধির জন্যই ধর্মের যাবতীয় বিধি-বন্ধনে মত্ত থাকলে এবং তাকেই চরম মনে করলে মানবাত্মা বিনষ্ট হবেই!’হাজার নিয়ম পালন ও রোজা উপাসনায় তাকে উন্নত ও উজ্জ্বল করতে পারবে না। জীবনকে আল্লাহর রঙে রঙিন করে তুলতে হবে, সমস্ত চিন্তা, কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে সেই সত্য সুন্দর ও সুমহানের গুণকে প্রকাশ করতে হবে।
.
০২. আল্লাহ্
বহুদিন আগে এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম–’আল্লাহ্ কী? তিনি বললেন, আল্লাহ অনন্ত–তাঁকে কেউ জানে না।’
‘আল্লাহ’র এই ব্যাখ্যা মানুষের পক্ষে বিন্দুমাত্র আশার কথা নহে। ‘আল্লাহ্ অনন্ত’ শুনে আমাদের মন বিন্দুমাত্র বিচলিত ও চঞ্চল হয় না। এই ব্যাখ্যা ব্যাখ্যাই নয়। বস্তুত আরও অনেকে আল্লাহর ব্যাখ্যা অনেক কথায় দিয়ে থাকেন, তাতে আল্লাহর পরিচয় মানুষ একটুও। পায় না-মানুষ বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে ওঠে।
এই জগৎ, এই অনন্ত সৃষ্টি, অনন্ত জীবনের উৎস যিনি আছেন এবং থাকবেন–যিনি চিরসত্য, যিনি সর্বব্যাপী, যিনি আমাতে আছেন, যিনি আমাকে ভালবাসেন, প্রেম করেন, আমার সঙ্গে খেলা করেন, পথে পথে ঘুরে বেড়ান, আকাশে যার বাঁশি বাজে, হাম্বারবে যার অফুরন্ত প্রেম উছলে উঠে, যিনি মাতৃহারা শিশুর আর্তকণ্ঠে বিশ্বকে মা বলে ডাকেন–আমি। তাঁকে দেখতে চাই, পেতে চাই, হৃদয়ে ধারণ করতে চাই।–ঝড়ের দোলায় তার ভীষণ হাস্য বাজে, বজ্রনিনাদে তার শঙ্কা ধ্বনিত হয়।অনন্ত সৃষ্টি তিনি বুকে ধারণ করে আছেন, তিনি নর-নারীর অঙ্গশ্রীতে লীলায়িত হন, গানের সুরে তিনি ক্রন্দন করেন–সেই অশ্রুর দেবতাকে আমি দেখতে চাই–অনন্ত আকাশে, নিথর রাতে তার ক্রন্দন শুনেছি, মুগ্ধ নির্জন প্রান্তরে তাঁর শোক বাতাসে বয়ে এনেছে, তাকে পাবার জন্যে মানব-চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ছুটছে। আমি তাকে পেতে চাই, তাঁকে চুম্বন করতে চাই। মানব-চিত্তের চির-প্রেয়সীর অঞ্চল ধরে অনন্ত সোহাগে আমি বাসরের আনন্দ অনুভব করতে চাই।
‘আল্লাহ’ কী? তাঁর কোনো সিংহাসন নাই, কোনো আসন নাই, রূপ নাই–অন্তরের সঙ্গে তিনি মিশে আছেন। সুন্দর, কল্যাণ এবং সত্যে তিনি আছেন। তোষামোদে তাঁকে পাওয়া যাবে না। তিনি আছেন ত্যাগে, সহিষ্ণুতায় এবং প্রেমে! তিনি রূপমুক্ত প্রেম, কল্যাণ এবং জীবন্ত সত্য। মনুষ্য যখন অন্যায়ভাবে আঘাত পেয়ে আঘাতকারীকে আশীর্বাদ করেছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। অসত্য ও অন্যায় দেখে মনুষ্য যখন লজ্জিত ও মর্মাহত হয়েছে, তখনই আমি তার রূপ দেখেছি। মনুষ্য যখন মনুষ্যের জন্য আঁখিজল ফেলেছে, তখনই আমি তাকে দেখেছি। জননী যখন শিশুকে বুকে ধরেছেন, তখনই আমি তাকে দেখেছি। বন্য পশু যখন সন্তানের স্নেহে ব্যাকুল অস্থির হয়ে গর্জে ছুটেছে, তখনই সেই রূপহীনকে আমি চোখের জলে দেখেছি। হে রূপহীন! তুমি ধন্য!–তোমার এত রূপ, কে বলে তোমার রূপ নাই? এতভাবে মনুষ্যকে তুমি ধরা দিচ্ছ–তবুও দেখলাম, তোমার রূপ সমস্ত গগন-পবনে ছড়িয়ে আছে, সমস্ত অবুঝ মনুষ্য বলে–তোমাকে দেখি নাই। প্রাতঃকালে যখন উঠলাম, তখন প্রকৃতিতে তোমার পায়ের নির্মল সুরভি লেগে আছে, সমস্ত দিন ভরে নিজেকে প্রকাশ করলে তবু বলি তোমার রূপহীন।
.
০৩. শয়তান
প্রভু! বীভৎস ঘৃণিত কুৎসিত মুখ আমি দেখতে চাই। আমার হাত তুমি ধর, আমি শয়তানের মুখ দেখবো–খুব ভালো করে তাকে দেখবো। শয়তান কেমন করে আমাকে মুগ্ধ করে, আমার শিরায় শিরায় প্রবেশ করে, আমাকে উদভ্রান্ত করে, আমাকে তোমার স্নেহ-মধুর পূত-নির্মল সহবাস হতে ইঙ্গিতে বিভ্রান্ত করে।
সমস্ত অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করতে চাই। তাকে দেখি নাই বললে চলবে না। তার ঘৃণিত, পৈশাচিক মুখ আমায় দেখাও, আমার দেহের অনুপরমাণু ঘৃণায় বিদ্রোহী হয়ে উঠুক, সমস্ত অন্তর দিয়ে আমি শয়তানকে ঘৃণা করতে চাই।
আমি অনেক সাধনা করেছি, অনেক রাত্রি তোমার ধ্যানে কাটিয়েছি আমার সমস্ত শরীর তোমার পরশ-পুলকে অবশ হয়ে উঠেছে; আমাতে আমি নাই–আমার নয়ন দিয়ে তোমার প্রেমের অশ্রু ঝরছে। পৃথিবীর সমস্ত আবিলতা মুক্ত হয়ে তোমার প্রেমে ধন্য হয়েছি; অকস্মাৎ চোখের নিমিষে শয়তান এসে আমার সর্বনাশ করে গেল,–আমাকে এক মুহূর্তে, পাতালের গভীরতম কূপে ফেলে গেল, ক্ষণিকের লোভে মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত করলাম, অন্ধকার নিশীথে পশুর নেশায় বারবণিতার সৌন্দর্যশ্রীতে ডুবে মরলাম, গোপনে লোকচক্ষুর অগোচরে কুকার্যে আসক্ত হলাম, মানুষের বৃদ্ধি-অনুভূতির অন্তরালে প্রতারণায় আত্মনিয়োগ করলাম। প্রভু, কে আমায় রক্ষা করবে? মানুষ আমার পাপ দেখে নাই, আমি একাকী দেখেছি, আমাকে শয়তান আমার সর্বনাশ করেছে। প্রভু,মানুষের অগোচরে আমায় দুর্জয় কর; শয়তানের কুৎসিত মুখশ্রী আমায় দেখাও।
পৃথিবীর যত পাপ–পৃথিবীর যত প্রতারণা, নীচাশয়তা, হীনতা, কাপুরুষতা তাই তো শয়তানের মুখ। সাধু সঙ্গ ত্যাগ করে শয়তানের মুখ ভালো করে দেখবার জন্য, পৃথিবীর সমস্ত কাপুরুষতা, সমস্ত মূঢ়তা, গোপন পাপ, নারী ব্যভিচার আজ আমি ভালো করে দেখতে চাই।
একটা দরিদ্র লোক জীবনভর কিছু টাকা উপায় করেছিল। একদিন এক নামাজিকে তার বাড়িতে গিয়ে গভীর রাত্রে পঞ্চাশটি টাকা হাওলাত করে আনতে দেখেছিলাম। নামাজি বিয়ে করতে যাচ্ছিল, খুব বিপদে পড়েই তাকে সেখানে টাকার জন্য যেতে হয়েছিল। পঞ্চাশটি টাকা সে চাওয়া মাত্র পেয়েছিল–কোনো সাক্ষী ছিল না, কোনো লেখা-পড়া দলিলপত্র হয় নাই। এই ঘটনা দেখেছিলেন শুধু আল্লাহ্ আর নামাজির অন্তর মানুষ। তারপর দশ বৎসর অতীত হয়ে গেছে। লোকটি মারা গেছে। তার বিধবা পত্নী নামাজির বাড়িতে হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে এখন আর হাঁটে না। এই ব্যক্তিকে লোকে মুসলমান বলে, মানুষ তাকে ঘৃণা করে। তাকে অমানুষ বলে ধরবার কোনো পথ নাই। সে পাঁচটি ফরজই আদায় করেছে। কে তাকে কাফের বলবে? কিন্তু আমি দেখেছি তার মুখে শয়তানের বিশ্রী মুখ।
একজন কেরানি তার পত্নীকে খুব ভালোবাসতো। সারাদিন সে পোস্ট অফিসে গাধার খাটুনি খাটতো, আর তার মাঝে তার পত্নীর মুখোনি বুকে জেগে উঠতো। মাতাল যেমন মদ খেয়ে দুর্বল দেহটিকে সবল করে নেয়, সেও তার দুর্বল দেহটাকে পত্নীর মুখোনির কথা মনে করে সবল শক্ত করে নিত। পোস্ট অফিসের ভারী ব্যাগগুলি ধাক্কা মেরে সে দশ হাত দূরে ফেলে দিত।
সে যখন বাসায় ফিরতো বাজার থেকে এক গোছা গলদা চিংড়ি মাছ কিনে শিস দিতে দিতে বাড়ি আসত, পত্নীর হাতে সেগুলি দিয়ে প্রেমে তার মুখের পানে চেয়ে থাকত।
এক ছোঁকরা ঐ বাড়িতে আসত। কেরানি তাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতো। তার বয়স আঠার বৎসর হবে। একদিন ছোঁকরার সঙ্গে ঘরখানি খালি করে পত্নীটি চলে এসেছিল–সে এখন পতিতা। রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে হাসে। একদিন ঝগড়া করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম–সেই পতিতার উজ্জ্বল দীপ্ত লোহিত মুখ। সেই মুখে দেখেছিলাম শয়তানের কুৎসিত মুখ-বীভৎস দৃষ্টি। হৃদপিণ্ডে আগুন জ্বলে উঠেছিল, আন্তরিক ঘৃণায় সেই স্থান ত্যাগ করলাম। আমার পাপচিত্ত ক্রুদ্ধ ঘৃণায় জ্বলে উঠেছিল। মহাপাপের মুখ দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম।
শয়তান! আমি তোমার মুখ আরও ভালো করে দেখতে চাই–প্রভুকে যেমন করে দেখছি, তোমাকেও তেমন করে দেখতে চাই–অনন্তভাবে আমি তোমার ঘৃণিত কুৎসিত নগ্ন ছবি দেখতে চাই। আমি সমস্ত প্রাণ দিয়ে তোমাকে ঘৃণা করতে চাই। ভালো করে তোমার মুখ আমায় দেখাও, আমি দুই হাত দিয়ে ভালো করে স্পর্শ করে তোমায় দেখতে চাই।
শমসের এবং হাসান দুই ব্যক্তি কথা বলছিলেন। শমসের বললেন–আপনি মহামানুষ, দেশসেবক, আপনার কাছে আমি চিরঋণী।, হাসান–জনাব, জীবন অনিত্য, কোনো সময় যাই, তার ঠিক নাই, আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবার দরকার নাই।
শমসের বললেন–আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, আপনি মহামানুষ।
অতঃপর হাসান সে স্থান থেকে চলে গেলেন। তার স্থান ত্যাগ করা মাত্র শমসের বললেন–এই ব্যক্তিকে আমি চিনিভারি শয়তান’। শমসেরের মুখে দেখলাম, কাপুরুষ নিন্দাকারী শয়তানের বীভৎস ছবি। শয়তানের হাত থেকে রক্ষা চাই। আমাদের এই সুপবিত্র মুখশ্রীতে শয়তানের মুখ ফুটে না উঠুক।
একটি বন্ধু আর একটি বন্ধুকে ভালোবাসতো। প্রথম বন্ধুটির গৃহে দ্বিতীয় বন্ধুটি প্রায়ই যেত। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুকে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। একদিন দেখলাম দ্বিতীয় বন্ধু প্রথম বন্ধুর অনুপস্থিতিতে প্রথম বন্ধুর পত্নীর সঙ্গে অবৈধ প্রেমালাপে মত্ত। শয়তানের মুখ দেখতে বাকি রইল না। শয়তানকে ভালো করেই চোখের সামনে দেখলুম।
একটি যুবক, সে বক্তৃতা করতো, এক সংবাদ-পত্রিকার সম্পাদক সে। এক বুড়ির বাড়িতে সে যেত। বুড়ি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত–স্নেহ করতো; এতটুকু অবিশ্বাস করতো না। বুড়ি উচ্চ-হৃদয় যুবককে গৃহে পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতো। বুড়ির একটি মাত্র অবলম্বন ছিল তার বার বৎসরের প্রিয় সন্তানটি, দেখতে বেহেশতের পরীবালকের মতো। এই যুবক বালকটিকে ভালোবাসতো; বুড়ি প্রাণ ভরে দেখতো তার পিতৃহীন সন্তানকে যুবক ভালোবাসে, স্নেহ করে। প্রাণভরে সে যুবককে আশীর্বাদ করতো। একদিন যুবক এই শিশুর পবিত্র মুখে গোপনে চুম্বন করলো। সুকুমার স্বর্গের শিশুটি যুবকের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে শিশুকে যুবক পাপের পথে আকর্ষণ করলো। তার সোনার হৃদয়-কুসুমে পাপের হলাহল ঢেলে দিল। বুড়ির নয়ন-পুত্তলির সর্বনাশ হয়ে গেল। বুড়ি তা জানতে পারলে না। তার সাজান বাগানে যুবক আগুন ধরিয়ে দিল। এখন দেখি বুড়ি অন্ধ, রাস্তায় রাস্তায় সে ভিক্ষা করে। তার সোনার যাদুটি মারা গেছে। শিশুটি ধীরে ধীরে পাপের পথে অগ্রসর হতে থাকে, তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, বিবিধ রোগে সে ভেঙ্গে পড়ে, সে মদ, গাঁজা, ভাঙ্গ খায়, পরে সে জেলে যায়, সেখানেই মরে। সেই সম্পাদক যুবককে কেউ জানে না, তাকে মানুষ নমস্কার করে। নিকটে এলে আসন এগিয়ে দেয়। অনেক টাকা তার। আমি তার মুখ দেখলে ভয় পাই। সম্মুখে সাক্ষাৎ শয়তান দেখে শিউরে উঠি।
এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির গৃহে তার সেয়ানা মেয়েটি থাকতো। মেয়েটির স্বামী বিদেশে থাকে। ভদ্রলোকের বাড়িতে তার এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়ও থাকত। দেখলাম, একদিন সেই আদরের মেয়েটি সেই যুবকটির সঙ্গে গোপনে গোপনে আলাপ করছে। মেয়েটির মা বোনেরা তা জানে, জাতি যাবার ভয়ে কথা বলে না। নির্জন কক্ষে এই দুটি বিশ্বাসঘাতক নর-নারী কথা বলে, এক সঙ্গে খায়।
যুবকটি ভয় করে, অনিচ্ছা প্রকাশ করে; বিবাহিতা অবিশ্বাসিনী যুবতীটি তাকে বলে–কোনো ভয় নাই।
দুই বৎসর পরে দেখলাম, এক জায়গায় এক বাবুর গৃহিণীরূপে এই বালিকাটিকে। বাবু পরম বিশ্বাসে পত্নীর সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন, পত্নীও স্বামীর সঙ্গে আনন্দে কথা বলছে।
এই দৃশ্য দেখে শোকে আমার চোখ জলে ভরে উঠলো। শয়তানের এই অভূতপূর্ব কীর্তির ছবি চোখ দিয়ে দেখলাম। অসহ্য দুঃখে ভাবলাম, মানুষের অত্যাচার এবং মূর্খতা-অবিচার আর শয়তানের প্রাণঘাতী কীর্তি!
এক মহাজন এক ব্যক্তিকে বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। লোকটি একদিন মহাজনের সর্বনাশ করার জন্যে চালাকি করে ঘরে সিঁদ কেটে দুপুর রাতে কাঁদতে আরম্ভ করলো। লোকজন যখন জমা হল, সে কেঁদে বলল, তার সর্বনাশ হয়েছে–চোর তাকে সর্বস্বান্ত করে গেছে, কী করে সে মহাজনকে মুখ দেখাবে?’ প্রাতঃকালে সে মহাজনকে টেলিগ্রাম করল। থানার কর্মচারীর সঙ্গে রাত্রে গোপনে সে দেখা করল। চুরি যে ঠিক হয়েছে এবং সে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে, তা প্রমাণ হয়ে গেল। তার মিছে সর্বনাশের কেউ প্রতিবাদ করলো না। করতে কেউ সাহস পেল না।
এই নিমকহারাম বিশ্বাসঘাতক লোকটি সেই টাকা নিয়ে এসে বাটীতে মসজিদ-ঘর তুলো। সেই ঘরে বসে সে বন্দেগী করে। মানুষের মুখে তার প্রশংসা ধরে না; কত মানুষ তার গৌরব করে, কত মৌলবীর মুরুব্বি সে, কত ভদ্রলোকের বন্ধু সে। আমি তার মুখ দেখলেই ভয় পাই, তার মুখে কার বীভৎস মুখ দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠি। ঘৃণায় সে স্থান ত্যাগ করি।
চল্লিশ বৎসর পূর্বে এক ব্যক্তি রেঙ্গুনে গিয়েছিল; সেখানে গিয়ে সে একটি বালিকাকে বিবাহ করেছিল। সেই বালিকাটি এখন যুবতী। যৌবনের রূপ-ঐশ্বর্য দেখে তাকে ভোগ করার লোভ সংবরণ করতে না পেরে, সে প্রতারণা করে তাকে বিয়ে করেছিল। যখন তার পিপাসা মিটে গেল। তখন একদিন আসি’ বলে ঐ যে পালিয়ে এল, আর কোনোদিন সেখানে গেল না। সেই বালিকা যে কত বৎসর ধরে পথের পানে তার প্রিয়তমের আশায় চেয়েছিল, তা কে জানে? এই যুবক একজন ধার্মিক ভদ্রলোক। সমস্ত ধর্ম সাধনাই তার ব্যর্থ হয়েছে। প্রভু আর আমি জেনেছি সে কে!
