বাংলাদেশে এইভাবে শত স্থানে যুবকেরা নিজেদের উপর অত্যাচার করে। এর কোনো প্রতিকার হয় না।
আমাদের সমাজ জীবনে কত দিক দিয়ে কত গলদ আছে তার ঠিকানা নেই। জ্ঞান শিক্ষার ও চরিত্র উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সব ত্রুটির অবসান হবে, এমন আশা করা যায়। তবে মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে দ্রুত উন্নতির আশা করা যায় না। মুসলমান সমাজ শিক্ষার জন্যে শিক্ষা করতে চান না। ধর্মের জন্যে, মনুষ্যত্বের জন্যে যদি মুসলমান সমাজ লেখাপড়ার চর্চা করতেন তা হলে এতদিনে নারীশিক্ষা প্রচার হতো। এই অসভ্য সমাজ যেখানে আর্থিক লাভের আশা নেই, সেখানে বিদ্যাচর্চা করতে চায় না। ভালো চাকরি লাভ এদের বিদ্যা চর্চার প্রধান আকর্ষণ। যেখানে সে আশা নেই, সেখানে এদের চেষ্টাও দুর্বল। চাকরির আশা ক্রমশ দেশে কমে আসছে। এ অবস্থায় শিক্ষা লাভের উৎসাহও সমাজ থেকে কমে যাচ্ছে। নামাজ-রোজা করেই এরা পরকালের পাথেয় অর্জন করেন, জীবনের গ্লানি ও 3টি সম্বন্ধে এদের সুতীক্ষ অনুভূতিই নেই। তবে সমাজের উচ্চস্তরের লোক যারা, তাদের উন্নতির প্রতি, জীবনের প্রতি সুতীব্র শ্রদ্ধাবোধ আছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
এই পার্থিব জীবনে, নিজের এবং অপরের যেখানে যে দুঃখ, যে গ্লানি ও ত্রুটি আছে–সে সব দূর করা সভ্য এবং ঈশ্বর মনোনীত সমাজের কাজ। তাই আশা ও উৎসাহে মানব সমাজের ত্রুটি এবং কল্যাণের চিত্র অঙ্কিত করতে সাহিত্যিকেরা সদা সচেষ্ট। তাদের বিদ্যালাভ সার্থক হয়, যারা এসব সাহিত্যিকের চিন্তা ও কল্যাণকে জীবনে গ্রহণ করেন।
.
বাড়িতে হোক, বিদেশে হোক, ছেলেমেয়েদের এক প্রকোষ্ঠে একাধিক ব্যক্তির রাত্রি যাপন উচিত নহে। যে যার প্রকোষ্ঠে দরজা দিয়ে শুয়ে থাকবে। রাত্রির অন্ধকারে অসভ্য সমাজে বহু পাপ অনুষ্ঠিত হয়। যদি সে সুযোগ না থাকে, তবে পাপের অনুষ্ঠানও কমে।
রাত্রিকালে যুবকেরা পার্শ্ববতী সুপ্ত বালক-বালিকাদিগকে আক্রমণ করে। তাদের তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। সরলচিত্ত মাতাপিতা এবং বয়োজ্যেষ্ঠরা যুবকদের পাপ সন্দেহ করেন না। যৌবনকালে অপরিমিত এবং অন্যায় শক্তি ব্যয়ে মানব-জীবনের আয়ুমূলে যে ভীষণ কুঠারাঘাত হয়, তার সংশোধন জীবনে হয় না।–মানব সমাজের এ অতি সাংঘাতিক পাপ। আশা করি, অভিভাবকেরা এ সম্বন্ধে যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করবেন এবং আপন আপন নিষ্পাপ পুত্র কন্যাদেরকে অকাল মৃত্যু এবং জীবনের ভবিষ্যৎ মরণ যন্ত্রণা হতে রক্ষা করতে চেষ্টা করবেন। এ পাপের শেষ ফল আছেই–সেই দুঃসহ দুঃখের হাত হতে কোনোমতে এড়ান নাই।
.
