কৌশলের রাজা দুঃখীর বন্ধু হয়ে, দুঃখীকে দরদ করে দেশের সকল মানুষের পরম আত্মীয় হয়েছেন। তার নাম শুনে রাখাল বালক, ঘরের বধূ এবং পথের ভিক্ষুকও হাত তুলে ভক্তি জানায়। দাম্ভিক কাশীরাজ কোশল-রাজের এই প্রতাপ ও আধিপত্য দেখে জ্বলে পুড়ে মরছেন। কোশল-রাজকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত করা চাই-ই। কোশল রাজের রাজ্য বড় নয়–তার সৈন্য সংখ্যাও বেশি নয়, কাশীর অধীনস্থ একটি সামান্য রাজ্য–অথচ তার নামই বেশি। কাশী-রাজ মন্ত্রীকে আদেশ করলেন, ‘মন্ত্রীবর, আপনি সৈন্য প্রস্তুত করুন। কোশল-রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাব। তাকে যুদ্ধে পরাজিত করে, রাজ্য। থেকে তাড়িয়ে দেব। দেখি তার নাম থাকে কোথায়?’ মন্ত্রী মনে মনে হাস্য করলেন। ভাবলেন, যে দয়াগুণে এবং মনুষ্যত্বে মনুষ্যের হৃদয় অধিকার করেছে তাকে জব্দ করা কঠিন। বাহিরে রাজাদেশ পালনের আয়োজন করলেন।
যথাসময় কোশল-রাজ সংবাদ পেলেন–কাশী রাজ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ অভিযান করেছেন। হায়, তার জন্যে কত মানুষের জীবন হানি হবে কত পবিত্র রক্ত মাটি সিক্ত করবে। তার চাইতে রাজ্য ছেড়ে পরাজয় স্বীকার করে, রাজ্য ছেড়ে বনে পালিয়ে গেলেন। কাশী-রাজ আনন্দে প্রচার করলেন–যে এতবড় কাপুরুষ, যে প্রাণ ভয়ে এত ভীত, সে কি সিংহের সম্মুখে বুক টান করে দাঁড়াতে পারে? তার সভাসদেরা সে কথা শুনে কোনো উত্তর দিল না মাথা নত করে রইল।
পুরবাসী গোপনে গোপনে কোশল-রাজের জন্যে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে। পরাজিত হয়েও তিনি মানুষের ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলেন না। পুরবাসীর প্রাণ সহানুভূতি ও বেদনায় কোশল-রাজের সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কী বিপদ রে! সে-সব প্রশংসা বিষের মতো কাশী-রাজের কানে লাগে। তিনি যুদ্ধে জিতেও কোশল-রাজকে জব্দ করতে পারছেন না।
ক্রোধে প্রচার করে দিলেন, যে কোশল-রাজের মাথা কেটে এনে দেবে, তাকে লক্ষ মুদ্রা দেব। সে কথা শুনে কাশীর রানীরা পর্যন্ত জিভ কেটে বল্লেন–কী সর্বনাশ, কী অধর্মের কথা!
.
এক কাভালো বন-পথে কোশল-রাজকে দেখে বল্লে-ফকির, দুঃখীর বন্ধু কোশল-রাজের বাড়ির পথ আমায় দেখিয়ে দিতে পারেন। আমি সর্বহারা। দুঃখী কাঙাল। আমার যা কিছু ছিল, সব হারিয়েছি। সাগরে তরী ডুবে গেছে। ভূমিকম্পে ঘর-দুয়ার ভেঙে গেছে। সন্ন্যাসী কাঙালকে ইচ্ছে করে কাশী-রাজ দরবারে উপস্থিত হয়ে করজোড়ে নিবেদন করলেন–মহারাজ দয়া করে আমায় দান করুন। সে বিপন্ন, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বড় দুঃখে পড়েছে। আমি আপনার শত্রু-কোশলের হতভাগ্য রাজা। কাশী রাজ হেসে বল্লেন–ওগো মরণ বিজয়ী বীর। এই আপনার কৌশল। আজ হতে আপনার রাজ্য আপনাকে দিলাম। আপনাকে মরে। অমর হতে দেব না।
যৌবন অন্যায় রক্তপাতে কখনো উল্লসিত হয় না। সে পরাজয় স্বীকার করে, তবু। মনুষ্য বুকে তরবারি হানে না। ছার রাজ্যে, সিংহাসন দিয়ে কী হবে! যৌবনের বজ্র-বাহু দীন-দুঃখীকে পালন করে। তাকে চূর্ণ করবার জন্য কি সে এ শক্তির দান পেয়েছে? না, না, না।
.