এক ব্যক্তি মরে গেছে। সে যে বিপুল সম্পত্তি রেখে গেছে তার জন্য তার বংশের মর্যাদা দেশ জোড়া। সে ছিল এক জমিদারের নায়েব। জমিদার বিশ্বাস করে তার সম্পত্তি নায়েবের হাতে দিয়ে আনন্দ করে বেড়াতো। ধীরে ধীরে জমিদারের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রয় করে বিশ্বাসঘাতক নায়েব নিজেই জমিদার হল। তার এখন কত সম্মান, মানুষ তার নামে দোহাই দেয়, কত ইট পাথর তার বাড়িতে। কত বড় বড় প্রতিমা তার ঘরে উঠে। আমি তার বাড়ির সামনে গেলেই হাসি-শয়তানের ভণ্ডামি দেখে জ্বলে উঠি, শয়তান মানুষকে কত রকমেই না প্রতারণা করে। কে তার মুখ মানুষের মুখে দেখতে সাহস পায়?
সৌরভ, সমস্ত পরিচ্ছদ, সমস্ত সৌন্দর্যের সাধ্য নাই শয়তানের কুৎসিত মুখচ্ছবি ঢাকে। যে তা দেখেছে, সেই ভয় পেয়েছে।
.
০৪. দৈনন্দিন জীবন
জীবনের প্রতিদিন আমরা কত মিথ্যাই না করি, সেজন্যে আমাদের অন্তর মানুষ লজ্জিত হয় না। আল্লাহর কালাম পাঠ করি, কিন্তু সে কালাম আমাদের প্রতারণা, মিথ্যা ও অন্যায় হতে রক্ষা করে না।
পুটার্ক (Plutarch) বলেছেন, যে বড় যুদ্ধে জয় লাভ করে, তার মনুষ্যত্ব সূচিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য একটুখানি সহৃদয়তা, একটা স্নেহের বাক্যে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। যে মানুষ জীবনে এক একটা দিন নিষ্ঠুর বাক্য, মানুষের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার এবং প্রতারণা থেকে মুক্ত করে রাখতে পারবে জীবন শেষে সে দেখতে পারবে, সে তার জীবনকে সার্থক করেছে। প্রতিদিনকার জীবন যার নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা-তার সমস্ত জীবনটাই একটা ভাঙ্গা ঘরের মতো অন্তঃসারশূন্য। প্রাতঃকালে উঠেই প্রতিজ্ঞা কর, “আজিকার দিনটা সফল ও সার্থক করবো! আমার আজিকার এই দিনের কার্যে যেন মানব সমাজ উপকৃত হয়। যার সঙ্গে কথা বলি, তাকেই যেন আনন্দ দিতে পারি, যেন কোনো কার্যে কাপুরুষ না হই। যেন এর প্রতিমুহূর্ত আমার জীবনে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।”
কত পাপ, কত অন্যায়, কত প্রকার হীনতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অপবিত্র করে, আমাদের আত্মাকে কতখানি মলিন করে। দিনের মধ্যে কতবার আমরা মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করি। দিনের প্রভাতে উঠে আমরা দেখতে পাই উদার, নীল গগন শী–কী সুন্দর! কী শোভাময়! তারপর পূর্বাকাশের নির্মল প্রভাত ছবি–গাছে গাছে স্বর্গের কী মোহন মাধুরী! বিশ্বময় নির্মলের দেবতাকে একবার প্রণাম কর-তারপর মানুষের মুখের দিকে চেয়ে দেখ।
যত প্রকার পাপ আছে, মানুষের চিত্তে ব্যথা দেওয়াই তার মাঝে বড় পাপ। এ মহাপাপ কেউ করো না! ক্ষমতা এবং বাহুর গর্বে, জনবলের গর্বে মানুষের মুখের দিকে চেয়ে কঠিন কথা বলো না। সরে এস, ভীত হও।
এমন সুন্দর আলো-বাতাস প্রবাহে, এমন সুন্দর বিধাতার আশীর্বাদ ঐশ্বর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হে মানুষ–সর্ব পাপমুক্ত হবার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা কর। বিধাতার জড়সৃষ্টির মত তুমি নির্মল হও।
প্রভাতে উঠেই কী ভাবছ?–হিংসা প্রতিশোধের বিষ তোমার নির্মল আত্মাকে বিষাক্ত, অপবিত্র করে দিচ্ছে? সতর্ক হও, কী চিন্তা করছ? কার ক্ষতির চিন্তা মনে জেগেছে? কার পানে মন তোমার নিষ্ঠুর বিরূপতায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে? ক্ষান্ত হও! মানুষকে প্রেম করতে শেখ।
ঘর হতে বের হয়ে যাও। পথে পথে মানুষের সুন্দর, শুভ মুখ দেখে জীবন সার্থক কর–মনুষ্যকে আলিঙ্গন কর।
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করো না-এই মহাপাপ হতে সরে এস, মানুষের সঙ্গে শঠতা করো না, মনুষ্যকে গালি দিও না। সর্ব প্রকারেই জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা কর। মানুষকে চিনি না এ কথা কাউকে বলো না।
তোমার আত্মসর্বস্ব জীবনের কথা ভেবে তুমি লজ্জিত হও। মানুষ নিজের জন্য বেঁচে নেই। অনেক টাকা-কড়ি উপায় করছ, আরও টাকার জন্য ব্যস্ত হয়েছ? এই টাকা-কড়ি আহরণ করার অন্তরালে কী উদ্দেশ্য তোমার আছে! তোমার সমস্ত জীবন-স্পন্দনের মাঝে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত মহাপুরুষ অদৃশ্যভাবে তোমার জীবনকে পরিচালিত করেছেন, তাঁরা মানবজীবন সম্বন্ধে কী বলেছেন? মানুষ কি বেঁচে আছে নিজের জন্যে?–মানুষের নিজের অভাব কতটুকু? আর জগতে রাজা হয়েই বা কী লাভ?–অপরিসীম প্রতিপত্তি লাভ করেই বা কী এমন লাভ আছে, যদি না দুর্বলের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়াও? যদি না মানব-দুঃখ তোমাকে ব্যথিত করে?–মানব সেবার জন্যে যদি না তুমি তোমার সমস্ত ধন-সম্পদ, সমস্ত জ্ঞান ও শক্তি নিয়ে অগ্রসর হও? কী লাভ হবে বড়লোক হয়ে?–কতদিন মানুষ তোমার নাম করবে? তোমার চাইতে অনেক শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী মানুষ মাটির ধূলার সঙ্গে মিশে গেছে। তুমি কোন ছার!
মন যার পাষাণ, মানুষকে শুধু উপদেশ দিয়েই যে কর্তব্য শেষ করে, প্রেমে অগ্রসর হয় না, দুর্বল, অপরাধীকে ক্ষমা করে না, সে মানুষ নহে।
এ শিক্ষা মনুষ্য কোনো পুস্তক, কোনো বক্তৃতা হতে পায় নাই, এ শিক্ষা, এ প্রেমের শিক্ষা মানুষ আপনা আত্মা হতেই পেয়েছে। সমস্ত ধন-সম্পদ দিয়ে তোমার আত্মার প্রেমকে সার্থক করতে হবে। পশুর মত আপন বিবরে প্রবেশ করো না–মানুষের কথা ভাব–মানুষের প্রতি তোমার কর্তব্য আছে। এই কর্তব্য উদযাপনের নাম এবাদত, তা শুধু প্রাণহীন আবৃত্তি নয়।
দুঃখের সামনে, ব্যথার সামনে, নিষ্ঠুর পাষাণের মতো স্থির হয়ে থেকো না। মানব দুঃখের সম্মুখে আপন পত্নীর প্রেমে পূর্ণ থেকো না। অবিচারের সম্মুখে আপন পুত্রের মুখে চুম্বন দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করো না।
ধর্মগ্রন্থ তোমায় কী দীক্ষা দিয়েছে? ইঞ্জিল, জব্দুর, তৌরাত, কোরান এবং পবিত্র হাদীস সমষ্টি কী শিক্ষা তোমায় দিয়েছে? তোমাকে স্নেহশীল, প্রেমিক হতে বলে নি? কতবার কতভাবে তোমাকে বলেছে, হে মানুষ, প্রেমিক হও, পাষাণ হয়ো না।
আত্মার প্রেমকে সার্থক করবার জন্যে,–মনুষ্য জীবনের দানকে সার্থক করবার জন্যেই রত্ন সংগ্রহে দিকে দিকে ছুট। মনুষ্যকে পূর্ণ করবার জন্যে নিজের পরিবারের সুখের জন্যে, মানুষের ধনরত্ন কেড়ে এনে বাক্সজাত করো না। মনুষ্য যে তোমার ভাই, এ কথা কি তুমি জান না? এ কথা তো যুগে যুগে আল্লাহর বাণীরূপে তোমরা পেয়েছ, তবুও তা বিশ্বাস করো না? মনুষ্য সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কি আনন্দ-রসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পার না? তাকে কি কাছে বসাতে জান না? মনুষ্য হয়েও কেন মনুষ্যকে এত বিষ নয়নে দেখ? এই তোমার ধর্ম?–যাও, ফিরে যাও। ভালো করে চিন্তা কর, তোমার ধর্ম কী? মিথ্যা করে তাড়াতাড়ি চিন্তা করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করো না।
মনুষ্যকে প্রেম করাই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ ছাড়া মনুষ্যের জন্যে দ্বিতীয় কোনো ধর্ম নাই। মনুষ্যকে প্রেম কর–মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার কর। মনের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব কর। পৃথিবীর দুঃখ তোমরা সকল ভাই সমান ভাগ করে নাও। মানব সমাজের জন্য জগৎ স্বর্গে পরিণত হোক–ধর্মের নামে মিথ্যাচরণ করো না।
দরিদ্র সন্তানের সম্মুখে নিজের সন্তানকে সজ্জাভূষিত করো না–এ নিষ্ঠুর কাজ। আবার বলি, মনুষ্যকে আত্মীয়ের চোখে, প্রেমের চোখে দেখ। পরিচিত বেগানার মতো মানুষের দিকে চেয়ে দেখ না। কীসের তোমরা গর্ব কর?–বংশ মর্যাদার? অর্থের? বেশ ভূষার? অট্টালিকার? জমিদারির? তোমরা জান না-মানুষ কীসের গর্ব করতে পারে! তোমরা যে কত নত হয়েছ, সেই গর্ব কর, প্রেমের গর্ব কর, মনুষ্যত্বে পরস্পরের প্রতিযোগিতা কর। সেবার এবং ত্যাগের প্রতিযোগিতা কর। সত্য বলছি, যে নত হতে পেরেছে, সেই তত শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে। মানুষের চোখে সে তত বড় আসন লাভ করেছে।
হে ভণ্ডেরা, মোহাম্মদ (সঃ) তোমার কাছে দরুদ চান নাই। আবার বলছি, তোমরা অযথা দরুদ পাঠ করো না। মোহাম্মদ (সঃ) দেখতে চেয়েছেন যারা তাকে প্রেম করে, তারা মানব-প্রেমিক কিনা, তারা সর্বপ্রকার অহঙ্কার বর্জন করেছে কিনা, দিকে দিকে আল্লাহর বাক্য তারা বহন করেছে কিনা। হাত-পায়ে সাবান লাগাবার মসলা (ব্যবস্থা) তোমরা প্রচার করো না, এতে তিনি সত্যিই লজ্জিত হন। ইসলাম মানে এ নয়।
সত্য বলতে কী, সমস্ত মানব জাতির জন্য মাত্র একটি ধর্ম আছে, সমস্ত মানুষই মুসলমান হবার জন্য, পরম শান্তির জন্যে লালায়িত। মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ আছে শুধু শয়তানের এবং আল্লাহর। আমরা সবাই আল্লাহকে চাই,পরম শান্তি চাই, ইহাই ইসলাম, পরম শান্তি। সব ধর্মেরই সমস্ত মানব-চিত্তের ইহা অপেক্ষা পরম লাভ আর কি আছে? শুধু শয়তানের সঙ্গে বিরোধ কর। সকল জাতির মানুষ সমস্ত হানাহানি ত্যাগ কর, সর্ববিধ পাপ বর্জন কর। আত্মার পক্ষে যাহা কিছু অসম্মানজনক, তাহা ত্যাগ কর। এটাই পরম শান্তির পথ। মনুষ্যকে এই পরম শান্তির পথে আকর্ষণ কর, মানুষকে বিনষ্ট হতে দিও না। জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি, ধন-সম্পদ এরই জন্যে, জীবনের আর কোনো সার্থকতা নাই।
.
০৫. সংস্কার মানুষের অন্তরে
অভাবে মানুষের দুঃখ হয় না, রোগ-শোকের যাতনা মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু মানুষের নীচতা দেখে যে দুঃখ হয়, তার তুলনা নাই।
মানুষের প্রবৃত্তি যদি পশুর মতোই হবে, যদি তার হীনতায় সে লজ্জিত না হয়, তবে কেন সে পশুর আকার ধারণ করে নাই? কেন সে আপন দেহ পোশাকে ও লজ্জায় ভূষিত করে? যদি রাজ্য হারিয়ে থাক, দুঃখ করো না, যদি তোমার পরম আত্মীয়েরা ত্যাগ করে গিয়ে থাকে তবুও দুঃখ করো না, যদি তোমার প্রবৃত্তি নীচ হয়, যদি ইতর পশুর আত্মার স্বভাবে তোমার আত্মার অবনতি ঘটে থাকে, তাহলেই লজ্জিত হও। তোমার চশমা, তোমার ঢেউ-তোলা চুল, সুবাসিত গন্ধ তেল, তোমার শার্ট, কোচান ধুতি তোমার গৌরব বর্ধন করবে না।
কোনো দুঃস্বভাবে লজ্জিত হও না?–অপরের দোষ দেখে আঘাত কর, নিজের দোষের পানে একটু তাকাও না? একটু লজ্জিত হও না? মানুষের দোষ-ক্রটি অম্লান বদনে সমালোচনা কর, নিজের দোষ-ত্রুটির বিষয় একটুও ভাবো না! পরের চোখে একটা কাল দাগ দেখে লাফিয়ে উঠেছ, নিজের চোখে সরষে ঢুকছে, তা দেখ না? কেন আপন স্বভাবকে সমর্থন করার জন্যে মানুষের সঙ্গে তর্ক কর? অন্ধকারে নিজের মনের দিকে চেয়ে দেখ–কত কালি, কত মিথ্যা, কত প্রতারণা, কত শঠতা সেখানে রয়েছে। নিজের অপরাধের কথা ভেবে লজ্জা লাগে না? কেবলই পরের কথা ভাব? মানুষ তোমাকে চুরি করতে দেখে নি, তা বলে তুমি চোর নও? অন্তরের পাপ মুখোনি একবার ভালো করে দেখে নাও! তুমি কি অন্যায় করে কারো মনে আঘাত দিয়েছ? তাহলে গোপনে ক্রন্দন কর। তার কাছে ক্ষমা চাইবার আগে মসজিদ ঘরে যেয়ো না। তোমার ভাই বা পিতাকে ফাঁকি দেবার জন্যে কোনো মিথ্যা কথা বলেছ কী? তাহলে লোক চক্ষুর আগে চেয়ে আপন মনে লজ্জিত হও। কাউকে বঞ্চনা করেছ কি? তুমি কি অকৃতজ্ঞ? তুমি কি মিথ্যাবাদী? তাহলে লজ্জিত হও। মনুষ্য সমাজে বের হয়ো না।
হাইরোক্লিস বলেছেন, সংস্কার নিজের অন্তর থেকেই হবে। আপন আত্মার দিকে প্রথমেই ফিরে তাকাও। তারপর পরের কথা ভেবো। নিজেকেই প্রথমে প্রেম করো। নিজের জাহাজ ভেঙ্গেছে, সেই কথা আজ ভাব, নিজেকে বাদ দিয়ে মানুষকে সত্যপ্রিয় হতে বলো। নিজের নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করে, অপর মানুষকে মধুর কথা বলতে অনুরোধ করো। নিজের কথাই আগে ভাবতে হবে। নিজের কর্তব্য আগে পালন কর, তারপর অন্যকে উপদেশ দিও, অপরকে তার কর্তব্য পালন করতে অনুরোধ করো।
যে নিজে নীচাশয়, সে অন্যকে কেন নীচ বলে গালি দেয়? যে নিজে ভুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, সে কেন অন্যের ভুল ধরে? জীবনের কোনো কিছুতেই আনন্দবোধ করো না–যদি না নিজেকে পশুর স্তর থেকে মানুষের আসনে উন্নীত করতে পার। তুমি কি ধনশালী হয়েছ? ব্যাংকে কি লক্ষ টাকা জমাতে পেরেছ? তাহলে এমন কি আনন্দের বিষয় আছে–সমুদ্রগর্ভে কি অপরিমিত মণিরহ থাকে না? পর্বতের অন্ধকার গুহায় কি বহুমূল্য প্রস্তর নাই?