০৪. কঠিন যুদ্ধপ্রিয় জীবন
মনে হয়, যৌবনের একটা আকর্ষণ আছে–জীবনের রুদ্র ভয়াল শোণিত উৎসবের প্রতি! মৃত্যুর সঙ্গে, জীবনের অতি ভীষণ কঠিন অবস্থার সঙ্গে সে খেলা করতে চায়। পৃথিবীর এই সুখ-শান্তি যেন তার ভালো লাগে না। যায় যাবে প্রাণ–এই মানবিক ভাব নিয়ে সে জীবনের ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল খেলায় যোগ দিতে চায়। এই প্রচণ্ড রক্ত-উৎসবের মাঝেও সে গৌরবের মুকুট শিরে ধারণ করতে আকাঙক্ষা করে। জীবনের অনন্ত সমস্যা মাঝে যুবকের প্রাণ অনেক সময় অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে–পৃথিবীর কিছুই ভালো লাগে না। সে মৃত্যুর জন্যে যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হয় পৃথিবীর অফুরন্ত ঐশ্বর্যের প্রতিপালক হয়ে অপার সুখে সে বাস করবে, নয় এই দুঃখ-দীর্ণ জীবনের বন্ধন হতে সে চিরবিদায় নেবে–এই হয়ে দাঁড়ায় তার। মনোভাব। গৃহের সুখ আর সহ্য হয় না–যেন কণ্টকের মতো বিধে। সে চলে যেতে চায় রণাঙ্গনে, মরণকে বরণ করতে, অথবা মরণকে জয় করতে।
জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ হয়। ন্যায় অন্যায় নিয়ে। অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবার জন্যে, যৌবন ক্ষিপ্ত সিংহের বিক্রমে রণক্ষেত্রে ছুটে যায়। প্রচণ্ড উল্লাস তার হৃৎপিণ্ডের রক্তে তরঙ্গিত হতে থাকে। এই রক্তের উল্লাস, যৌবনের এই ক্ষুধা মানুষের জীবনে এক পরম স্বর্গীয় দান। মানুষ কি চিরদিনই বেঁচে থাকে? কত যৌবন অকালে জীবনের সাধ আকাঙক্ষা পূরণ না হতেই ব্যাধি, পীড়ায়, দুর্ঘটনায় কোথায় চলে যায়? এর চেয়ে মানব হিতে, সত্য প্রতিষ্ঠায়, ন্যায় যুদ্ধে গৌরবের মৃত্যু বরণ করাই তো ভালো। যারা মৃত্যুকে ভয় করে তারাই হয়তো বেশি মরে। ঈশ্বরের অনন্ত রহস্য অনুভূতির অতীত। তিনি কোনো অজ্ঞাত নীতি সূত্রে সৃষ্টি শাসন করছেন তা মানুষ কি বুঝতে পারে? যা একটু বোঝে, তাতেই তার বুদ্ধি অবাক এবং বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়।শ্ৰদ্ধার করজোড়ে সে প্রভুকে প্রণাম করে। মনুষ্য মরণের পর কোথায় যায়, তাই বা কে জানে? কে বিশ্বাস করে মানুষের জন্য এক কল্যাণের ভবিষ্যৎ আছে, যেখানে মানুষের সকল দুঃখের চির মীমাংসা হবে। যৌবন সময়ে ভবিষ্যৎ জীবনের পুরস্কার লোভে গৌরবের মরণ বরণ করে। মরণের সঙ্গে খেলা করতে করতে জাগে, হাসিমুখে অনন্তের শয্যায় লুটিয়ে পড়ে।
এ পিপাসা পশুর রক্ত পিপাসা নয়। এ স্বর্ণময় পিপাসা তার মনের কাছে অন্তরের আহ্বান। দূরে কোনো স্বপ্নরাজ্যের মোহন ধ্বনির মতো প্রিয়া অভিসারের নিমন্ত্রণ। স্বর্গচ্যুত বিরহী আত্মার বেদনা-ব্যাকুল, অশু ভরা আহ্বান অথবা সন্তান-হারা জননীর ‘আয় আয়’ ধ্বনির মতো আত্মার কাছে এক শাশ্বত আর্তনাদ।–সে ছুটে যায় এই অসীমের নিমন্ত্রণে–পিপাসা-কাতর আত্মার তৃপ্তির জন্যে। যে দুর্বলা নারী, নিঃসহায় শিশু, পদানত শত্রু, শক্তিহীন বৃদ্ধা, শিল্পী কৃষক, নিরীহ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিক্ষেপ করে সে কখনও যোদ্ধা নয়। শাস্তির পাত্রকে শাস্তি দাও। সৈনিকের প্রাণে অসীম দরদ।–সে মনুষ্য হত্যা করে ন্যায়ের আহ্বানে, ব্যক্তিগত স্বার্থের বা হিংসা-ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নয়। নিরাপরাধের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করা তার পক্ষে মহাপাপ। সে নরভুক শার্দুল নয়, সে শান্তি প্রতিষ্ঠাতা দেবতার সন্তান।-দুঃখের ও অবিচারের শত্রু। সে দুঃখী এবং নিঃসহায়ের রক্ষাকর্তা। তার কাছে কোনো অবিচার নাই।