০৫. প্রেম ও যৌবন
যৌবন উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে যুবকের সম্মুখে হয়তো কোনো এক প্রভাতে এক নূতন জীবনের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়। এক নব উন্মাদনা বর্ষার প্রচণ্ডতায় তার হৃদয়-সাগর বন্যাবিক্ষুবন্ধকরে তোলে। তার মনের অনুভূতির সঙ্গে কাম ও পাপের কোনো সংস্রব নাই। কাম তার পশু ভাব–প্রেম তার দেব ভাব।
কাম জীবনকে উন্নত করে না-বাসনার তীব্র পিপাসা উত্তরোত্তর বেড়ে তাকে সর্বনাশের গভীর গুহায় টেনে নিয়ে যায়। প্রেম তাকে সংযমী এবং মহৎ করে। দুঃখের বিষয় যুবকেরা এই বয়েসে প্রেমের নব উন্মাদনায় প্রায়ই পাপ পথে ধাবিত হয়–উন্মত্ত নারী সঙ্গ হতে বঞ্চিত থেকে এদেশে যুবকেরা প্রায়ই কুচরিত্রা রমণীর গৃহে আসা-যাওয়া করতে থাকে। ফলে তার পতন ও সর্বনাশ আরম্ভ হয়। এই জন্য আমাদের দেশের লোকেরা প্রেমকে অতি ঘৃণার চোখে দেখেন। প্রেমের অর্থ তারা বোঝেন–বেশ্যালয়ে গমন, পাপ এবং ব্যভিচারের পথে বিচরণ। আমাদের দেশে বিবাহের পূর্বে শতের মধ্যে ৯৯ জনই অবৈধ নারী সংস্রবে একবার না একবার জীবনকে পতিত করে। বাঙলার হাজার হাজার বেশ্যাকে রাজকন্যার হালে যারা রাখে তারা আমাদের যুবকেরা। এই বেশ্যার দল কোনো কাজে পরিশ্রম, কোনো পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করে না–অথচ সংসারে খুব উচ্চ অবস্থায় জীবন যাপন করে। এদের অন্নদাতা সংসারের শত শত যুবক যাত্রী। যাদেরকে সমাজ ধরতে পারে না, চোখে দেখে না, যারা প্রকাশ্যে সাধু! যুবক-যুবতাঁকে বৈধ ও ভদ্রভাবে অভিভাবকদের দৃষ্টির সম্মুখে কেন মিশতে দেওয়া হয় না, তা বলা যায় না। নারীকে একেবারে যুবকের দৃষ্টি হতে গোপন করে রেখে, দেশের নৈতিক আরও দূষিত করা হবে না? গোপনে অভিসারের পথে কে বাধা দেবে? মানব জীবনে প্রেমের যে একটা অতি মহৎ সার্থকতা আছে, সাধারণ শ্রেণীর মানুষ তা অনুভব করে না। প্রেম মানুষকে সংযমী, চরিত্রবান, বলবান, সাধনায় দৃঢ়বান করে–যুবককে সগ্রামশীল, মহৎ ও গৌরবশীল করে।
অশিক্ষিত সমাজ যুবক-যুবতাঁকে হাটের গরুর মতো বিক্রি করে জীবনে তাকে পঙ্গু অলস পশু করে ফেলে। ফলে তার জীবনে কোনো রসানুভূতি থাকে না। বলহীন, সাধনাহীন, পশু সে কামনা করে। গোবেচারী বোকা সহজ মানুষ যারা,–তারা জীবনকে অবস্থার সঙ্গে মানানসই করে নেয়। আত্মায় যাদের আগুন আছে তারা এ জগতের আশা, বাসনা, আনন্দ, আকাঙক্ষা ত্যাগ করে মহত্ত্বের শান্তি পেতে পরকালের জন্য সহিষ্ণু হয়ে অপেক্ষা করেন। অথবা একটা বৃহৎ ত্যাগ ও বৈরাগ্য তাদের জীবনকে কঠিন যন্ত্রণা দেয়। না হয় সে উচ্ছৃঙ্খল, বেশ্যাসক্ত, পথহারা, বাঁধনহারা যথেচ্ছাচারী জীবন যাপন করে। শেষকালে হয় পথে, না হয় ঘরে সান্ত্বনাহীন, আনন্দহীন, দুঃখের জীবন যাপন করে, দুঃখের মরণ মরে।