তোমার পোশাকের গর্ব কর। ক্ষেতের পুষ্প কি তোমাদের চাইতে অধিক সুন্দর নয়। মনুষ্য তোমাদের অর্থ এবং মূল্যবান পরিচ্ছদকে নমস্কার করে না–তোমাদের দংশনকে, তোমাদের আঘাতকে তারা ভয় করে; তাই তোমাদের শক্তি, অর্থ ও গর্বের সম্মুখে মাথা নত করে। বস্তুত অর্থের গৌরবে মনুষ্যের শ্রদ্ধালাভ করতে যেয়ো না–জমিদারির শক্তিতে মনুষ্যকে ঘৃণা করো না। এ দাবি কোনো দাবিই নয়।
তুমি কি মনুষ্যকে প্রেম কর? তুমি কি সহৃদয়? মনুষ্য তোমাকে দেখে কি আনন্দিত হয়? তুমি মানব-মঙ্গল চাও? তোমার জীবনে কি পৃথিবীর এবং মানব সমাজের কোনো কল্যাণ হচ্ছে? তুমি কি মনুষ্যকে আল্লাহর পথে আকর্ষণ করে থাক? তুমি কি মনুষ্যকে সত্যময় হতে উপদেশ দিয়ে থাকো? তাহলে মনুষ্যের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার দাবি তুমি করতে পার।
মন পরিবর্তন কর। মনের গোপন পাপ ধুয়ে ফেল। যতই কেন ধার্মিকের বেশ ধারণ কর না, অন্তরের গ্লানি ধুয়ে না ফেললে তোমাকে যথার্থ ধার্মিক বলা হবে না। মানুষ শরীরের গৌরবে বড় নয়। আত্মার গৌরবে যে বড় হতে চায় না, সে মানুষের জন্য নয়। সে পশু জাতীয়।
মানুষকে পশুর সঙ্গে তুলনা করে কেন? মানুষের প্রবৃত্তি কী, পশুর প্রবৃত্তিই বা কী? পশুরা আপন পত্নীকে খুব ভালোবাসে, কিন্তু খাবার বেলায় দেখতে পাই, সে পত্নীকে ফাঁকি দিয়ে নিজেই খায়, পশু পিতা সন্তান পালন করে না, বরং বাচ্চাগুলো নিকটে এলে পশু পিতা অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়, নিকটে এলে তাড়িয়ে দেয়। সে নিজের ভালো, নিজের লাভই বেশি বোঝে, সে কখনও পরের চিন্তা করে না, সে দুর্বলকে আঘাত করে এবং অপেক্ষাকৃত শক্তিশালীর কাছে সভয়ে মাথা নত করে। তার আপন-পর জ্ঞান নাই, সুযোগ পেলেই পরের জিনিস চুরি করে। নিজের কোনো অন্যায় দেখলে আপত্তি করে না। কেউ বিপদে পড়লে তার উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয় না। কোনো কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায়, আপন জাতির কাউকে বিষণ্ণ দেখলে তাকে আরও আঘাত করে, তার লজ্জা নাই, তার কোনো সম্মান-জ্ঞান নাই। আপন আপন স্বামী এবং পরীর কাছে সে বিশ্বস্ত থাকে না। সে শোক করে না–আত্মীয় বিরহে তার কোনো বেদনা বোধ নাই। তার কোনো ধর্ম নাই, সে
অতিশয় ভীরু। যেখানে স্বার্থ দেখে সেখানেই উপস্থিত হয়। . মানুষের স্বভাব এর সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে মানুষকে পশুর মতো দেখি সেখানে আমরা তাকে পশু বলে ঘৃণা করি। সেখানে মানুষ পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বভাবের পরিচয় দেয়, সেখানে তাকে ঘৃণায় পশ্বাধম বলে গালি দেই।
মানুষে আর পশুতে পার্থক্য আকাশ-পাতাল, মানুষ স্বর্গের দেবতা, তারার মতো সুন্দর,–পশু মর্তের নিকৃষ্ট জীব, রাত্রির মতো মসিমলিন।
মানুষ ভালোবেসে, যা-কিছু আছে সবই দান করে। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে সে সব দিয়ে দেয়, রিক্ত হস্তে দাঁড়িয়ে ধন্য হয়। সে যাকে ভালোবাসে, তাকে সর্বপ্রকার সুখী করতে চায়, নিজে না খেয়ে তাকে খাওয়াতে চায়। মানুষের প্রেমের এটাই স্বভাব। ইহাতেই তার আনন্দ। মানুষ সন্তানকে হৃদয়ের টুকরা মনে করে, স্ত্রী-পুত্রের জন্যে সে বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদকে সে বিপদ মনে করে না, পরের জন্য দুঃখভোগ করতেই তার আনন্দ। এক একটা পশ্চিমা দারোয়ান বিদেশে ৭/৮ টাকা বেতনে, ছাতু খেয়ে মাটির উপর শুয়ে বৎসরের পর বৎসর কাটিয়ে দেয়; মাসটি গেলে কত আনন্দে সে পত্নীর কাছে টাকা পাঠায়। কীসের জন্যে। সে এত কষ্ট সয়?–না, তার স্ত্রী-পুত্র খাবে। পশ্চিমা ছেলেগুলি মাস অন্তে কত আনন্দে মায়ের কাছে দুই তিনটি টাকা পাঠায়। মানুষ নিজে খেয়েই শুধু সুখী হয় না, আত্ম-সুখের জন্যে সে শুধু দুঃখের সাগর পাড়ি দেয় না। হাজী মোহাম্মদ মহসিন, ডাক্তার পালিত ঘোষ, করটিয়ার –চাঁদমিয়া সর্বস্ব দান করে রিক্ত হস্তে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। পশুর মত চীৎকার করে, সকলকে দংশন করে, নিজের উদর ভর্তি করাকে সে ঘৃণা করে। মানুষ মানুষের দুঃখ-ব্যথার কথা চিন্তা করে, লোকচক্ষুর অগোচরে নানা বেদনায় ফুলে ফুলে কাঁদে। কী প্রেম তার চিত্তে! মানুষ দুর্বলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, পশুর মতো পীড়িতকে দুঃখে ফেলে সে ত্যাগ করে না। লাঞ্ছিত-অত্যাচারিতকে সে সকলের নিষ্ঠুর আঘাত থেকে রক্ষা করে। সে নিঃসহায়া নারীকে নিজের প্রাণ বিপন্ন করে রক্ষা করে, কারণ সে যে মনুষ্য দেবতা। প্রেম দিয়ে তার চিত্ত গড়া। প্রেম করা, আঁখি জলে কাদা, মানুষের দুঃখে বিগলিত হওয়াই তার স্বভাব। মানুষ যখন পশুর মতো হীন হয়ে আপন সত্য স্বভাবের পরিচয় দেয় না, তখন মানুষের আকৃতি ধারণ করলেও সে সত্যিকার মানুষ থাকে না–সে পশুর স্তরে নেমে যায়। মর্যাদা রক্ষার জন্য মনুষ্য প্রাণ দেয়, তবুও অন্যায় ও মিথ্যার কাছে সে মাথা নত করে না। কারবালা প্রান্তরে পিপাসিত, ক্ষুধার্ত মানব দেবতা চরম দুঃখে নিজের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, তবুও দুর্মতির কাছে মাথা নত করেন নাই, তার অনুগ্রহ স্বীকার করেন নাই। ইহাই মানুষের মহত্ত্ব। অন্ধকারে কেহ যেখানে তাকে দেখে নাই, সেইখানে সে নিজের পাপ নিজে দেখেছে এবং শঙ্কিত হয়ে নিজেকে শাসন করেছে–নিজ পাপে সে নিজেই লজ্জিত হয়েছে। মনুষ্য নিজের জাতির জন্য বর্তমান ও অতীতে কত দুঃখই না সয়েছে, ইতিহাস তার প্রমাণ। নিজের রক্ত দিয়ে ধুলার সঙ্গে মিশে যে জাতির ভবিষ্যৎ কল্যাণের পথ প্রস্তুত করেছে, কেউ তাদের সংবাদ রাখে নি। এই-ই মনুষ্য দেবতার স্বভাব। নিজের দেশের মানুষ দেখলে মানুষের প্রাণ আনন্দে নৃত্য করে উঠে, প্রেমে তার কণ্ঠবেষ্টন করে সে যে কত বড় তারই পরিচয় দিয়েছে।
মানুষের জন্যে রাজ-সিংহাসন ত্যাগ করে পথের ভিখারি হয়েছে, ঐশ্বর্য বিলাস অস্বীকার করে সে পথের ফকির হয়েছে।
বেহেস্তের কন্যা নারী আপন সতীত্ব রক্ষার জন্যে দস্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, সে জীবন দিয়েছে, তবু স্বামী ত্যাগ করে পরের অঙ্গশায়িনী হয় নি। যেখানে নারী ব্যভিচারিণী, সেখানে নারী আর নারী নয়–সে পশু।
মানুষের জন্যে মানুষ কী কঠিন শোকই না করেছে। মানুষের জন্যে মানুষের কী অপরিসীম বেদনা! কী অতুলনীয় প্রেমের অনুভূতি তার। সে আপন সন্তানের জন্য, আপন প্রণয়ী ও প্রণয়িনীর জন্য পথে কেঁদে মরেছে। পৃথিবীর কোনো আকর্ষণ তাকে আনন্দ দেয় নাই। চিরজীবন সে হাসে নাই। পথে পথে বনে বনে ঘুরে, পাহাড় ভেঙ্গে, ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে তার মহাপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে। সে ধন্য।
মানুষ দেবতা বলেই সে মানুষের জন্য শোক করে। আত্মা তার স্নেহ-মমতার আধার বলেই বিরহ-বেদনায় কাতর হয়; সমস্ত প্রকৃতির মাঝে আপন চিত্তের শোকধ্বনি শুনতে পায়। পশুর কোনো শোক নাই, তার বিরহ-বেদনা নাই।
মানুষের কী অপরিসীম সাহস! কী তার হৃদয়ের বল! জগতের কোনো ব্যথা, কোনো ভয় তার গতিকে রোধ করতে পারে নি। বজ্র অপেক্ষা সে ভীষণ, বিদ্যুৎ অপেক্ষা সে দীপ্তিশালী। সে মৃত্যুর সঙ্গে খেলা করেছে, কামানের সম্মুখে নির্ভয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড় ভেঙ্গে ছিন্ন বিচ্ছিন্নরেছে, সমুদ্রকে সে অঞ্জলি আবদ্ধ জলবিন্দু মনে করেছে।
যে মানুষ এত বড়, তার কি কাপুরুষতা, ভীরুতা সাজে! প্রাণভয়ে মৃত্যুর আগেই মরা কি তার শোভা পায়?
মনুষ্য কি নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সংবাদ নিয়েছে? নিঃস্ব পীড়িত আর্ত তার করুণ নয়নের দৃষ্টিলাভ করেছে? সে পশুর মতো পাশ কাটিয়ে স্বার্থ ও লাভের গন্ধে ছুটে নাই। বিশ্বের যেখানে ব্যথা, যেখানে হাহাকার, সেখানে সে তার সর্বস্ব নিয়ে আকুল হয়ে ছুটেছে। এই-ই মানুষের স্বভাব। সে দুঃখী সংসারের সম্মুখে আপন মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে নাই, প্রাণ তার প্রেমের বেদনায় কেঁদে উঠেছে। ধন্য মানুষ! তোমায় নমস্কার করি। মনুষ্য যেখানে প্রেমের নামে জাতি-বিচার করে, দুঃখীকে অবিশ্বাসী কুকুর বলে গালি দেয়, তখন তা মানুষের কথার মতো শোনা যায় না।
মানুষে যখন মানুষের উপর অত্যাচার করে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে, মানুষকে চূর্ণ করে আনন্দলাভ করে, মানুষকে ব্যথা দেয়, মানুষ যখন অপ্রেমিক, নিষ্ঠুর, কাপুরুষ, মিথ্যাবাদী, নীচ, আত্মমর্যাদাজ্ঞানহীন, নিন্দুক এবং বিশ্বাসঘাতক হয়, যখন সে মোনাফেক শয়তান এবং ক্রুর হয়, সে যতই উচ্চাসন লাভ করুক, সে পশু। সে আর তখন মানুষ থাকে না।
মানুষ কি নিজের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে না? আত্মার গৌরবে কি সে তার জন্ম সার্থক করবে না?
০৬-১০. জীবনের মহত্ত্ব
০৬. জীবনের মহত্ত্ব
প্রায় ৩২ বৎসর আগে খুলনার এক স্টীমার থেকে একজন বুড়ো আর একটি ছোট মেয়ে নামলেন। ঠিক তাদের সঙ্গে একটি যুবক অবতরণ করলেন। যুবকটি খুব সম্ভব বাগেরহাটের উকিল, সবে বারে যোগ দিয়েছেন।
বুড়ো দুর্বল, কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন। একটু পথ হেঁটে আর একখানি স্টীমারে চড়তে হবে, বালির চরায় নদী ভরাট হয়ে গেছে, তাই স্টীমার কোম্পানী দু’ধারে দু’খানা স্টীমারের ব্যবস্থা করেছেন। ৮/৯ বৎসরের ছোট্ট মেয়েটি একটা বৃহৎ বোঝা এক হাত দিয়ে পিঠে তুলে নিচ্ছিল অন্য হাত দিয়ে বুড়োর দুর্বল হাত চেপে ধরেছিল।
বুড়ো সস্নেহে বলছিলেন, “তুই কি অত বড় বোঝা নিতে পারবি, আমায় দে।”
মেয়ে ততোধিক স্নেহে বলছিল, “দাদা, তুমি দুর্বল, হাঁটতে পারছ না, তোমাকে আমি শক্ত করে ধরছি। এ বোঝাটা তুমি নিতে পারবে না, আমিই বেশ পারব।” বোঝার ভারে মেয়েটি কাঁপছিল, কিন্তু স্নেহ প্রদর্শনে তার ক্লান্তি নেই।
এই স্বর্গীয় দৃশ্যটি যুবক চেয়ে দেখলেন, তারপর নিকটে এসে বললেন, “মা লক্ষ্মী, দেখ, আমার গায়ে অনেক বল আমার হাতে ঐ বোঝাটি দাও; আমি বয়ে নিয়ে দেবো, তুমি তোমার দাদার হাতখানি শক্ত করে ধর।”
মেয়েটি যুবকের দিকে সকরুণ নেত্রে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। যুবক তৎক্ষণাৎ ভারী বোঝাটা দৃঢ়-বাহুর একটানে পিঠের উপর ফেলে চলতে লাগলেন। বুড়ো যুবককে প্রাণভরে দোয়া করলেন।
জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে আমরা যে দয়া ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারি, তা একটা সুবর্ণ মুদ্রার মতোই মূল্যবান এবং উজ্জ্বল! তা একেবারে খাঁটি সোনা–আঘাত করলে তার মাঝে একটুখানিও নকল পাওয়া যায় না।
কৃপণ জীবন ভরে এক একটা মুদ্রা প্রাণের রক্তের মতো সঞ্চয় করে। আমরা কি সুন্দর সুন্দর মহৎ কাজ করে, কৃপণের মতো জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের সুবর্ণ মুদ্রাগুলি সঞ্চয় করতে পারি না? তাতে যে আমাদের জীবনের মূল্য কত বেড়ে যাবে?পার্থিব ধন-সম্পদ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হবে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজগুলি যেমন আমাদের চিত্তকে প্রসন্ন করে, তেমনি অক্ষয় সুবর্ণরেখার মতো চিরদিন মনুষ্য আত্মাকে সম্পদশালী করে।
পুলিশের নাম শুনলে মানুষ বিরক্ত হয়, থানা-ঘর দেখলেই সেইখান থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ ঘৃণায় সরে যায়। মানুষ থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করছে, কিন্তু যে স্থানে পীড়িত মানুষ নিজের মর্মব্যথা নিবেদন করে, যেখানে অত্যাচারিত দীন-দুঃখী আশ্রয় পায়, সেই স্থান কি সত্যই অপবিত্র? মানুষ নিজের দোষে থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করেছে। পবিত্র বিচারস্থানের মূল্য এবং মর্যাদা প্রকৃত খোদাভক্ত এবং ধার্মিক লোকদের কাছে চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকবে–তারা থানা-ঘরের সংস্রবেই বা বাইরের লোকই হন।
আলী নামক এক পুলিশ কর্মচারী একদা এক রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, এক অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা স্টেশনে কাউন্টারের কাছে এসে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেট চাইল। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন, রাত্রিকালে গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে যাবেন।
যুবক দেখলেন–মাস্টারের ব্যবহার সন্দেহজনক। মহিলাটি ভদ্রঘরের বলেই মনে হয়; মাস্টারের কথায় সন্দেহ করে মহিলাটি আর বিলম্ব না করে বিনা টিকেটেই গাড়িতে উঠে পড়ল। পুলিশ যুবকটিও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মহিলাটির উপর রেখে মহিলার গাড়িতেই এক প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।
তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। মাহিলাটির হাতে একটা পোটলা ছিল, খুব সম্ভব তাতে কতকগুলি দামি গহনা ছিল। পুলিশ যুবকটি তাকে লক্ষ্য করে বসেই আছেন। ২/৪ স্টেশন যেতেই একটা লোক হঠাৎ গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মহিলার সঙ্গে ভারি আলাপ শুরু করে দিলো। এমন কি কয়েক মিনিটের আলাপে মহিলাটি যে তার অনেক জন্মের মা, এই কথা প্রকাশ করে ফেলল। পুলিশ-যুবক লোকটির সব কথা লক্ষ্য করেছেন। তারপর এক স্টেশনে এসে লোকটি মহিলাটিকে লক্ষ্য করে বলল, “আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব। আজ গরিব সন্তানের বাড়িতে বিশ্রাম করুন, কাল আপনাকে একেবারে নিজে গিয়ে বাসায় রেখে আসব।” ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এক উঁকিলের বউ, শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে রাগের মাথায় এক কাপড়ে স্বামীর কাছে যাবে বলে বেরিয়ে এসেছে; বেরিয়ে যখন পড়েছে তখন আর উপায় নাই। পথে এসে অন্তরে তার বিলক্ষণ ভয় হয়েছে। লোকটির কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সেখানেই নেমে পড়ল, পুলিশ-যুবকটিও সেখানে নেমে পড়লেন। নেমে পড়েই তিনি মহিলাটিকে আটকে রাখবার জন্যে টিকেট কলেকটরকে বললেন, “এই মহিলাটির কাছে টিকেট নাই, একে আটক করুন।” জুয়াচোর লোকটি তাকে মহাবিপদে ফেলবার চেষ্টা করছিলো তা সে বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগল। সেই বদমায়েশ লোকটি ইত্যবসরে সরে পড়েছিল। মহিলাটি তখন আরও বেশি করে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। পুলিশ যুবক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আপনার কোনো ভয় নাই।” তার স্বামীর ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে, যুবক তৎক্ষণাৎ সেখানে একটি টেলিগ্রাম করে দিলেন। তারপর মহিলাটিকে গার্ড সাহেবের জিম্মা করে বললেন, “এর জন্যে আপনি দায়ী, কোনো বিপদ হলে আপনাকে সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে।” গন্তব্যস্থানের স্টেশন মাস্টারের কাছেও তিনি একটা তার করে দিলেন, মাহিলাটিকে যেন সযতে স্টেশনে অপেক্ষা করবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় এবং তার স্বামী উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত যেন তিনি তাকে আপন হেফাজতে রেখে দেন।
এর কয়েক দিন পরেই ভদ্রমহিলার স্বামী ‘বেঙ্গল’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সহৃদয় পুলিশ যুবকটির সাহায্য না পেলে তার যে কী বিপদ হত, তা চিন্তা করাও কঠিন।
মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের পরিচয় দেবার সুযোগ পুলিশ কর্মচারীদের যেমন আছে তেমন আর কারো নাই।
দুর্বলের যারা রক্ষক, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে যাদের জীবন, তারা কি লোভের সম্মুখে বিচলিত হবেন? শুধু অবস্থা ভালো করে কি হবে? মনুষ্যত্বের কাছে আর কি অধিকতর গৌরবের বিষয় আছে?
