মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে দিয়ে, তার শিরচ্ছেদ করে জনসাধারণের মনে ভীষণ ভীতি সৃষ্টি করা রাজধর্ম হতে পারে–আমরা রাজা নই, রাজত্ব করি নি, রাজধর্ম বুঝতে পারি না। আমাদের কাছে পিতার বিরুদ্ধে পিতাকে বন্দি করা, সিংহাসনের জন্যে ভ্রাতৃহত্যা–এসব ভালো লাগে না। অথচ মোগল সম্রাটগণ এই সমস্ত জঘন্য কলঙ্কে কলঙ্কিত। জীবনে একটি মানুষ হত্যা করলে জীবনের সমস্ত পুণ্যে তার প্রায়শ্চিত্ত হয় না। আর যারা অর্থ সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে সহস্র সহস্র নর রক্তে ধরণী রঞ্জিত করেছে, তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কী করে হবে? কেমন করে তারা এত মানুষের শোণিত পাতে আপন মস্তিষ্ক ঠিক রাখে? রাজধর্ম যদি স্বতন্ত্র হয়, তবে ঈশ্বরের গ্রন্থসমূহে তার উল্লেখ দেখি না কেন?
.
০৩. পাপ প্রবৃত্তি
যুবক বয়সে যুবকদের শিরায় এক মহাপাপ প্রবৃত্তি জাগে। ব্যভিচার লিপ্সা ছাড়া আর এক রকম পৈশাচিক ক্ষুধা যুবকচিত্তে জাগে যা মনুষ্য ভাষায় বলা অসম্ভব। যে মহাপাপে সডম ও গমোরা (Sodom and Gomora) নামক দুই প্রাচীন নগরী ধ্বংস হয়েছিল, তিক্ত লবণ সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল–সেই পাপ ক্ষুধা মনুষ্য সমাজ হতে এখনও অন্তর্নিহিত হয় নাই–এ আমাদের সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। এখানে একটি সত্য ঘটনা দিচ্ছি।
একটি যুবক–একদা এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আসা-যাওয়া আরম্ভ করলেন। সেই ভদ্রলোকের একটি সুদর্শন পুত্র ছিল। পুত্রটি নিজমুখে তার জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে হাসপাতালে শয্যায় শুয়ে বলেছেন–যাতে–তার গোপনীয় জীবনকাহিনী শুনে দেশের অন্যান্য ছেলেরা এবং তাদের অভিভাবকগণ সাবধান হতে পারেন। তিনি বল্লেন–তখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর। কেবল যৌবন দ্বারে উপনীত হয়েছি। এমন সময় আমাদের গ্রামের আজিজ মিয়া আমাদের বাড়ি আসা-যাওয়া আরম্ভ করলেন। আজিজ মিয়া এখন খুব উন্নতি করেছেন, আমি বিবিধ পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েছি। ইনি মনুষ্য মূর্তি ধারণ করলেও ইহাকে নরপিশাচ বলা চলে। এর জীবনের পাপময় ঘটনা জগতের কাছে প্রকাশিত হলে জগতের মানুষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত হবে নিশ্চয়। আমি এক এক করে সব কথা বলছি। –আজিজ মিয়ার পিতা সম্রান্ত মানুষ। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। আজিজ মিয়াই এখন সংসারের কর্তা। প্রথমা স্ত্রীর উপর আসক্তি না জন্মায় দ্বিতীয় বার বিবাহ করেছেন। প্রথমা স্ত্রী মাতার বোনের মেয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রী নিকটবর্তী কোনো এক গ্রামের কোনো এক সাধারণ গৃহস্থের বিধবা কন্যা। এই যুবকের পিতা উচ্চ রাজকর্মচারী ছিলেন। রাজ কর্মচারীকে খুব সম্মানের চোখে দেখা গৃহস্থ শ্রেণীর লোকের স্বভাব। সুতরাং আজিজ মিয়ার আগমনে আমার পিতা-মাতা খুব খুশি হতেন। আজিজ নিজে শিক্ষিত ভদ্রলোক, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট। বয়স ত্রিশ।
আজিজ মিয়া অনেক সময় আমার সঙ্গে কাটাতেন। পার্শ্বে বসে পড়া বুঝিয়ে দিতেন। সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে হঠাৎ তার বাম হাত খানি আমার বস্ত্রাবমতো লজ্জাস্থানের উপর প্রায়ই রাখতেন। আমি তাতে তাকে অতিশয় সরল এবং নিষ্পাপচিত্ত মনে করতাম। হঠাৎ তিনি একদিন আমায় একখানা চিঠি দিলেন। পত্রখানি এইরূপ–