কয়েক বৎসর আগে একজন লোককে একটা জাল টাকা নিয়ে কলিকাতার এক মিঠাইওয়ালার দোকানে গিয়ে কিছু মিঠাই চাইতে দেখেছিলাম। দোকানদার মিষ্টান্নগুলি একটা পাতায় বেঁধে লোকটির হাতে দিয়েছে, আর ডান হাতে টাকা ধরেই চিৎকার করে বলে উঠল–শয়তান! পাজী’–আরও অনেক অশ্লীল ভাষায় সে গাল দিল। গোলমাল শুনে,আমি এগিয়ে গিয়ে শুনতে পেলাম, পথিক সবিনয়ে বলছে, “ওটি জাল টাকা তা আমি জানি নে, তুমি মাফ কর। আমার কাছে আর পয়সা নাই। তোমার মিঠাই তুমি ফিরিয়ে নাও।” মিঠাইওয়ালা বললে, “তোমার ছোঁয়া জিনিস আর ফিরিয়ে নেবো না–পয়সা ফেলো, নইলে জুতো খাবে।” পথিক ভারি অপ্রস্তুত হল! তার হাতে সত্য সত্যই আর পয়সা ছিল না। টাকাটি জাল তা পথিক জানত বলেই মনে হল, অভাবগ্রস্ত বলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে মিঠাইওয়ালাকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল। তার চোখে-মুখে অপরাধীর দীনতা, আমি দেখতে পেলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি ভদ্রলোক এসে তার পকেট হতে পয়সা তুলে মিঠাইওয়ালার দাম চুকিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সে স্থান ত্যাগ করলেন। অপরাধী লোক। তার আন্তরিক কমতোজ্ঞতা কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না; সে ভদ্রলোকের পেছনে পেছনে ছুটল, আমিও তার পেছনে পেছনে চলোম–লোকটি কী বলে, আর ভদ্রলোকই বা কী বলেন, তাই শোনার জন্যে।
অনেক দূর দৌড়িয়ে গিয়ে ভদ্রলোকটির সম্মুখে দাঁড়ালাম। অপরাধী পথিকটি তখনও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছিল। আমি দেখলাম সেই ভদ্রলোকের মুখে খোদার জ্যোতি। খোদাকে চোখে দেখি নাই, কিন্তু মানুষের মুখে তার ছায়া দেখলাম।
নিম্নস্তরের লোক, যাদের কৃষক বলে অবজ্ঞা করি, তাদের ভিতর খোদায়ি (Divine) ভাব কেমনভাবে ফুটে উঠে, তা নিম্নলিখিত আর একটি ঘটনায় বেশ জানা যাবে।
অনেক বছর আগে একদা চুয়াডাঙ্গা হতে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যন্ত যে রাস্তা এসেছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। তখন হেঁটে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রাস্তা দীর্ঘ ৪০ মাইল। পথের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে বসে এক কৃষককে বিড়ি খেতে দিয়েছিলাম। তখন আমার বাল্যকালের ধূমপানের কুঅভ্যাসটি ছিল।
এক দু’বছর পর আর একদিন আমি চুয়াডাঙ্গা হতে রওয়ানা হই। রাস্তা অতিশয় বিপজ্জনক–দুই ধারে বিরাট মাঠ। ১৬ মাইল আসার পর সন্ধ্যা হয়ে গেল, পাগুলিও অবশ হয়ে এসেছিল; কোথাও আশ্রয় চাইবার অভ্যাস আমার ছিল না। এদিকে ওদিকে না চেয়ে অতিকষ্টে অগ্রসর হতে লাগলাম। ক্রমে রাত্রি অনেক হল, আমিও আর পথ চলতে পারি না। যতই অগ্রসর হই পথ ততই দীর্ঘ বলে মনে হতে লাগল। ঝিনাইদহের প্রায় ৬ মাইল দূরে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন দুই ধারে বিরাট দৈত্যাকার গাছের সারি–মনে হতে লাগলো, গাছের ডালে ডালে ভূতেরা সব হেসে বেড়াচ্ছে, জনমানবশূন্য রাস্তা। চাঁদের আলো ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের ভিতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে এখানে-ওখানে উঁকি মারছিল।
পা আর চলে না, তবুও এগোচ্ছিলাম, কারণ তখন আর কোনো উপায় ছিল না। ভয় যা হচ্ছিল, তো খোদাই জানেন। এর উপর সম্মুখে রাস্তার পার্শ্বে গভর্নমেন্টের মরা কাটবার (Post mortem) ঘর।
এমন সময় দেখতে পেলাম, দুটি লোক অপর দিক থেকে আসছে। ভাবলাম এরা এখনই আমায় অতিক্রম করে চলে যাবে। আমি যে অবস্থায় আছি, সেভাবেই এগোতে হবে। আর উপায় কী?
একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে?” আমি উদাসীনভাবে বললাম–”পথিক!” পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম, তা সে লক্ষ্য করেছিল। বললে, “এত রাতে একা একা–এখনও অনেক পথ বাকি।”
আমি ভীতকণ্ঠে বললাম, “তা হলে, আর কী করি? কোনো উপায় দেখি না”।
এমন সময় লোকটি বললে, “আমি তো আপনাকে চিনি, (কী একটা স্থানের নাম করে সে বলল) দু’বছর আগে আপনি অমুক স্থানে আমাকে বিড়ি খেতে দিয়েছিলেন–কেমন, না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ!” একটা বন্ধুর দেখা পেয়েছি বলে আমার মনটি একটু আশান্বিত হয়ে উঠলো।
সে বললো, “চলুন, নিকটেই রাস্তার ধারে বাড়ি। রাত্রিতে আমার বাড়ি থাকবেন। ভোরে উঠেই রওয়ানা হবেন। কী মহাবিপদ আপনার যে, এ অবস্থায় এই রাত্রিতে আপনি একা এতদূরে চলেছেন।” আমি লমিতো হয়ে বললাম, “আমার হাঁটবার ক্ষমতা নেই; বেশি দূরে হলে কী করে যাবো?”
সে বললে, “আচ্ছা, তা হলে নিকটেই এক বাজার আছে, সেখানে কোনো দোকান ঘরে আপনাকে শুয়ে রেখে দি, প্রাতে উঠে চলে যাবেন।” আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরলাম। কিছু দূরে হেঁটেই একটা বাজার পাওয়া গেল। বাজারের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কৃষক প্রত্যেক দোকানীকে আমার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইল। কেউ অপরিচিত লোককে স্থান দিতে স্বীকৃত হল না। অগত্যা কৃষক বন্ধুটি আশ্বাস দিয়ে বললে, “অনেক দূরে হেঁটে এসেছেন, আর কিছুদূর গেলেই আমার বাড়ি। একটু কষ্ট করে আস্তে আস্তে চলুন।” অগত্যা স্বীকৃত হলাম।
অনেক কষ্টে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে আমায় অতি উত্তম খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আহার করালে এবং উৎকৃষ্ট বিছানা দিয়ে আমাকে শুয়ে রাখলে। এই কৃষকের কথা যতবারই ভাবি, ততবারই আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।
ভাবি, তার সঙ্গে আর কোনো দিনও দেখা হবে না, তার কোনো উপকার করি নাই। নিঃস্বার্থ প্রেমের পরিচয় মানুষ খোদার ভাবে অভিভূত হয়েই দেয়।
মানুষের একদিক পশুর অন্যদিক তার খোদাময় প্রভাত-সৌন্দর্যের মতো নির্মল, মধুর জননীর বুকের মতো সরল। খোদায়ীভাবে মনুষ্য মনুষ্যের নমস্য।
নিরক্ষর মানুষের মধ্যে আমরা অনেক সময় আশ্চর্য ত্যাগ ও মহত্ত্বের পরিচয় পাই, সেরূপ মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকেরাও দেখাতে পারেন না। আমরা এখানে পল্লীগ্রামের একটা সামান্য মানুষের দৃষ্টান্ত দিতে চাই যার হৃদয়ের বিশালতা অনেক মানুষের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে। মাগুরা মহকুমার হাজীপুরের জরদার বংশের তমিজুদ্দীন জরদার নিজ জীবনে প্রায় ৮ হাজার টাকার সম্পত্তি ক্রয় করেন। এর মধ্যম ভ্রাতা তার একমাত্র শিশুপুত্রকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তমিজুদ্দীনের হাতে সমর্পণ করে এর পূর্বেই অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন। তমিজুদ্দীনের আর একটি ভ্রাতা ছিলেন তিনি সর্বকনিষ্ঠ। জীবনের সঞ্চিত সমস্ত ধনই এই কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাতে তিনি রাখতেন এবং তার হাত থেকে খরচ হত। তমিজুদ্দীন ভ্রাতাকে এতই স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন যে, তিনি খরচের বা রাশি রাশি জমান টাকার কোনো হিসাবই রাখতেন না। এত করেও তমিজুদ্দীন শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায়, বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করেন। মৃমতো মধ্যম ভ্রাতার পুত্রকে তিনি আপন অর্জিত ভূসম্পত্তির শ্রেষ্ঠ অংশ দান করে যান। আপন পুত্রদ্বয়কে সংসারের জমান টাকার কিছুই দেন নাই, স্থাবর সম্পত্তির অতি সামান্য অংশই এরা পেয়েছিল। এই উদার হৃদয় ব্যক্তি নিরক্ষর ছিলেন; তার ত্যাগ ও মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে।
মনুষ্য যখন মহত্ত্বের পরিচয় দেয়, তখন আর সে মানুষ থাকে না। তখন খোদায়ি ভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়। জগতের সমস্ত হীনতা অতিক্রম করে মানুষ তখন মহাগৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
.
০৭. স্বভাব-গঠন
বাক্যবাগীশ, কথায় চতুর ও তার্কিক হওয়া খুব সহজ, কিন্তু তিল তিল করে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা বড় কঠিন। প্রত্যেক মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজই হচ্ছে নিজের স্বভাবকে গঠন করে তোলা।
ইহাই মানুষের কাছে শ্রেষ্ঠ কাজ, মানুষের কাছে ইহা অপেক্ষা আল্লাহর বড় আদেশ আর নাই। এই পরম আদেশের উপর যারা কথা বলে, তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। মনুষ্য আপন স্বভাবকে খোদার অনুযায়ী গঠন করে তুলবে, এই-ই খোদার উপাসনা। নিজের স্বভাবকে পরিবর্তন না করে, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করবার কোনো সার্থকতা নাই। যে আল্লাহকে ভালোবেসেছে, সেই আপন স্বভাবকে সংযত করেছে, মিথ্যা পরিহার করেছে, খোদার জীবনকে ভালোবেসেছে, পশুকে আঘাত করতেও সে থমকে ভেবেছে।
খোদার জন্য যে তর্ক করে, তার মূল্য খুব কম। ইসলাম শ্রেষ্ঠ এই কথা বলবার জন্য যে মহাআস্ফালন করে, তারও মূল্য খুব কম। যে মিথ্যা পরিহার করে, আপন স্বভাব গঠন করে, সেই প্রকৃত খোদা-ভক্ত, সেই পরম শান্তিতে আছে, সেই মুসলমান। মুসলমানের অর্থ তর্ক নয়, আস্ফালন নয়, এর অর্থ নীরবে নিজকে গঠন করে তোলা। ইসলাম মানে কাজ–বাক্য নয়।
আল্লাহ চান না তোমরা শুধু ইসলামের মহিমা কীর্তন কর, তিনি চান তোমরা মুসলমান হও, নিজ নিজ স্বভাব খোদায়ি ভাবে গঠন কর।
হযরত মোহাম্মদ (দঃ) সম্বন্ধে বলা হয়েছে–”নিশ্চয়ই তোমার স্বভাব উত্তম।” যে নিজ স্বভাবকে উত্তমরূপে গঠন করেছে, সেই প্রকৃত নবীভক্ত; যে শুধু মুখে চিৎকার করে দরূদ পাঠ করে, সে নবী-ভক্ত নয়।
হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন–”আমি নীতিশাস্ত্রকে পূর্ণ করতে এসেছি।” ইসলাম নীতিময় জীবন।
মানুষের সুন্দর মুখ দেখে আনন্দ্রিত হয়ো না। স্বভাবে যে সুন্দর নয় দেখতে সুন্দর হলেও তার স্বভাব, তার স্পর্শ তার রীতি-নীতিকে মানুষ ঘৃণা করে। দুঃস্বভাবে মানুষ মানুষের হৃদয়ে জ্বালা এবং বেদনা দেয়, তার সুন্দর মুখে মনুষ্য তৃপ্তি পায় না। অবোধ লোকেরাই মানুষের রূপ দেখে মুগ্ধ হয় এবং তার ফল তারা ভোগ করে।
যার স্বভাব মন্দ, সে নিজেও দুষ্ক্রীয়াশীল মিথ্যাবাদী দুর্মতিকে ঘৃণা করে। মানুষ নিজে স্বভাবে সুন্দর না হলেও সে স্বভাবের সৌন্দর্যকে ভালোবাসে।
স্বভাব-গঠনে কঠিন পরিশ্রম ও সাধনা চাই, নইলে শয়তানকে পরাজিত করা সম্ভব নয়।
যে স্বভাব-গঠনে চেষ্টা করে, চিন্তা করে, সে এবাদত করে।
মানুষের পক্ষে একদিনে ফেরেস্তা হওয়া সম্ভব নয়। ধীরে, অতি ধীরে, বহু বৎসরের সাধনায় এমন কি সমস্ত জীবন ধরে নিজেকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যেতে হবে। মন্দের সঙ্গে আমাদের জীবন এমনিভাবে জড়িত আছে যে, একে ত্যাগ করে আপন স্বভাবকে বিশুদ্ধ করা এক মহাকঠিন সাধনা। দিনের প্রতি কাজে, বাক্যে আমরা পতিত হই। প্রতিদিনকার রহস্য এবং আলাপে আমরা গোপনে গোপনে হীন এবং মূঢ় হই। কে আমাদের জীবনের এই শত গোপন কলঙ্ক হতে রক্ষা করবে?
জীবন গঠন করবার জন্যে ধীরে ধীরে চেষ্টা কর, কখনও ভীত হয়ে পশ্চাদপদ হয়ে না। সংসারে যারা কাপুরুষ তারাই স্বভাব গঠনের কঠিন কর্তব্য শক্তিহীনের শৈথিল্যে ত্যাগ করে পলায়ন করে। বীরের মতো সাহসী হয়ে সম্মুখে দাঁড়াও। ভয় পেয়ো না–পালিও না। পালালেই সর্বনাশের গভীর কূপে পতিত হবে। চিরদিনের জন্যে জীবনের অফুরন্ত গৌরব রাজ্য হয়ে ফিরে আসবে। দুর্গ জয় করতেই হবে, মানব জীবনের সুমহান সাধনা ত্যাগ করে পশুদের একজন হয়ো না।
এখানেই মানুষের সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞানের পরীক্ষা হয়–কে কতখানি নিজকে গঠন করতে পেরেছে।–মিথ্যা, লোভ, দ্বেষ, হিংসা, দুর্বলতা কে কতখানি জয় করতে শিখেছে। তুমি কি মিথ্যা বলে থাক? তা হলে চেষ্টা কর–পুনঃ পুনঃ চেষ্টা কর–মিথ্যাকে পরিহার করে চলবার জন্যে। তুমি কি অন্তরে মিথ্যা গোপন করে মানুষের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। গোপনে আপন মনে লমিতো হও–শতবার লমিলতা হও। জীবনের গৌরব রক্ষা করবার জন্যে সর্বদাই চেষ্টা কর; মনুষ্য তোমায় বুঝতে পারুক আর না পারুক।
তোমার প্রবৃত্তি কি নীচ? তা হলে সাবধান হও–চিন্তা কর, নিজেকে সংশোধন কর, কারণ পশুর স্বভাব মনুষ্যের পক্ষে ইহা লজ্জাজনক।
যৌবনের উষ্ণ রক্তে তুমি কি মানুষের উপর হঠাৎ তোমার বজ্রমুষ্টি উত্তোলন কর? ক্ষান্ত হও, সহিষ্ণু হয়ে আপন কাজের তুমি সমালোচনা কর। শীঘ্রই মানুষের রক্ত নিস্তেজ হয়ে যায়, বার্ধক্যে শরীরের পেশীসমূহ দুর্বল হয়ে পড়ে। তুমি যাকে আঘাত করতে যাচ্ছ সেও এক সময় তোমারই মতো শক্তিশালী ছিল।
তুমি কি টাকার গর্বে মানুষের সঙ্গে উপহাসের সঙ্গে কথা বল? তা হলে সাবধান হও। কারণ তোমার চাইতে বড় মানুষ এ জগতে বহু এসেছিল–তারা ধুলায় মিশেছে।
তুমি কি নিষ্ঠুর? ইহা পশুর স্বভাব। মনুষ্য হয়ে কেমন করে তুমি নিষ্ঠুর হবে? তুমি আপন নিষ্ঠুর স্বভাবের জন্য লমিতো হও।
বয়য়াজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ ব্যক্তিকে সম্মান করতে কি তোমার লজ্জা হয়? গর্বে তোমার সমস্ত মানুষকেই অবজ্ঞা করতে ইচ্ছা হয়? তা হলে অনুতপ্ত হও–কারণ বিনয়ই মানুষের ভূষণ।
গর্বিত শয়তান চিরদিনই আল্লাহ্ এবং মনুষ্যের ঘৃণার পাত্র। মনুষ্যের গর্ব করবার কিছুই নাই। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিনয়ই গৌরব করেন, গর্বে তাঁরা মর্যাদাশীল নন।
তোমার কি অনবরত পরের নিন্দা করতে ইচ্ছা হয়? নিন্দুককে সমস্ত জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিই ঘৃণা করেন। নিন্দুক সমস্ত মানুষের শত্রু-নিন্দাই তার ব্যবসা। সে মানুষের গুণকে শ্রদ্ধা করে না, মানুষের মূল্য তার কাছে কিছুই নয়।
মনুষ্য রাজাকে ভক্তি করে না। কিন্তু উত্তম স্বভাবকে সে আন্তরিক ভালোবাসে এবং শ্রদ্ধা করে। মানুষের কাছে যদি লমিলতা ও নিন্দিত হয়ে বেঁচে থাকতে হয়, তার চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
উত্তম স্বভাবের অর্থ–অন্যায়কে সমর্থন করা নয়, শুধু মানুষের প্রশংসা লাভের সাধনাও নয়। কারণ, যে সবাইকে তুষ্ট করতে চায়, সে কাউকেও সন্তুষ্ট করতে পারে না।
স্বভাব যার উত্তম, সে সর্বদাই নীতিবান, মিথ্যাকে সে আন্তরিক ঘৃণা করে, প্রাণ গেলেও সে মানুষকে তুষ্ট করবার জন্যে অন্যায় ও মিথ্যাকে স র্থন করে না। সে মিথ্যাকে সাক্ষ্য দেয় না। অন্তরে পাপ, মুখে তার মধু নয়। সে বিনয়ী, ভদ্র এবং সহিষ্ণু। সে মানুষের দাবীকে নষ্ট করে না, সে কখনও অভদ্রের মতো কথা বলে না। মানুষকে ইতর ছোটলোক বলে উপহাস করে চলা তার স্বভাব নয়। সে জ্ঞানবান, কারণ জ্ঞানী ব্যতীত সূক্ষ্মভাবে জীবনের অন্যায় এবং ন্যায় কোনোমতে অনুভব করা যায় না। সকলের প্রতিই তার সহানুভূতি আছে। সে আত্মসর্বস্ব নয়। শুধু নিজের সুখের চিন্তাতে সে ব্যস্ত থাকে না। মানুষ তার যতটুকু দেখে, সে ততটুকুতেই শুদ্ধ এবং সুন্দর নয়। নিজের চোখে সে আপনাকে যতটুকু দেখে, ততটুকুতেই সে সুন্দর। সে যেমন নিজের সম্মান বোঝে, অন্যের সম্মানও সে। তেমনি বোঝে। তার দৃষ্টি অতিশয় তীক্ষ্ণ, সে হৃদয়তা প্রদর্শনে কোনো সঙ্কোচ করে না।
একদা কানাডা শহরে এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সমস্ত বোঝা তার দুর্বল পত্নীর ঘাড়ে চাপিয়ে গর্বিতের ন্যায় যাচ্ছিলেন। স্যার এডওয়ার্ড তাড়াতাড়ি সেই নারীর বোঝাটি নিজের পিঠে নিয়ে তাঁকে ভারমুক্ত করলেন। বস্তুত উত্তম স্বভাবের মানুষ দুর্বল এবং শক্তিহীনের উপর কষ্টের ভার চাপিয়ে নিজে সুখ পান না। নিজে শুয়ে বসে দুর্বল নারীকে দিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ করিয়ে নেওয়া হৃদয়হীনতার পরিচায়ক।
মানুষের মধ্যে ছোটলোক এবং ভদ্রলোক বলে কোনো কথা নাই। স্বভাব যার উত্তম, সেই ভদ্রলোক। নীচ বংশে জন্মেও যদি মানুষ স্বভাবে উত্তম এবং উন্নত হয়, সে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র। যে নমস্কার করে, মাটির আসনে বসে আছে, সে হয়তো অনেক সময় যে উচ্চাসনে বসে আছে তার চাইতে শ্রেষ্ঠ এবং উত্তম।
.
০৮. জীবন সাধনা
জাগতিক অভাব মানুষের বেদনা উপহাসের জিনিস নয়। জাগতিক দুঃখ ও দৈহিক অভাবের ভিতর দিয়েই আল্লাহ্ তার মহিমা এবং গুপ্ত ভাব প্রকাশ করেন। সুতরাং দেহের অভাবকে উপহাস করলে চলবে না, দেহের কথা ভাবতে হবে।
এই দেহের অভাবের জন্য মানব-সংসারে কত পাপই না অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আল্লাহ্ যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, সে প্রতিজ্ঞায় মনুষ্য বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাই। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন, ক্ষেতের পুষ্প কেমন সুন্দর, পক্ষীরা আহারের চিন্তায় ব্যস্ত হয় না অথচ গলা ভর্তি করে সন্ধ্যাকালে তারা কুলায় ফিরে আসে। আল্লাহ্ মানুষের কথা কি ভুলে যাবেন? মানুষকে তিনি আরও বেশি ভালোবাসেন, মানুষকে কি তিনি আরও বেশি সুশোভিত করবেন না?
আল্লাহ্ আর এক জায়গায় বলেছেন, আমার বান্দার কাছে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করি নাই।
তবু মানুষ আল্লাহকে বিশ্বাস করে নাই। অবৈধ মিথ্যা পথে সে অন্ন এবং বস্ত্রের সন্ধানে ফিরেছে। অন্ন এবং বস্ত্রের জন্যে মানুষ কী পাপই না করেছে, তা ভাবতেও মন। অস্থির এবং ভীত হয়ে ওঠে। আত্মাকে বিনষ্ট করে সে বেশ্যা নারীর শুভ্র পোশাকে দেহকে সমিতো করেছে, অবৈধ অন্ন মুখে তুলে দিয়েছে।
কেন জীবনের পথ এত জটিল করে নিলে তোমরা? কে তোমাদের এই সর্বনেশে শিক্ষা দিয়েছে? আত্মাকে অপবিত্র করে, প্রাণঘাতী দারিদ্র্য-দুঃখকে বরণ করে জীবনকে ব্যর্থ করে দেবে? এরই নাম কি দ্ৰতা? এ ভদ্রতা কে শিখিয়েছে তোমাদের? পরিশ্রম করতে লজ্জাবোধ কর? শ্রমকে তোমরা সম্মান করতে জান না? চৌর্য, হীন দাসত্ব, কাপুরুষতা, আত্মার দীনতা ও মিথ্যার পোশাক তোমাদের কাছে ভদ্রতা? ৬০ টাকা বেতনে চাকরি করে অসৎ উপায়ে মাসিক ২০০ টাকা আয় করতে তোমাদের মনুষ্যত্ব লমিতো হয় না? আর এই চুরি করার সৌভাগ্য কয়জনের হবে? এ যে বিনষ্ট হবার পথ।
পরিশ্রমকে তোমরা সম্মান করলে বুঝতে পারবে, কয়লার মধ্যে, কল-কারখানার ধুলা বালির মাঝে, মাঠের কাদায়, কামার ঘরে অগ্নিস্ফুলিঙ্গে তোমাদের মনুষ্যত্ব ও শক্তি লুকিয়ে আছে। দুর্বল, কাপুরুষ, শক্তিহীন, ধর্মহীন, দুঃখী হয়ে তোমরা মরো না। চাকরি ক’টি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে? চাকরির নেশা ত্যাগ করে তোমরা দিকে দিকে ছুটে পড়। পাশ্চাত্য দেশে মানুষ শিল্প ও দৈহিক পরিশ্রমকে সম্মান করতে শিখেছে–কত প্রতিভা কত স্থানে আপন আপন জীবনকে সার্থক করেছে। তারা মানুষ, তাদের শক্তিতে সমস্ত জাতির দেহে অফুরন্ত শক্তি সঞ্চিত হয়েছে, তারাই জাতির মেরুদণ্ড এবং প্রাণ। কয়েকজন কেরানি ইংরেজ জাতিকে গিরি লঙ্ঘন করতে, আকাশে উড়তে, সমুদ্র অতিক্রম করতে শিক্ষা দেয় . নাই। কী অফুরন্ত বিরাট শক্তি সমস্ত জাতির দেহে রক্ত প্রবাহের কর্ম প্রেরণা ঢেলে দিয়েছে।
জাহাজ-নির্মাণ, কামান-বন্দুক তৈরি, অসংখ্য কলকজা, তালা-চাবি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, ছাপাখানা, কৃষি, অস্ত্র-সরঞ্জাম, স্থপতি শিল্প, ভূ-তত্ত্ব, খনি, চারুশিল্প, বস্ত্র তৈরি, সুঁই, সূতা, বাদ্যযন্ত্র, শিশি-বোতল, ধাতুর পাত্র, বাসন ও কাঁচ নির্মাণ প্রভৃতি লক্ষ্য করার কাজে নিজেদের প্রতিভা তাঁরা নিয়োগ করেছেন–শুধু চাকরির সন্ধানে তাঁরা তাঁদের জীবন। ব্যর্থ করে দেন নাই। জাতির অভাব চাকরিতে পূরণ হবে না। এর ফলে দেশে পরস্পর বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ বেড়েই উঠবে অভাবে দেশের মানুষের মনুষ্যত্ব থাকবে না।
জ্ঞান ও বিদ্যালোচনা চাকরির জন্য নয়। জ্ঞান মানুষের জীবনকে অসংখ্য প্রকারে সফল করবার সুযোগ ও সুবিধা করে দেয়। জ্ঞানকে দাসত্বের কাজে নিয়োগ করে জ্ঞানের মর্যাদা নষ্ট করো না। জীবনে ঘুমন্ত শক্তি, মস্তিষ্কের সহস্র লুকান ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলবার অমোঘ উপায় হচ্ছে জ্ঞান।
এ দেশে কি শিল্প চর্চা ছিল না? দেশের মানুষ কি কোনো কালে শিল্প প্রতিভার পরিচয় দেয় নাই? আল্লাহর সৃষ্টি এদেশে মানুষের সঙ্গে ইউরোপের মানুষের কি কোনো পার্থক্য আছে? যদি জাতি চাকরির নেশা ত্যাগ করে তার সমস্ত শক্তি বিবিধ পথে নিয়োগ না করে, তা হলে আবার বলি, জাতির দুঃখ বেড়েই যাবে। অভাব ও দুঃখের অন্ত থাকবে না। যে জাতি অভাব ও দুঃখ ভোগ করে, জগতে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করো না। এম,এ, পাস করে তোমরা কখনো বাবুটি হয়ো না, এই হচ্ছে সর্বনাশের কথা। হাতের ক্ষমতোকে অবহেলা করো না। কুলির মতো সর্বত্র কাজ কর, কাজই জগতের প্রাণ। জগৎ বাবু হওয়ার, বসে বসে শুধুই চিন্তা করবার ক্ষেত্র নয়। জগৎ চায় কাজ। এই যে দেশে কৃষক, কামার, তাঁতী, জেলে, স্বর্ণকার, কাঠের মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, মালী, চিত্রকর, শিল্পী, ভাস্কর–এরা কি অশ্রদ্ধার পাত্র? লেখাপড়া জানে না বলেই এরা মানুষের অশ্রদ্ধা ভোগ করছে। জাতির বাচবার যন্ত্রপাতি এদেরই হাতে। যেদিন এরা লেখাপড়া শিখবে, সেদিন জাতির পরিচালক হবে এরাই। এদের ইচ্ছায় জাতি উঠা-বসা করবে। যদি বাঁচতে চাও দেশের যুবক সম্প্রদায়কে বলি, লেখাপড়া শিখে সর্বপ্রকার হীনতাকে উপহাস করে তোমরা তোমাদের দুইখানি হাতকে নমস্কার করে নাও। তোমাদের ভিতর যে শক্তি আছে, সে শক্তিকে ভাড়া না দিয়ে স্বাধীনভাবে নিজের এবং জাতির মঙ্গলের পথে নিযুক্ত কর, সকল দেশের সকল জাতির মুক্তির পথই এই। প্রাচীন এবং বর্তমান সমস্ত উন্নত জাতির পানে তাকাও–দেখতে পাবে, তারা কখনও পরিশ্রমকে অশ্রদ্ধা করে নাই।
দীর্ঘদিনের পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং সহিষ্ণুতা ব্যতীত কোনো কাজে সফলতা লাভ হয়। মানুষ ইচ্ছা করে, তাই সম্ভব। চাই একাগ্রতা, বিশ্বাস এবং সাধনা। আন্তরিকতা ব্যতীত কোনো কাজেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়। জগতে যে সমস্ত উত্তম উত্তম কাজ দেখতে পাচ্ছ, তা কঠিন পরিশ্রম, ত্যাগ এবং দুঃখের ফল। ইংরেজ জাতিকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় এরা বড্ড বাবু; আমরা এত খাঁটি, তার প্রতিদানে পাই এক মুষ্টি ছাতু, আর এরা ছায়ায় বসে এত সুখ ভোগ করে। এরা যে কত দুঃখ করেছে, উন্নতির সাধনায় এরা কত ত্যাগ স্বীকার করেছে, কত প্রাণ দিয়েছে, তার সীমা নাই। তোমরাও এইভাবে ত্যাগ স্বীকার কর, দুঃখ বরণ কর, হৃদয়ের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এবং নিজের ও জাতির কল্যাণ অর্জন করতে হবে।
কাজের ডাকে, কর্তব্যের ডাকে কাজ কর; শুধু অর্থলোভেই কাজে অগ্রসর হয়ো না। শুধু অর্থলোভে মানুষকে শ্রেষ্ঠ এবং পূর্ণ করে না। অর্থের মীমাংসা হলেই অর্থলোভীর সাধনায় জড়তা এবং শৈথিল্য আসে। শুধু অর্থ-লোভ জাতির শক্তিকে খর্ব করে দেয়। সমস্ত কর্ম-প্রেরণার অন্তরালে কর্তব্য বৃদ্ধি এবং জাতির প্রতি প্রেম মানুষকে শক্তিশালী এবং বিজয়ী করে। অর্থ যদি লাভ হয়, তবে তা কাজ করতে করতে ঘটনাক্রমে হয়ে উঠে।
সার জসুয়া রেনল্ডস্ বলেছেন, “যদি কোনো কাজে সফলতা চাও, তা হলে যখন ঘুম থেকে ওঠ, তখন থেকে নিদ্রা যাওয়া পর্যন্ত সেই কাজে সমস্ত চিন্তা, সমস্ত মন ঢেলে দাও।” বাস্তবিক ইহাই সফলতার পথ। কর্মী ও সাধকের কাছে সকাল নাই, দুপুর নাই, সন্ধ্যা নাই, কাজকে সর্বাঙ্গসুন্দর করবার জন্যে তিনি কাজের মধ্যে একেবারে ডুবে যাবেন। সাধনায় সিদ্ধি লাভের ইহা গুপ্ত রহস্য। অভাব, দারিদ্র অসুবিধা মানুষের সাধনার পথে কোনো কালেই বাধা হয় না।
বাধা অনেক সময় সাধকের জীবনকে দুঃখময় করে তোলে বলে দুঃখ করো না, যেহেতু জীবনের প্রতি চিরদিনই এমনি জটিল ও সমস্যাপূর্ণ। তোমাদের দুঃখ ও ত্যাগের ফলে যদি ভবিষ্যৎ মানব-সমাজ দুঃখ, কুসংস্কার, মূর্খতা ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়, সেই কথা চিন্তা করে মনে মনে আনন্দ কর। আজকাল এই দুঃখ নীরবে আঁখিজলে সয়ে যাও, আল্লাহর দয়ার কথা ভেবে কাজ করতে থাক। যদি সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয়, সেই দিন সমস্ত দুঃখের প্রতিদান পাবে। মানব-সমাজ তোমার কাছে একদিন কৃতজ্ঞ হবেই।
কোনো কাজ একবারে হয় নাই, আবার কর। আবার কর–যতবার না হয়, ততবারই কর। এর শেষে সিদ্ধি। প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তিরা হয়তো কোনো কাজ হঠাই করে ফেলেন, কিন্তু পরিশ্রম, চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ সফলতার পথ।
স্বর্ণকার, চিত্রকর, ভাস্কুর এবং ইঞ্জিনিয়ার সেলিনীর জীবন বড়ই চমৎকার। তাঁর পিতা ফ্লোরেন্সের রাজ দরবারে বেতনভুক্ত গায়ক ছিলেন। তার চাকরি গেলে পুত্রকে এক স্বর্ণকারের কাছে কাজ শিখতে পাঠান। অতি অল্পদিনের মধ্যেই বালক অনেক কাজ শিখে ফেলল। বাপের জিদে কিছুদিন তাকে এই সময় আন্তরিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঁশি বাজানো শিখতে হয়েছিল। এর কিছুদিন পর সেলিনী পোপের অধীনে স্বর্ণকার গায়করূপে চাকরি পান। তার সোনা, রূপা এবং ব্রোঞ্জ ধাতুর কাজ অতি আশ্চর্য। কারো সাধ্য ছিল না, তেমন কাজ করতে পারে। কোনো সুন্দর কারিগরের সংবাদ পেলেই সেলিনী তার কাজ দেখতেন এবং যাবৎ না দক্ষতা গুণে তাকে অতিক্রম করতে পারতেন, তাবৎ তার শান্তি থাকত না, তাঁকে পরাস্ত করা চাই, তার পর অন্য কথা। তাঁর কর্মশক্তি ছিল অসাধারণ।
শিল্পী চাট্র শিল্প-সাধনায় কতদিন মগ্ন থেকে যশের আসন লাভ করেছিলেন, তা পড়লে বিস্মিত হতে হবে। খুব ছোট বেলাতেই তার বাপ মারা যান। মা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করেন। এই অবস্থায় তাকে গাধার পিঠে শেফিল্ড শহরে দু’বেলা ঘরে ঘরে দুধ যোগান দিতে হতো। তারপর কিছু দিন এক মুদির দোকানে তাঁকে কাজ করতে হয়। একদিন রাস্তার পার্শ্বে তিনি কতকগুলি অতি সুন্দর খোদাই কাঠের কাজ দেখতে পান। এই কাজ শেখবার তাঁর আন্তরিক আগ্রহ হল। বলে-কয়ে কোনোরকমে মুদির কবল হতে রক্ষা পেয়ে সেই মিস্ত্রীর কারখানায় ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি সাত বৎসর কাজ করেন। ঐকান্তিক আগ্রহ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, প্রাণঢালা সাধনায় তাঁর কাজের তুলনা নাই। সাত বৎসরে তিনি একজন সুদক্ষ কারিগর হলেন। তাঁর অবসর সময় বিনা কাজে ব্যয় হত না। কাজের পূর্ণতা এবং চারুতার জন্যে কখনও চিত্র আঁকছেন, কখনও মাপজোক নিচ্ছেন–সঙ্গে সঙ্গে আত্মোন্তির জন্যে বইপুস্তক পড়াও কামাই নাই। এর কিছুকাল পরে আরও উন্নত জ্ঞান-লাভের জন্যে তিনি লণ্ডনে রয়েল একাডেমীতে ভর্তি হন। জীবন্ত মানুষের মূর্তি নির্মাণ, চিত্রবিদ্যা প্রভৃতি কার্যে তিনি অতিশয় খ্যাতি অর্জন করেন। সহিষ্ণুতা, সাধনা, অধ্যবসায় এবং কঠিন পরিশ্রম আর তার সঙ্গে তাঁর প্রতিভা তাকে বড় করেছিল। তিনি অতিশয় দানশীল ছিলেন, কিন্তু সে কথা কেউ জানত না।
যে কোনো কাজই কর–বাইরের উপদেশে বিশেষ কিছু লাভ হয় না। মানুষ মানুষকে কিছু শিখাতে পারে না। মানুষ মানুষকে একটু দেখায় মাত্র, নিজের ওস্তাদ নিজেকেই হতে হবে। পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে জগতের কোনো কাজেই কৃতিত্ব লাভ করা যায়। সাধনায় প্রাণ বিশ্বাস এবং আত্মনির্ভরতা কোথা থেকে বুদ্ধি যোগায়, পথ পরিষ্কার হয়ে আসে, তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। আল্লাহ মানুষকে এমনি পূর্ণ করে গঠন করেছেন যে, তার পরের কাছে হাত পাতবার আবশ্যকতা খুব অল্পই আছে।
শিল্পকে জীবনে অনেক সময় অপরিসীম দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে তা, ভেবে সাধক তার কাজ ত্যাগ করেন নাই। কত কর্মী মানুষের অশ্রদ্ধা এবং অবহেলায় প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছেন–তাঁদের সমাপ্ত সাধনায় নতুন নতুন সাধক পূর্ণতা এনে দিয়েছেন।