“যেদিন বিদেশ হইতে বাড়ি আসিয়া তোমাকে দেখলাম, সেইদিন তুমি আমার হৃদয়ে রাজার আসন লইলে। শয়নে স্বপনে দিন রাত্রি নয়নে তোমারই মধুর মূর্তি দেখি, এ জগতে কাহাকেও তোমার মতো সুন্দর দেখি না। মজনু যেমন লাইলীকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছিল, আমিও তেমনি তোমাকে ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছি। তোমার মধুর নাম সর্বদা আমার জপমন্ত্র হইয়াছিল। এ ভালোবাসা রোজ কেয়ামতো পর্যন্ত থাকিবে। এ ভালোবাসা স্বর্ণময়, পবিত্র! এ পবিত্র প্রেমের পুণ্যে আমরা যে উভয়ে বেহেস্তে যাইব, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। ইচ্ছা হয় সর্বদা তোমায় বুকে করিয়া রাখি। দিন রাত্রি ২৪ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১৮ঘণ্টাই তোমার কাছে বসিয়া থাকি। ইহার কারণ কি এখনও বুঝিতে পার নাই? একবার বল, প্রাণ ভরিয়া বল, তুমি আমায় ভালোবাস, নইলে আমি বাঁচিব না তোমার মোহন মধুর ছবি যেদিন হইতে দেখিয়াছি সেদিন হইতে …।”
আমি এসব রঙের কথা কিচ্ছু বুঝি না, তবে মনে মনে এতবড় একজন লোকের এইসব ভালোবাসার কথা মনে করে খুব গর্ব এবং গৌরব অনুভব করলাম। তার ভিতর যে গরল ছিল, তা মোটেই টের পাই নি।
আমার পিতা-মাতা তাঁর নিত্য আগমনে খুব গৌরব বোধ করতেন। ভদ্রলোকের ছেলে, নিজেও শিক্ষিত। সুতরাং তার আগমনে আমাদের মতো লোক গৌরব বোধ করবেই তো। আমি যেন একটা মস্ত বড় লোক হয়ে পড়লাম। ইত্যবসরে কোনো কাজে আমার পিতার খরচে তার সঙ্গে আমার”দার্জিলিং ভ্রমণের দরকার হল।
সেই শহরে যেয়ে একদিন রাত্রে আমার মুখে তিনি অজস্র চুম্বন করলেন। এবং আমি যেন তাঁর পত্নী সেই ভাবে ব্যবহার করলেন। আমি তাকে মৌলবী সাহেব বলে ডাকতাম। –মৌলবী সাহেবের ব্যবহারে আমি যেন মনে কত দুঃখ পেলাম, তা বলবার নয়। আশ্চর্যের বিষয় তিনি তাঁর দুষ্কৃতির জন্য কিছু মাত্র লমিতো হলেন না। যেন কিছুই হয় নি, এইভাবে কথা বলতে লাগলেন। আমি আশা করেছিলাম, তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারবেন না। পবিত্র বন্ধুত্বের নামে একটি ভদ্রলোকের নিষ্পাপ বালকের বুকে তিনি এইভাবে পাপের কীট হয়ে প্রবেশ করলেন। তিনি এরপর ২/১ দিন পর পর আমার সহিত সেইরূপ পাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। আমি লজ্জায় মানব সমাজের কাছে এই নির্দয় পাপের কথা প্রকাশ করতে পারলাম না। বড়ই আশ্চর্যের বিষয়, তাকে কোনোদিন অনুতপ্ত হতে দেখলাম না। তিনি একটি চাকরি পেলেন এবং আমার গুরুজনকে বলে আমাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। আমি বহু প্রকারে তার হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে চেষ্টা করলাম। তাকে বেত দিয়ে প্রহার করলাম। তাতে তিনি অধিক আগ্রহে আমার উপর পত্নীর। ন্যায় ব্যবহার শুরু করলেন। আপন যুবতী স্ত্রীকে ফেলে তিনি আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করতেন। আমাকে অবিশ্রান্ত চুম্বন করতেন এবং আমার জিহ্বা টেনে বার করে চুষে চুষে খেতেন। এতে যে আমার কী কষ্ট হতো তা বলবার নয়। তিনি এইভাবে ৪/৫ বছর ধরে আমার উপর অত্যাচার করলেন। আমার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল। সৌভাগ্যক্রমে এই সময় তিনি দূরদেশে চলে গেলেন এবং পূর্ব পত্নীদের মৃত্যুর পর এক বিত্তশালী ধনী কন্যাকে। বিবাহ করলেন। ইত্যবসরে সংসারের বহু দুঃখে নির্যাতিত হয়ে সান্ত্বনার জন্যে আমিও বিবাহ করলাম। এইভাবে তার হাত থেকে রক্ষা পেলাম। শরীর ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে লেখাপড়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, তাকে কোনোদিন অনুতাপ করতে দেখলাম না। দূরদেশ থেকে কত পত্র আমাকে লিখতেন। চিঠির উত্তর না পাওয়াতে কত বিশিষ্ট ভদ্রলোকের কাছে আমার নামে স্নেহের অনুযোগ করে পাঠাতেন। বাহিরের লোক ভাবতে তিনি আমাকে সরল প্রাণে শুধু ভালোবাসেন, কিন্তু আমি জানতাম তিনি আমাকে কী প্রকার ভালোবাসেন। সেসব অনুযযাগের কোনো উত্তর আমি দিতাম না!”