স্টকিং মেশিন–নির্মাতা রেভারেণ্ড উইলিয়াম লী এক নারীকে ভালোবাসতেন। লী ধর্মপ্রচারক ছিলেন। তিনি প্রায়ই প্রেম-প্রার্থী হয়ে তার প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। কিন্তু সেই নারী তাকে ভালোবাসত না, হাতে স্টকিং তৈরি করত, আর তার সহকর্মী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলত। লী প্রিয়তমার এই ব্যবহারে অতিশয় মনঃক্ষুণ্ণ হন। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন এমন এক যন্ত্র তৈরি করতে হবে যাতে আর কেউ হাতে স্টকিং তৈরি করতে না পারে। প্রিয়তমাকে শাস্তি দেবার মানসে তিনি চিন্তা আরম্ভ করলেন। একটা অতি লাভজনক ব্যবসায় এই প্রেমের দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়। লী প্রচারকার্য ত্যাগ করে যন্ত্রের সফলতার দিকে মন দিলেন। ঐকান্তিক সাধনার ফলে তিনি কয়েক বছরেই এই আশ্চর্য কৌশলময় যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হলেন। তার উদ্ভাবিত যন্ত্রটি নিয়ে তিনি প্রদর্শনের জন্য রানী এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করলেন। দরিদ্রের অন্ন মারা যাবে, এই কথা বলে রানী তাকে অশ্রদ্ধা করলেন। লী অতঃপর দুঃখে সে স্থান ত্যাগ করলেন। এই সময় ফ্রান্সের চতুর্থ হেনরী তাকে নিমন্ত্রণ করেন। তিনি কয়েকজন সহযোগী নিয়ে যন্ত্রপাতিসহ রুয়েন শহরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রুয়েন একটা প্রধান হস্তশিল্পের কেন্দ্র। সেখানে তিনি বিশেষ সমাদর লাভ করলেন। এখানে তার কাজের আদর হতে লাগল। দুর্ভাগ্যবশত এই সময়। একদল ধর্মান্ধ গোঁড়া সম্প্রদায় সম্রাটকে হত্যা করে। ফলে লীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনি রুয়েন ছেড়ে প্যারিস শহরে গেলেন। সেখানে সবাই তাকে ধর্মহীন এবং বিদেশী বলে অবজ্ঞা করলেন। একটি বিশেষ লাভজনক যন্ত্রশিল্পের উদ্ভাবক অতঃপর বিদেশে মনের কষ্টে, অবহেলায়, রোগে, দুঃখে প্রাণত্যাগ করেন। অতঃপর তার ভাই কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে স্বদেশে পালিয়ে আসেন। এই সময় আল বলে আর একজন সুদক্ষ শিল্পী তার সঙ্গে যোগ দিয়ে যন্ত্রটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর এবং সফল করে তুললেন। ক্রমে দেশের সর্বত্র স্টকিং মেশিনের সমাদর হল।
মানুষের কাজ এইভাবেই সমাদর লাভ করে। মানুষ প্রথম প্রথম কোনো কথা, কোনো সাধনার দিকে ফিরে তাকায় না। মানুষের এ স্বভাব, তা বলে ভাবনা করলে চলবে না।
জগতে এখনও অনেক কিছু নতুন করে তৈরি করবার আছে। জগতের যা কিছু প্রয়োজন তা মানুষের ত্যাগের ফলে তৈরি হয়ে থাকে–তারপর কাজে নেমে পড়লেই হয়। জাতির ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করবার জন্যে, পল্লীর দুঃখ দূর করবার জন্য এখন দেশের মানুষের অগ্রসর হওয়া মাত্র বাকি। হাত-পা গুটিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা না করে হাত-পা খাঁটিয়ে শক্তি ও মনুষ্যত্বের সদ্ব্যবহার করে নিজের এবং জাতির মঙ্গল চেষ্টা করাই উত্তম। জাতির না হোক, সমাজের না হোক, দেশের ছেলেরা যদি আপন আপন মা-বোনের সেবা করতে পারে, সাধু জীবন-যাপন করে প্রতিবেশীদের স্বার্থে আঘাত না করে, তা হলেই যথেষ্ট।
আর্থার হ্যাঁলাস বলেছেন–”ইংরেজ জাতির ভিতর থেকে শ্রমিক, শিল্পী, মিস্ত্রী ফেলে দাও, সমস্ত জাতিটা অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে। সমস্ত জাতির দেহটা তাদের ঘরের মতো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়বে। তাই বলছি কয়েকজন রাজ কর্মচারী এবং দেশের ভদ্রলোক এরাই জাতির শক্তি এবং প্রাণ, এ কথা পাগল ছাড়া আর কেউ মনে করে না। কোনো মানুষের কৃতিত্ব বিশেষত্ব এবং গুণ চাপা থাকবে না–সে ছুতোরই হোক, আর রাজমিস্ত্রী, গায়ক, কামার স্বর্ণকার, শিল্পী যাই হো–মানুষের অন্তনিহিত ক্ষমতো তার কাজের ভিতর দিয়ে তাকে শ্রেষ্ঠত্ব এবং সম্মান দান করবেই।
জর্জ কেম্প একজন সামান্য লোক ছিলেন। তাঁর পিতার সম্পত্তি ছিল কতকগুলি গরু ও ছাগল। প্রথম জীবনে তিনি সামান্য একজন মিস্ত্রীর কাছে শিক্ষানবীশি করেন। স্থাপত্য শিল্পে তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। ভালো উল্লেখযোগ্য নতুন, পুরাতন সুদৃশ্য অট্টালিকা দেখলেই তিনি তার চিত্র গ্রহণ করতেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ইউরোপ পরিভ্রমণ করতে মনস্থ করেন। তিনি পায়ে হেঁটে ইউরোপের বৃহৎ বৃহৎ প্রাচীন অট্টালিকা, দুর্গ এবং গীর্জা পরিদর্শন করেন এবং সেগুলির নক্সা হাতে গ্রহণ করেন। এডিনবরা শহরে স্কট মনুমেন্টের নক্সা প্রস্তুত করবার প্রতিযোগিতায় তিনিই প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাঁরই নক্সা অনুযায়ী এডিনবরায় এই বিখ্যাত সাহিত্যিক স্মৃতিমন্দির নির্মিত হয়।
অসংখ্য প্রকারে মানুষ নিজ নিজ জীবনকে উল্লেখযোগ্য করে তুলতে পারে। যে দেশের মানুষ এ বুঝে না, সে দেশের লোক দাস ও গোলামের জাতি ছাড়া আর কী? চাকরিকেই সম্মানের মাপকাঠি মনে করা যার পর নাই ভুল। জাতিকে সমৃদ্ধশালী করে তোলবার পথ এ নয়। জাতির শক্তির পশ্চাতে অনন্ত বিচিত্র জীবন ধারা দেশের শিরায় শিরায় খেলে যাচ্ছে। মিশর, পারস্য, ব্ৰহ্মদেশ, এশিয়া মাইনর প্রভৃতি ছোট ছোট দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা অর্থাগমের বিবিধ পন্থা আছে। আমাদের দেশেও থাকা চাই। একজন আর একজনের নাড়ী ছিঁড়ে খেলে কয়েকজন লোক ছাড়া বাকি সকল লোকই মারা যাবে। মিথ্যা ও মূর্খতার বিরুদ্ধে যুবক সমাজকেই বিদ্রোহী হতে হবে। অত্যাচারী মরুব্বীর দল যে চাকরিকেই সম্মানের জীবন মনে করে নিষ্ঠুর হস্তে সে মানসিকতাকে ভেঙ্গে না দিলে আর উপায় নাই। পরের গলগ্রহ হয়ে অসাধু পথে দাসত্বের লৌহচাপে, অভাবের অভিশাপে মানুষের জীবনীশক্তি এবং মনুষ্যত্ব দুই-ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবে। শ্রমকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ কর। কালি-ধুলার মাঝে, রৌদ্র-বৃষ্টিতে কাজে নেমে যাও। বাবু হয়ে ছায়ায় পাখার তলে থাকবার কোনো দরকার নাই। এ হচ্ছে মৃত্যুর আয়োজন। কাজের ভিতর কু-বুদ্ধি, কু-মতলব মানবচিত্তে বাসা বাঁধতে পারে না। কাজের শরীরের সামর্থ্য জন্মে, স্বাস্থ্য, শক্তি, আনন্দ, কূর্তি সবই লাভ হয়। মদ খেয়ে আনন্দ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। পরিশ্রমের পর যে অবকাশ লাভ হয়, তা পরম আনন্দের অবকাশ। শুধু চিন্তার দ্বারা জগতের হিত সাধন হয় নাই। মানব জাতির সমস্ত কল্যাণ বাহুর শক্তিতেই সাধন হয়েছে। মানুষের বাহু অত্যাচারিত মনুষ্য, পীড়িত-লাঞ্ছিত মনুষ্যকে উদ্ধার করছে, জগতের জালিমকে বিনষ্ট করেছে; রাক্ষসের মুখ থেকে নির্দোষ দুর্বল মানুষকে বাঁচাচ্ছে। কাপুরুষ ছাড়া মানুষের বাহুকে অন্য কেউ অশ্রদ্ধা করে না।
শুধু চিন্তা করে মানুষ পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হয়। মানব-সমাজে, মনুষ্যের সঙ্গে কাজে, রাস্তায়, কারখানায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে মানুষ নিজেকে পূর্ণ করে। চিন্তা এবং পুস্তক মানবচিত্তের পাপড়ি খুলে দেয় মাত্র, বাকি কাজ সাধিত হয় সংসারের কর্মক্ষেত্রে।
কয়েক বৎসর আগে ব্রিটেন এবং রাশিয়া পারস্যকে দুই লক্ষ পাউন্ড ধার দেয়, একটা এঙ্গলোফ্রেন্স কোম্পানিও পারস্যকে ৬০ লক্ষ পাউণ্ড কর্জ দেন। প্রফেসার জ্যাকসন। বলেছিলেন, “বিদেশীর এই সমবেদনার সঙ্গে সঙ্গে পারস্যকে কুসুমের সুবাস এবং বুলবুলের সঙ্গীত ত্যাগ করে কাস্তে-কোদাল নিয়ে শস্য-ক্ষেত্রে নামতে হবে।” যে জাত শ্রমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না, সে জাত জগতে বড় আসন পায় না।
.
০৯. বিবেকের বাণী
যার মাঝে বিবেকের বর্তিকা নাই, যে অন্তরস্থ প্রজ্ঞা দেবতার কথা শুনতে পায় নাই, তার ভরা শুকনোয় তল হবে। তার জীবন-জাহাজ শুকনা গাঙে ডুবে যাবে; মনুষ্য অন্তরে বিবেক আল্লাহর বাক্যরূপে মনুষ্যকে সর্বদাই চালিত করে সাবধান করে। যে সে-কথা শোনে, সেই জয়লাভ করে। যে তা শোনে না, যে তা গ্রাহ্য করে না, বিবেকের কথা তার কাছে চিরদিনের জন্য মৌন হয়ে যায়। সে দিন দিন অধঃপতিত হতে থাকে।
আমি যখন হুগলিতে পরীক্ষা দেই, তখন অতিশয় সাধু ধার্মিক বলে সমাজে পরিচিত একজন মৌলবী সাহেব চুপে চুপে আমাকে কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে গেলেন।
আর একজন মৌলবী সাহেবকে জানি, তিনি পরীক্ষা-মন্দিরে ছেলেদের চুরি করে লিখবার সুবিধা দিতেন। যখন ধর-পাকড় আরম্ভ হতো, তখন তিনি তাদের কাছ থেকে গোপনে টেবিলের উপর বইগুলি এনে রেখে দিতেন।
বলতে কী, এদের এই কাজের পেছনে কিছু যুক্তি আছেই। বিপন্নকে সাহায্য করলে খোদা সন্তুষ্ট হন, হয়তো এই কথা ভেবেই এরা ছেলেদের এই গোপন অসাধু কার্যে উৎসাহ দিতেন। এ যে কত বড় অন্যায়, ছেলেদের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতি কত বড় নিষ্ঠুর আঘাত, তা তারা চিন্তা করতেন না, চিন্তা করাও দরকার মনে করতেন না। বস্তুত ধর্মের অনুশাসন অন্ধভাবে মেনে চললে পদে পদেই পতন এবং বিপদের সম্ভাবনা; বিবেক যার সঙ্গে কথা বলে না, বিবেক যাকে চালিত করে না, জীবনের বহু বৎসরের ধার্মিকতা তার কাছে। নিরর্থক।
অন্ধকারে যেমন আলো মানুষের কাছে বিবেকও তদ্রূপ বর্তিকার মতো সর্বদা পথ দেখায়। বিবেকই মনুষ্যকে ধার্মিকতা শিক্ষা দেয়। যদি বিবেকের অনুশাসন অনুভব করতে পারে, কোনো ধর্মগ্রন্থ, কোনো বাইরের উপদেশ তাকে পথ দেখাতে পারে না। বিবেক মানব-জীবনের পরম বন্ধু, ইহা বন্ধুর ন্যায় জননীর ন্যায়, পিতার ন্যায় মনুষ্যকে পথ দেখায়; সান্ত্বনা দেয়। বিবেক কোনো সময় মনুষ্যকে প্রতারণা করে, কিন্তু সেজন্য দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই। আজ তোমাকে সে যদি ভুল পথ দেখায়, দশ বৎসর পর তোমাকে গন্তব্যস্থানে সে পৌঁছে দেবেই; অপরিপক্ক মানুষ, জ্ঞানবুদ্ধি পূর্ণভাবে বিকশিত হয় নাই তার বিবেক এবং প্রজ্ঞাবান মানুষের বিবেকের মধ্যে অনেক পার্থক্য হতে পারে; তাতে দোষ নাই। মানুষ যদি আপন অন্তরস্থ বিবেকের বাণী পালন করতে যেয়ে মহা অন্যায় করে, তজ্জন্য তাকে অপরাধী করা চলে না। স্বামীর অনুগত হওয়াই নারীর ধর্ম, তার কাজের কোনো জবাবদিহি নাই। তেমনি প্রত্যেকে আপন আপন বিবেক অনুযায়ী চল, ফলাফলের জন্য তুমি দায়ী নও। বিবেকের অনুগত থাকাই তোমার কাজ।
বিবেক আল্লাহর আসন, এই আসনের সম্মুখে মানুষ আজ্ঞাবহ ভৃত্য। জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক সমস্ত বিষয়ের অভিজ্ঞতা আমরা বিবেকের সাহায্যে লাভ করি। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি আমাদের কী কর্তব্য, মানব-জীবনের গুরুত্ব এবং দায়িত্ব, পাপের জঘন্য রূপ, ধার্মিকতার বিমল চিত্র আমরা বিবেকের সাহায্যে আপন আপন আত্মায় অনুভব করি।
বিবেকবান মনুষ্য সর্বদাই ভীত। সব সময় তিনি চিন্তা করেন–তার দ্বারা কোনো অন্যায় হয়েছে কিনা? মানুষ তাকে নিরাপরাধ বলে মুক্তি দিলেও তিনি বিবেকের বিচারে নিজকে মুক্তি দেন না। তিনি আপনার শাস্তি আপনি গ্রহণ করেন। ইহা মানব-হৃদয়ে অমর অক্ষয় চির-সুন্দর, চির-সমুজ্জ্বল চেতনাময় প্রদীপ।
বিবেকের সাহায্যে মানুষ জেনেছে, তার জীবনের এক মহাসার্থকতা আছে। চিন্তাহীন বিবেকবর্জিত জীবন তার কাছে অসহ্য। পশুর বিবেক নাই। ভালো-মন্দ জ্ঞান নাই। মানুষ ভালো-মন্দ বোঝে, বিবেক তাকে সর্বদা সতর্ক করে, ভীত করে, জীবন্ত দেবতা হয়ে তাকে এস্ত, কর্তব্যপরায়ণ, লমিতো ও সজাগ করে। বিবেকের সম্মুখে সে অস্থির হয়, বিশ্বকে উপেক্ষা করে সে আত্মার দেবতার সম্মুখে করজোড়ে দাঁড়ায়।
সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য মানুষের অন্তরস্থ এই বিবেক দেবতাকে জানিয়ে দেওয়া, তেজস্বী, নির্ভীক, পুষ্ট এবং সবল করে তোলা। যদি সে জ্ঞান, মানুষের উপদেশ, পুস্তক এবং সাহিত্য মানুষের অন্তরকে না জাগাতে পারে–তবে বুঝতে হবে তার পাষাণ প্রাণে সমস্ত জ্ঞান ব্যর্থ হয়েছে, মরুভূমিতে বৃক্ষ রোপণের মতো সমস্ত প্রচেষ্টা নিরর্থক হয়েছে বিবেকের জাগরণের নামই আত্মবোধ। বিবেক অপেক্ষা আরও একটি মহা জিনিস আছে, তার নাম প্রজ্ঞা। বিবেক মনুষ্যকে প্রতারণা করে না। প্রজ্ঞা দিবালোকের মতো উজ্জ্বল, তার দৃষ্টির সম্মুখে কোনো কুয়াশা নাই। সন্দেহ নাই–প্রজ্ঞা ধ্রুব সত্যকে দর্শন করে। যিনি এই প্রজ্ঞার সন্ধান পেয়েছেন, তিনি পরম চেতনা লাভ করেছেন, তিনি মনুষ্যের নমস্য। অতি অল্প লোকই এই প্রজ্ঞার সন্ধান পায়।
.
১০. মিথ্যাচার
যে জাতির লক্ষ্য ‘সত্য নহে, সে জাতির কোনো সাধনাই সফল হবে না। সত্যবর্জিত জাতির জীবন অন্ধকার। জাতির উন্নতির জন্য তারা বৃথাই শরীরের রক্ত ক্ষয় করে।
সত্যই শক্তি। ইহা সকল কল্যাণের মূল। ইহাতে মানুষের সর্বপ্রকার দুঃখের মীমাংসা হয়। সত্যকে ত্যাগ করে কোনো জাতি বড় হয় নাই, হবে না। মানব-জীবনের লক্ষ্যই সত্য। ইহাই শান্তি ও ঐক্যের পথ। সত্যের অভাব–বিরোধী ও দুঃখ সৃষ্টি করে। মানুষে মানুষে, বন্ধুতে বন্ধুতে, আত্মীয়ে আত্মীয়ে, পরস্পরে মনান্তর উপস্থিত হয়। সত্য বর্জন করে তোমরা কোনো কাজ করতে যেও না–এর ফল পরাজয়।
জনৈক কোম্পানির ডিরেক্টরকে জানি, তিনি মনুষ্যত্ব ও দেশসেবার নামে, মানুষের সঙ্গে কেবলই মিথ্যা ব্যবহার করতেন। মনুষ্যত্বের নামে দেশ-সেবককে সর্বপ্রকার মিথ্যা পরিহার করেই চলতে হবে। যদি মিথ্যাকে পরিহার করে না চলতে পার, তবে দেশসেবকের আসন ত্যাগ করে বরং পল্লীর একজন অজ্ঞাত মানুষ হও। ছোট জীবনের ক্ষুদ্র কর্তব্যগুলি পালন কর। মিথ্যার সাহায্যে যদি কোনো বড় কাজ করতে অগ্রসর হয়ে থাক, বুঝতে হবে তুমি সে কাজের যোগ্য নও। সবিনয়ে সরে যাও। ( গ্রন্থকার এক সময় তার উন্নত জীবন’ বইখানি নিয়ে কোনো এক সম্পাদকের কাছে গিয়ে সমালোচনা বের করতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি স্বীকার করলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনোদিন সে পুস্তকের সমালোচনা বের হয় নাই। আর এক প্রবীণ সম্পাদকের কাছে তিনি দু’মাস ঘুরেছিলেন, প্রত্যেক বারই তিনি বলতেন, এইবার সমালোচনা বের হবে–তার সে কথা মিথ্যা।
এই সমস্ত কথা লেখবার উদ্দেশ্য দেশের ছোট বড় (?) কারো সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। তাঁদের প্রাণ দেশ প্রেমে এত পরিপূর্ণ (?) যে জীবনের ছোট ছোট কাজে তারা সত্য লক্ষ্য করতে পারেন না। অনেক সময় সাধারণ মনুষ্যের স্তর থেকে তারা এত ঊর্ধ্বে (?) উঠে যান যে, জীবনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কর্তব্যের কথা তাঁদের মনেই থাকে না। সত্য বলছি আদর্শ জীবনের ভাব ইহা নয়। জগৎ এই শ্রেণীর লোককে অশ্রদ্ধায় আসন ছেড়ে উঠে যেতে বলবেই।
জনৈক ইসলামের সেবক তিন বৎসর ধরে প্রতি সপ্তাহে লিখতেন, আগামী বারে আপনার কাজ হবে, কোনো দিন কাজ হয় নাই। এরূপ অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিন্তু তা দিয়ে কী হবে? যদি জীবনকে সার্থক করে তোলবার ইচ্ছা হয়, মানুষের সাধুবাদ ও প্রশংসা অপেক্ষা যদি নিজের বিবেক ও মনকে তৃপ্ত করবার বাসনা থাকে যদি সত্যই মানব-সমাজের কল্যাণ করতে চাও, যদি যথার্থ মানুষ হয়ে জগতের সামনে আসন নিতে চাও, তবে সত্যকে শ্রদ্ধা করতে শেখ। ইহাই ব্যক্তি এবং জাতির সিদ্ধি ও সফলতার পথ, ইহা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নাই। শ্রীরামকে ১৪ বৎসরের জন্য বনে পাঠিয়ে ঋষি বাল্মিকী জানাতে চেয়েছেন কথার মূল্য কী? সত্য রক্ষার জন্য রামকে সিংহাসন ত্যাগ করে কী কঠিন দুঃখই না বরণ করতে হয়েছিল; বস্তুত সত্য পালনের জন্য এইভাবে কঠিন দুঃসহ দুঃখই বরণ করতে হবে। কথায় কথায় মিথ্যাচারণ, বাক্যের মূল্যকে অশ্রদ্ধা করা, এসব সত্যনিষ্ঠ জাতির লক্ষণ নয়। স্বাধীনতা পাবার জন্যে সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধহীন জাতি যতই চেষ্টা করুক, তাদের স্বাধীনতার মন্দির দ্বার থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হবে। যে জাতির অধিকাংশ ব্যক্তি মিথ্যাচারী, সেখানে দু-একজন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে জীবনে বহু বিড়ম্বনা সহ্য করতে হবে, কিন্তু মানব কল্যাণের জন্য, সত্যের জন্য সে বিড়ম্বনা ও নিগ্রহ সহ্য করতেই হবে।
ক্রয়-বিক্রয়ে, পারিবারিক কার্যে, অফিস-আদালতে, কাজ-কারবারে, পরস্পর বাক্যালাপে, রেল স্টীমারে সর্বত্রই জাতির মুক্তির জন্য যতই চিৎকার করি না কেন, জাতি যতক্ষণ না জাতির সর্ব প্রকার গ্লানি-মুক্ত হতে চেষ্টা করে, তাবৎ তার কল্যাণের কোনো আশা নাই। জাতির ও দেশের বড়াই যতই করি জগৎ সে বড়াই-এর দিকে ফিরে তাকাবে না।
সত্য মনুষ্যত্ব, মহানুভবতা ও ত্যাগই জাতীয় শক্তির মূল উপাদান। কার্থেজ যুদ্ধের বন্দি রেগুলাস (Regulas) তার বাক্যের মর্যাদা রক্ষা না করলেও পারতেন। তিনি সন্ধির জন্য কার্থেজ হতে রোমে এসে সিনেটরকে (Senator) বললেন, কার্থেজবাসীদের সঙ্গে কখনও নত হয়ে সন্ধি করো না। রোম সন্ধি না করলে তিনি আবার কার্থেজে ফিরে যাবেন, এই প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলেন। তিনি যখন প্রত্যাবর্তন করতে প্রস্তুত হলেন, তখন। সিনেটরেরা বললেন–শত্রুর কাছে প্রতিজ্ঞার কোনো মূল্য নাই। রেগুলাস (Regulas) বললেন, তোমরা আমার আত্মাকে অপমান করতে চাও? কার্থেজে ফিরে গেলে আমার দণ্ড হবে, কিন্তু কোনোমতে আমি নীচ হতে পারব না। যে জাতির মধ্যে এই ধরনের মানুষ জন্মে, তারাই প্রাতঃস্মরণীয় জাতি। অট্টালিকা বিলাস-বাসনাশক্তি সভ্যতার নিদর্শন নয়। ত্যাগ, দুঃখবরণ এবং সত্যনিষ্ঠাই জাতির মুক্তির পথ প্রস্তুত করে। ধাপ্পাবাজিতে জগৎ টিকে নাই। ফাঁকি দিয়ে জয়লাভ সম্ভবপর নয়।
জাতির বড় কাজে বরং মিথ্যাকে সমর্থন করা যায়, কিন্তু জীবনের ছোট ছোট কাজে মিথ্যাচারণ কখনও সমর্থনযোগ্য নহে। জলো দুধ বিক্রয় করা, ভেজাল দ্রব্য বিক্রয় করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপনে লোক ভুলিয়ে পয়সা উপায় করা, ঘৃতের নামে চর্বি বিক্রয় করা, স্টেশনে জন-সাধারণের কাছ থেকে কৌশলে টাকাটা-সিকিটা আদায় করা, জমিদারি সেরেস্তায় ৫ টাকা বেতনে চাকরি করে কৌশলে মাসিক ১০০ টাকা উপায় করা, ৫০ টাকা বেতনের কেরানি হয়ে মাসিক ২০০ টাকা উপায় করা, এ সব কাজ জীবনের লজ্জা এবং হীনতার সূচনা করে। ধার্মিকতা শুধু মুখের কথা নয়, জীবনের কাজ।
১১-১৪. পরিবার
হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, যিনি আপন পরিবারের মধ্যে উত্তম, তিনি আল্লাহর কাছে উত্তম। যথেচ্ছাচারী রাজার মতো পরিবারের যথেচ্ছাচারী কর্তা মনুষ্য জীবনকে বিষময় করে তোলে। তার প্রতাপে গৃহের সমস্ত মানুষ অন্তরে দগ্ধ হতে থাকে, ফলে তার বিপদে, দুঃখে পরিবারের কারো কোনো আন্তরিক সহানুভূতি থাকে না।
বাইরে মানব-সমাজে, মুক পশুর কাছে, প্রেমের যেমন প্রভাব, অধীনস্থ আত্মীয়দের উপরেও প্রেম তেমনি কাজ করে। বালক-বালিকা আশ্রিতদের দুঃখের সহানুভূতি, তাদের প্রতি সহৃদয় ব্যবহার পরিবারের সবাইকে যেমন গভীর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ করে, তেমনি গৃহের সুখ শতগুণে বর্ধিত করে দেয়। প্রেমের নামে, মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়ের নামে মানুষ দুর্বল, শক্তিহীন। মুখাপেক্ষী অধীনস্থদের প্রতি যে অত্যাচার করে, তার তুলনা নাই।
লোকে শিক্ষার নামে কোমলমতি বালক-বালিকাঁদের অত্যাচারীর (কহরটর্ভ) মতো দণ্ড দেয়। প্রেমের অভাবেই এমন হয়! মনুষ্য সন্তানকে মনুষ্য আল্লাহর আর্শীবাদ মনে করে না–যেন বিপন্ন হয়েই পুত্র বলতে বাধ্য হয় ঘটনাক্রমে পিতা মনুষ্য দুর্ব্যবহারের দ্বারা নিজেদের জীবনে অনুতাপ প্রকাশ করে।
সন্তান আল্লাহর কাজ করবে, এই উদ্দেশ্যে পুত্র কামনা কর, তা হলে পুত্রের মুখ দেখে। যে আনন্দ হবে সে আনন্দ স্বর্গীয় হবে। পাপ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে, নিজের দুরাশার ইন্ধনরূপে মানব সন্তানকে ব্যবহার করতে যেও না। শিশু ভূমিষ্ট হওয়া মাত্র বল, আল্লাহ আকবার আল্লাহ শ্রেষ্ঠ সত্যের জয়’–’প্রেম ও সত্যের জয়। মানব শিশুর জন্য ইহাই প্রথম মন্ত্র। সমস্ত জীবন তার সত্য প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত হোক। জীবন তার মহত্বে-মানব কল্যাণে যাহা কিছু সুন্দর, পবিত্র, তাতেই উৎকৃষ্ট হোক। নিষ্ঠুর কঠিন মুখ শয়তানের। প্রেম ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠা কখনও নিষ্ঠুর বাক্যে হবে না। হয়েছে বলে যা মনে হবে–তা হয় নাই। কঠিন ব্যবহারের রূঢ়তায় মানবাত্মার অধঃপতন হয়। সাফল্য কিছু লাভ হলেও আত্মা যে দরিদ্র হতে থাকে সুযোগ পেলেই সে আপন পশু স্বভাবের পরিচয় দেয়।
ইসলাম মানে শুধু উপাসনা নয়। বাইরে, রাস্তায়, ঘরে, বিপণীতে দিনের সমস্ত কাজে সে সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে। যে পরিবারে কর্তা ছোটদের সঙ্গে কদর্য ব্যবহার করে, সে পরিবারের প্রত্যেকের স্বভাব অতিশয় মন্দ হতে থাকে। শিশুর জন্য এ একটা নিষ্ঠুর কথা, একটা মায়াহীন ব্যবহার–তার মনুষ্যত্বকে অনেকখানি করে কমাতে থাকে। অতএব শিশুকে নিষ্ঠুর কথা বলে, তার সঙ্গে প্রেমহীন ব্যবহার করে, তার সর্বনাশ করো না। একটা মধুর ব্যবহার অনেকখানি রক্তের মতো শিশুর মনুষ্যত্বকে সঞ্জীবিত করে। পরিবারের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতির জন্যে সকলেরই চেষ্টা করা উচিত। ইহাই পরিবারের প্রতি প্রেম। নিজের সমস্ত কাজই চলেছে, কিন্তু পরিবারের লোকগুলি যে ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার উদ্ধারের কোনো আয়োজন নেই। আত্মাকে জীবনের পথে আলোকের পথে নিতে হলে তাকে যা দিতে হবে–পরিবারের কল্যাণেচ্ছুদের ইহাই শ্রেষ্ঠ কাজ। শুধু বোধহীন আবৃত্তিতে আত্মা সচেতন, জাগ্রত, ব্যাকুল এবং সত্যের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে না। আল্লাহর কালাম অনুভব করা চাই, নইলে বিশেষ কোনো ফল হবে না।
অর্থ লোভে দিবারাত্র ছেলেদের দিয়ে বই মুখস্থ করান বড় কথা নহে–পরিবারের ছেলেদের ভিতর যাতে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়, তার চেষ্টা করা উচিত। পশু জাতীয় বড় লোক বা স্বার্থপর বা আত্মসুখ সর্বস্ব শিক্ষিত পণ্ডিত হয়ে লাভ কি? পরিবারের সবাই যাতে উদার হৃদয় সত্যবান মানুষ হয়ে ওঠে, তার চেষ্টা কর।
নির্ভরশীলদের বিশ্বাস কর, তাদের মনুষ্যত্বের আত্মমর্যাদাজ্ঞান জাগ্রত হবে। তাদের অবিশ্বাস করো না, তাদের আত্মমর্যাদাজ্ঞানে আঘাত দিও না, তাদের লজ্জা দিও না–তাদের মনের কোণে গোপনে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জাগবে। যদি বিশ্বাস করে প্রতারিত হও, তবুও বিশ্বাস কর।
ছোট হোক বড় হোক পরিবারের কাউকে কখনোও খারাপ কথায় আঘাত দিও না। এতে মানুষের মন অতিশয় ব্যথিত হয়; সে পীড়া দাতাকে ঘৃণা করে; মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস ব্যতীত মানুষকে লাভ করা যায় না।
বিশ্বাস কর, অন্তর্নিহিত সুবুদ্ধির কাছে নিবেদন কর, ভক্তি, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা অর্জন করবে। পরিবারের প্রতি সহানুভূতিই পরিবারের প্রাণ। এই ভাবটি যাতে বেড়ে ওঠে, তার চেষ্টা চাই। যে পরিবারে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি নেই, সে পরিবারে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।
.
১২. প্রেম
খ্রিষ্টান ধর্ম আজ এত সমুজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে ইসলাম ধর্মের প্রভাবের ফলে। আল্লাহর মঙ্গলবাণী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে প্রচার করেছিলেন, তারপর ইঞ্জিল কেতাবের দীপ্তি ইউরোপবাসীর চোখে সমুজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হয়েছে।
আতুর, কয়েদি, পাগল, দাস, কুষ্ঠরোগীকে ইউরোপ কুকুরের মতো, বন্য পশুর মতো ঘৃণা করতো। পিসা (টে) শহরে জীবন্ত মানুষের শরীরে এনাটমি শিখবার জন্যে ডাক্তারেরা স্কালপোল (ছুরি) ব্যবহার করতো। মানুষের উপরে এই অত্যাচারের কাহিনী পড়ে আমরা ভীত হই। আত্মা ব্যাকুল হয়ে উঠে।
মানব জাতির জন্যে আর্শীবাদ হয়েই ইসলাম যথাসময়ে পৃথিবীতে এসে ছিল। ছোট নাই, বড় নাই, ধনী নাই, দরিদ্র নাই, পীড়িত, লাঞ্ছিত, দাস গোলাম, রোগী সবই ভাই’!৩
ইসলামে দান খেয়ালী বিষয় নহে; তা আল্লাহর অপরিহার্য আদেশ। জলেম ও জুলুম’কে ইসলাম আল্লাহর অভিশাপ দেয়–আন্তরিক ঘৃণা করে। মজলুম’কে সমস্ত ত্রাণ দিয়ে রক্ষা কর–এই তাঁর বাণী।
ইসলাম তস্করের হাত কাটতে, ব্যভিচারীকে পাথর মারতে বলেছে; কিন্তু সে ক্ষমার কথাও বলেছে। মুসলমান সাধু চোরকে রিক্ত হস্তে ফিরতে দেখে ব্যথিতচিত্তে আপন একমাত্র সম্বল কম্বলটি চোরের যাওয়ার পথে রেখে গিয়েছেন। সাধু ফকিরদের জীবন কাহিনী কত সুন্দর, জগতে কোথাও তার তুলনা নাই।
ইসলামে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেম–অপর জাতির প্রতি প্রেম নিন্মলিখিত সত্য ঘটনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। প্রেমে আপন-পর নাই, জাতি-বিচার নাই। মিশরে এক। সময়ে একটি মসজিদ ভস্মীভূত হয়। কতকগুলি লোক সন্দেহ করল খ্রিস্টানদের এ কাজ। তারা সন্দেহ করে খ্রিস্টানদের ঘর জ্বালিয়ে দিল। খলিফা কিন্তু অপরাধীদের নিজের জাত বলে ক্ষমা করলেন না। বিচারক কতকগুলি কাগজে মৃত্যুদণ্ড, কতকগুলিতে বেত্রাঘাতের দণ্ড লিখে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন–”যার যেখানা ইচ্ছা তুলে নাও।” কোনো কাগজে কী শাস্তি লেখা আছে, তা তাদের জানতে দেওয়া হল না। খলিফার কঠিন শাস্তি অপরাধী মুসলমানদের গ্রহণ করতে হলো। খলিফার কঠিন শাস্তি লেখা আছে, তা তাদের জানতে দেওয়া হল না। খলিফার কঠিন শাস্তি অপরাধী মুসলমানদের গ্রহণ করতে হল। ইহাই ইসলামের কঠিন আদর্শ, ইহাই প্রেমের আদর্শ।
সেই অপরাধী জনসংঘের মাঝে দুই ব্যক্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। তাদের একজনের ভাগ্যে ঘটেছিল মৃত্যুদণ্ড, অপরের বেত্রাঘাত। প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তি বললেন–”আমার মরণের ভয় নাই, কিন্তু আমার নিঃসহায়া মা আছেন, তারই জন্য দুঃখ হচ্ছে। কে তাঁর সেবা করবে?” পাশের ব্যক্তি তার হাতে নিজের শাস্তি পত্রখানি দিয়ে বললে–”আমার মা নেই, আমার মরণে কারো ক্ষতি হবে না।”
যার মরণের কথা ছিল, সে মুক্তি পেল, যার বাচবার কথা ছিল আনন্দে মৃত্যুবরণ করলো।
এই লোকটির সংবাদ জগৎ রাখে নাই। কিন্তু তার জীবনে মহা আদর্শ মনুষ্যকে শিক্ষা দিয়েছে–প্রেম কাকে বলে।
অনেককাল আগে একবার আমি চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। গাড়ির মধ্যে একজন দুর্বলকায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বী লোক এসে প্রবেশ করলো। গাড়িতে জায়গা ছিল অনেক। কয়েকজন কাবুলি উপাসনার ভান করে তাদের দীর্ঘ দেহ এবং উপাসনার আসন দিয়ে সমস্ত জায়গা জুড়ে রাখলো। আমি বিধর্মীকে দয়াপরবশ হয়ে একটু স্থান দিতে সবাইকে অনুরোধ করলাম। গাড়ির সবাই রেগে উঠলো। শেষকালে আমি অতি কষ্টে কোনোরকমে সেই ক্লান্ত অতিথিটিকে একটু স্থান দিলাম। আমার এই অন্যায় (?) ব্যবহারে কাবুলি ভাইরা এবং অন্যান্য সবাই চটে গেল। শেষরাত্রে দ্ৰিাকাতর হয়ে যেই একটু শোবার জন্য একটু কাৎ হয়েছি, অমনি কতকগুলি হাত আমার কান নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করলো। কান যে মলে দেয় নাই, এটাই সৌভাগ্যের বিষয়। ইসলামের প্রতি আত্মার প্রেম লোকগুলি এভাবেই সার্থক করলো। বস্তুত এ ইসলামের কাজ নয়। ইসলামের প্রেমে জাতি বিচার নাই। সর্বত্রই সে ন্যায়নিষ্ঠ এবং মহাজন।
এমার্সন বলেছেন–”কোমল, পেলব ব্যাঙের ছাতাগুলি মৃদু আঘাতে কঠিন মাটির ছাপড়া ভেঙ্গে দেয়। কার কাজ কেমন শান্ত অথচ অব্যর্থ। প্রেম ও দয়া মান-চিত্তকে জয় করে। মনুষ্য হৃদয়কে আসন পাতবার, আকর্ষণ করবার, দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। হৃদয়হীন শাসনের ফল দ্রুত; কিন্তু ক্ষণস্থায়ী, প্রেমের শাসনই, চিরস্থায়ী।”
জন উলমান John Woolman) বলেছেন–”মানুষের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছে না। ব্যথা, পিতৃহীনের করুণ নয়ন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না! কত শত নয়ন পতিত হয়েছে, কত মুখ শোকদুঃখভারে বিবর্ণ হয়েছে, আমরা তা দেখি নাই। আমাদের হাসি, উল্লাস, উৎসব, গান থামে নাই। মানব-দুঃখ আমাদের জাগায় নাই। মানুষের পাপে আমাদের শরীর শিউরে ওঠে নাই।”
রোগীর কী যাতনা, তার দুঃখের দুঃসহ জ্বালা, সুস্থ মানুষ অনুভব করতে পারে না। দুঃখীর দুঃখ যিনি যতটুকু অনুভব করেন, তিনি তত বড় মানুষ। হাসি-খেলার দিনমান শেষ। হয়, কিন্তু যাতনাদগ্ধ নর-নারীর আর্তনাদ দিনের প্রতি মুহূর্তে কঠিন প্রতিধ্বনি জানাচ্ছে কে তা চিন্তা করে? কে ব্যথিতের বেদনার কথা ভেবে জীবনের সুখকে বিষাদ-মলিন করে। তুলবে? যে মুখ মানব-দুঃখে উদাসীন, সে মুখ পশুর, সে মুখ মানুষের যোগ্য নয়।
শীতকালে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্রের মাতা একখানি বস্ত্র গায়ে দিয়ে শুয়েছিলেন। তা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন–”মা, আমি তো আপনাকে তুলা দিয়ে নরম লেপ তৈরি করে দিয়েছি, এই শীতে আপনি এই সামান্য বস্ত্রে রাত্রি কাটাবেন?”
মা বললেন–”বাবা, এই গ্রামের অনেক হতভাগিনী আছে, যাদের গায়ে দেবার বস্ত্র নেই, তাদের কথা চিন্তা করে আমি গায়ে গরম কাপড় দিতে পারছি না।” কী সুন্দর মহানুভবতা, কী স্বর্গীয় সহৃদয়তা–দরিদ্রের প্রতি তার আশ্চর্য প্রেম।
সুইডেনের রাজকুমারী ইউজীন পীড়িতের কথা চিন্তা করে তার সাধের রত্ন অলঙ্কারগুলি কণ্টক বলে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি সেইগুলিকে বিক্রি করে দুঃখীদের জন্যে এক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। একদা হাসপাতাল পরিদর্শনকালে জনৈক রোগী তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “মা, আপনার এই হাসপাতালে আশ্রয় না পেলে আমি রাস্তায় প্রাণত্যাগ করতাম”। এই বলে লোকটি নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগল। রাজকুমারী তা দেখে বললেন, “এই অশ্রুধারাই আমার শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার, আজ আমি মুক্তার হার ধারণ করলাম।”
আমরা কি সত্যই উন্নতির পথে চলেছি? –তা হলে দেখতে হবে, আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হচ্ছে কিনা। সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সভ্যতা, সকল ধার্মিকতার প্রাণ-প্রেম। প্রেম ব্যতীত জাতির সাধনা ব্যর্থ। প্রেম মনুষ্যত্বকে ত্যাগী করে, তাকে দুঃখ বরণ করতে উদ্বুদ্ধ করে, মানুষের এবং জাতির জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে। প্রেম কখনও মানুষকে অবিবেচক, নিষ্ঠুর, আত্মসর্বস্ব, অবিনয়ী, পরস্বার্থহারী, দাম্ভিক করে না।
দেখতে হবে, আমরা দেশের মানুষকে ভালোবাসি কিনা। দেশের মানুষের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে শিখেছি কিনা? তা হলে বুঝবো জাতির সত্যই উন্নতি শুরু হয়েছে।
আমরা কি প্রতিবেশীকে আঘাত করি?–আমরা কি কারও দাবি নষ্ট করি?–জাতির দুঃখে কি আমাদের কোনো সহানুভূতি নাই?–পরস্পরে কি আমরা মিথ্যা ব্যবহার করি? তা হলে বুঝবো কিছুই হয় নাই।
মনুষ্য যতই অপরাধ ও মূঢ় হোক না কেন, তাকে আঘাত করে মানুষের মনে যখন। আনন্দ হয়, তখন বুঝতে হবে, শয়তান আত্মতৃপ্তি লাভ করেছে। সে আঘাত মানুষের নয়। মনুষ্যকে শাস্তি দাও–আঘাত কর কর্তব্যের খাতিরে–পশুর আনন্দ নয়।
.
১৩. সেবা
যে দুঃখী পীড়িতের ব্যথা মর্মে অনুভব করে সেবার কাজে আত্মদান করে, সে মানুষের গৌরব। কোনো কোনো ভ্রাতা বলে থাকেন, “খ্রিস্টান ও হিন্দুরা সেবার দ্বারা মানুষের চিত্ত জয় করে, তাদের প্রতারণা-জাল থেকে সাবধান।”
সেবা ও প্রেমকে অশ্রদ্ধা করা মুমিনের কাজ নয়। যারা সেবা-ধর্মে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে, তারা বিধর্মী হলেও উদার মুসলমান শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে।
বিধর্মী ম্রাট নওশেরোয়া বিচার ও ন্যায়নিষ্ঠায় চিরদিন মুসলমানদের শ্রদ্ধা-পুস্পাঞ্জলি পেয়েছেন। যিনি প্রেমিক এবং সেবক, তিনি ন্যায়-বিচারক ও দুঃখীর বন্ধু।
যখন বিধর্মী তায়ী সম্প্রদায় বন্দি হয়ে হযরতের সম্মুখে নীত হল, তখন বন্দিদের মধ্য হতে একজন মহিলা বললেন–”মহানুভব, আমি হাতেমের বংশধর।” হযরত বললেন”এদের মুক্ত করে দাও। বিধর্মী হলেও সেবাধর্মে হাতেম আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছেন। তার কন্যাকে আঘাত করা হবে না, সবাইকে মুক্ত কর।”
হযরত মহিউদ্দীন জিলানী যখন সামান্য ছাত্র, তখন একদিন রাস্তার ধারে পতিত এক পীড়িতকে বুকে করে আপন শয্যায় আশ্রয় দিলেন। তার সেবায় রোগীর রোগমুক্ত হল। সে মহিউদ্দীনকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলো। সেইদিন রাত্রে তিনি স্বপ্নে শুনলেন–”তোমার জীবনের এই প্রেম সার্থক হবে। মানব-কল্যাণের সাধনায় তোমার জীবন ধন্য হবে। আল্লাহ তোমায় মহৎ স্থান দান করেছেন।”
সৈনিক সবুক্তগীন যেদিন হরিণ-মাতার মুখের দিকে চেয়ে করুণা বিগলিত চিত্তে মৃগ শিশুকে ছেড়ে দিলেন, সেইদিন আল্লাহ তাঁকে লোকপালনভার দিয়ে তাঁর প্রেমকে পুরস্কৃত করলেন। প্রেমের পুরস্কার হবেই প্রেমে আল্লাহর আরশ জোরে নড়ে। প্রেম, দয়া ও সেবা ইসলামের অঙ্গ। দুঃখীর জন্য দান (জাকাত) ইসলামে অপরিহার্য বিধান। ইসলামের জাকাতের টাকা থেকে অনেক হাসপাতাল, অনেক সেবা-সঙ্গ চলতে পারে।
জল-প্লাবনে, রোগে, দুর্ভিক্ষে বিভিন্ন দেশে সেবা-সঙ্গের ভিতর দিয়ে মানুষ অর্থ ও অন্নবস্ত্র দান করেছে–যারা জীবন দিয়ে তার সেবা করেছেন, সেবার দুঃখ সয়েছেন–তারা প্রেমিক। মানুষের শ্রদ্ধা সংবাদপত্রের নাম তাঁরা চান নি; বিবেক, মনুষ্যত্ব ও আত্মার ধর্মকে তারা সার্থক করেছেন জগৎ এদের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে। এদের প্রেম ও অশ্রুর মূল্য রাজার রাজতখতও নয়। মানুষের দুঃখে অশ্রু যারা ফেলেছেন, মানব দুঃখের জন্য যারা সেবাকার্যে অগ্রসর হয়েছেন, তাঁরা আল্লাহর আর্শীবাদ পেয়েছেন। জীবন শেষ হবেই কিন্তু ধন্য হবার এই-ই পথ।
পণ্ডিত হয়ে লাভ কী, যদি না প্রেমে পাণ্ডিত্যকে সার্থক করি? বড়লোক হয়ে লাভ কী, যদি না আপন বিত্ত মহিমা প্রেমে সার্থক করি? অফুরন্ত উপাসনায় আল্লাহর কী প্রয়োজন, যদি না উপাসনা প্রেমে সার্থক হয়। বস্তুত প্রেমহীন জীবন, জ্ঞান এবং ধার্মিকতা কিছু নয়। মানবের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাধনা প্রেম-সাধনায় সার্থক হয়।
পর সেবায় আমরা অনেকে হয়তো জীবন দান করতে পারি কিন্তু যারা আপন প্রাণ সেবার কার্যে উৎসর্গ করেছেন–অর্থ দিয়ে তাদের কাজে সাহায্য কি আমরা করতে পারি না? পীড়িতের জন্যে সাহায্য কিছু দান করাও কি কষ্টকর হবে? কে ব্যাধি দেখে নির্ভয়ে চলেছে? কে শঙ্কা, সন্দেহ, মরণকে উপহাস করে আল্লাহ্ বলে ছুটছে? মুসলিম। কার প্রাণে ভয় নাই? সে মুসলমান। মরণাপন্ন পীড়িতের শয্যাপার্শ্বে মুসলিম যুবককে দেখি না কেন? বিপদ ও মরণ-বিজয়ী মুসলিম তোমাকে তো কোনোদিন কাপুরুষ দেখি নাই? পরকালের পুরস্কারের আশায় হে বিশ্বাসী! তোমাকে দেখেছি তোমার মহাযাত্রাকে সার্থক করতে। মৃত্যুকে তুমি কি ভয় কর? প্রেম ও ত্যাগই যে জীবন।
প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে মীলানে (Milan) প্লেগের আবির্ভাব হয়। প্লেগ অতিশয় ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি। মনুষ্য প্লেগের ভয়ে দিশাহারা হয়ে পলায়ন করে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, মানুষ পথে পড়ে মরে। আত্মীয় আত্মীয়কে ত্যাগ করে, বন্ধু বন্ধুকে ফলে যায়। এই পাপপূর্ণ দুঃখের সংসারে অনেক মানব দেবতাও বাস করেন। তাঁদের স্পর্শ কী শক্তিপূর্ণ। তাদের বাক্য কী প্রেম-মধুর। আল্লাহর ছায়ারূপে পৃথিবীর দুঃখ-দগ্ধ মানবসন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা সংসারকে মধুর করেন।
মীলানে ভয়াবহ প্লেগ আরম্ভ হয়েছে, বরোমী (Barromes) নামে এক জন সাধু বললেন—”আমাকে এইখানে যেতে হবে।” বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে বললেন, “আপনি কি প্রাণ দিতে যাচ্ছেন? আপনি কি মরণকে ভয় করেন না?” বরোমী বললেন–”আমার জীবনের চাইতে দুঃখীর ব্যথার মূল্য বেশি। আমাকে যেতেই হবে। সাধু ও মারফতপন্থী বুজর্গ বললে আমরা বুঝি তিনি দিবারাত্র ঘরের মধ্যে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন। দোয়া পড়ে রোগীকে রোগমুক্ত করেন। বুজর্গের ইহাই ভাব নয়। ইহা ধর্মহীন লোকের চালাকি। বুজর্গ ও সাধুর প্রধান ধর্ম সেবা, প্রেম এবং ত্যাগ, দুঃখীর প্রতি অফুরন্ত সহানুভূতি, জীবন দিয়ে সয়ে আল্লাহর এবাদত করা; আরামে কম্বলের মধ্যে বসে পরের পয়সায় উদরপুষ্ট করা নয়। সাধু মৃত্যুকে ভয় করেন না–তিনি ফুঁ দিয়ে কাজ করেন না। তিনি পীড়িতের মধ্যে যান, দরিদ্রের সেবা করেন, দুঃখীদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন এবং হযরত মোহাম্মদের ন্যায় আপন হস্তে মলমূত্র পরিষ্কার করেন। সেবক শুধু দরূদ পড়েন না, সেবাকার্যের প্রয়োজন হলে প্রাণ দেন। সেবায় তাঁর কোনো অহঙ্কার নাই।
মীলান শহরের প্লেগ চার মাস কাল থাকে। সাধু বরোমী ঔষুধ ও পথ্য হস্তে সর্বত্র যেতেন, দুঃখীর সংবাদ নিতেন, ওষুধ বিতরণ করতেন। রাত্রিকালে দুঃখীর জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, মরণোন্মুখ রোগীর পার্শ্বে বসে বন্ধুর মতো, মায়ের মতো তাকে আল্লাহর অনন্ত প্রেমের কথা শুনাতেন। এই সাধু সেবা ও প্রেমকে অনুসরণ করে আরও অনেক গুণমুগ্ধ ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করলেন এবং যতদিন না ব্যাধি সম্পূর্ণভাবে শেষ হল, তাবৎ তারা ভয়ে সেবার ক্ষেত্র ত্যাগ করলেন না।
বরোমী কিছুদিন পর দেখলেন, তাঁর নগরের নৈতিক অধঃপতন, অপবিত্র পাপীজীবন; মনুষ্য পশুর মতো পাপাচারে উল্লাস করে, অভিশপ্ত, ঘৃণিত, জীবনের গৌরবে মত্ত থাকে। তিনি সর্বত্র লোক শিক্ষার জন্যে প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করতে লাগলেন, সাধারণের মাঝে প্রচার করতে লাগলেন। এর ফল কী হল, সাধু নামধারী কতকগুলি ভণ্ড বললেন,–বরোমী কাফের। একে খুন করো। যে কথা সেই কাজ। বলরামী একদিন যখন ইতর লোকদের মাঝে আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন, সেই সময় এক ভাড়াটে নরহন্তা তাকে লক্ষ্য করে। গুলী ছোঁড়ে। ভক্তের প্রতি আল্লাহর কী দয়া। তিনি আপন ভক্তকে, সাগরবক্ষ; অগ্নিসমুদ্র, ঝড়ঝঞ্ঝা হতে আশ্চর্যভাবে রক্ষা করেন। গুলী বলরামীর বস্ত্র ভেদ করে তার শরীরে প্রবেশ করতে পারল না। তিনি হাস্যমুখে তার শত্রুদের আশীর্বাদ করলেন, তাদের জন্যে আল্লাহর দয়া ভিক্ষা করলেন। এই কাজ,–এই সেবা এবং সাহস, আর এই অপরিসীম প্রেম ও শত্রুর প্রতি স্নেহভাবই সাধু জীবনের পুণ্য সত্য চিত্র এবং সে চিত্র স্বর্গীয়, মহৎ, পবিত্র পাপীর পথ-প্রদর্শক। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, এ স্বর্গীয় চিত্তে কলঙ্ক নাই।
.
১৪. এবাদত
মানব-জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ এ যাবৎ যত প্রকার বিশ্লেষণ করেছে, তার মধ্যে মানুষ সর্বতোভাবে নিজেকে খোদার এবাদতে নিযুক্ত করবে, ইহাই মানব-জীবনের মূল উদ্দেশ্য। খোদা বলেছেন, “নিশ্চয়, আমি জ্বীন ও মানবকে কেবলমাত্র আমার এবাতের জন্য সৃষ্টি করিয়াছি।” মানুষ খোদার এই এবাদতের অর্থ বুঝতে অনেক সময় ভুল করেছে, যতদিন কোনো মানব খোদার এই এবাদতের অর্থ ঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতেন না পারে, ততদিন তার জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণতায় পরিণত হবে না। এবাদতের অর্থ ঠিক বুঝতে না পেরে কেহ-বা ধর্মের কতিপয় বিধির ব্যবস্থাকে মৌখিক স্বীকার করে নেওয়াকে এবাদতের সারমর্ম মনে করেছে। কোরান শরীফে এবাদতের বিশদ ব্যাখ্যা না থাকলেও যে বর্ণনা দেওয়া আছে তাতেই এবাদতের অর্থ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। কোরানের এই আলোকের সাহায্যে মানুষকে এর প্রকৃত অর্থ বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, এবং সেইভাবে জীবনের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, তা নাহলে এ সুন্দর মানব-জীবন বিফলে যাবে। এ জীবন-যৌবন একবার গেলে আর ফিরে আসবে না। যে দিন বিতাড়িত শয়তান খোদাকে বলেছিল, “নিশ্চয় তুমি খুব কম লোকই দেখতে পাবে, তোমার প্রশংসাকারী, যেহেতু তাদের বেশিরভাগকেই আমি পথভ্রষ্ট করতে থাকবো।” শয়তানের কথায় উত্তরে খোদা জোর দিয়েই বলেছিলেন, “আমার আবেদের উপর তোমার কোনোই আধিপত্য চলবে না।” (সুরা হিজর, আঃ ৪২)। আরবিতে এবাদতকারীকেই আবেদ (সেবক) বলা হয়। তাই এর দ্বারা এই প্রমাণিত হচ্ছে যে, খোদার এবাদতই মানব জীবনের প্রকৃত পথ। যে পথের উপর দণ্ডায়মান থাকলে শয়তান ভয়ে কম্পিত হবে, হতাশায় দূরে সরে যাবে। আবার অন্য স্থানে খোদা তার আবেদের সম্বন্ধে বলেছেন, “এবং তাহারই সেই রহমানের আবেদ (সেবকবৃন্দ) যাহারা পৃথিবীর উপর বিনীতভাবে চলাফেরা। করে এবং যখন সাধারণ অজ্ঞ লোকেরা তাহাদিগকে সম্বোধন করে, তখন তাহারা বলে–শান্তি এবং তাহারা স্বীয় প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সেজদায়ও দাঁড়ান অবস্থায় অতিবাহিত করে এবং তাহারাই বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের হইতে দোজখের শাস্তি নিবারণ কর। নিশ্চয় উহার শাস্তি অনিবার্য। নিশ্চয় উহা নিকৃষ্টতর বিশ্রামাগার ও বাসস্থান এবং যখন তাহারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় অথবা কার্পণ্য করে না এবং উহার অন্তর্গত মধ্যপথ অবলম্বন করে। তাহারা আল্লাহর সহিত অন্য উপাস্য গ্রহণ করে না, ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত এইরূপ করে, সে পাপের প্রতিফল পাবে। উত্থান দিবসে তাহার জন্য শাস্তি দ্বিগুণ হইবে এবং তম্মধ্যে সে ঘৃণিত অবস্থায় পড়িয়া থাকিবে কিন্তু যে অনুতাপ করে ও বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকার্য করে, তবে আল্লাহ্ উহাদের অকল্যাণ কল্যাণে পরিবর্তন করিয়ে দেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়, যে অনুতাপ করে ও সৎকার্য করে, তবে নিশ্চয় সে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবতিত হয়।
এবং যাহারা মিথ্যা বহন করে না এবং যখন অসত্যের নিকট দিয়া অতিক্রম করে তখন ভাবেই অতিক্রম করিয়া থাকে।
“যখন তাহাদিগকে তাহাদের নির্দেশনাবলী হৃদয়সঙ্গ করান হয়, তখন উহারা বধির ও অন্ধভাবে তাহাকে গ্রহণ করে না।” (সূরা ফোরকান, আঃ ৬৩-৭৩)।
কোরান মজিদের উপরোক্ত বর্ণনার দ্বারা শুধু তসবীহ ও সেজদার মধ্যে আবেদের এবাদতকে সীমাবদ্ধ করা হয় না। বরং বিশেষভাবে ৭২ নম্বর আয়াতের দ্বারা স্পষ্ট প্রতিপন্ন হচ্ছে যে, মানুষের মুখের দ্বারা যে কথাই উচ্চারণ হউক না কেন, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা
যে কাজই সম্পন্ন হউক না কেন, এবং তার মস্তিষ্কের দ্বারা সে যাহাই চিন্তা করুক না কেন, তাতে অন্যায়ের লেশ থাকবে না, এমনকি তাতে অন্যায়ের গন্ধও থাকবে না। যদি সে খোদার প্রকৃত আবেদ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে চায়–যদি সে তা মানব-জীবনকে ধন্য করতে চায়। তাই বলে শুধু লেবাস, আবৃত্তি তসবিহ ও সামাজিক অনুন কোনো কাজ হবে না। মানব জীবনের উদ্দেশ্য খোদার দেওয়া জীবন ব্যবস্থা (দীন)-কে পূর্ণভাবে পালন। করে খোদার প্রকৃত আবেদ হওয়া–শয়তানের গোলাম হওয়া নহে।
আর এই জন্যেই খোদা আবার বলেছেন, (বল, আমরা গ্রহণ করিয়াছি। খোদার রং এবং রং-এ আল্লাহর চেয়ে ভালো কে আছে। এবং খোদার এবাদতকারী।