মানব-প্রেমিক হাজী মহসীন, চিরকুমার হাজী মোহসীন তার জীবন যৌবনকে সার্থক করেছেন বাঙলার মুসলমান যুবকদের আত্মোন্নতির কল্যাণ অনুষ্ঠানে। এতকাল চলে গেল, আর দ্বিতীয় কোনো হাজী মোহসীনের আবির্ভাব বাঙলায় হল না। করটিয়ার জমিদার চাঁদ মিয়া তার বিস্তীর্ণ জমিদারি নিয়ে শুধু এই যৌবন পূজার মঙ্গল উৎসবে দ্বিতীয় মোহসীনরূপে যোগদান করেছেন। বাঙলার মুসলমান সমাজে মনুষ্যত্ব মরে গেছে। যৌবন চিরসমাধি লাভ করেছে। সুখ-অন্বেষী যুবক স্থবিরেরা স্বার্থের দেউল প্রতিষ্ঠিত করে মৃত্যু ও অধঃপতনের পূজা আরম্ভ করেছে। হায় যৌবন! বাঙলার ঘরে ঘরে বৃথাই তোমার জীবন! নিরর্থক তোমার অস্তিত্ব। সকল জাতিই যৌবন গরিমায় জেগে উঠেছে, তুমি শুধু রইলে ঘুমিয়ে। জীবনহীন, প্রাণহীন, আবৃত্তি হল তোমার এবাদত! লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী শয্যায় শায়িত-জীবনের কোনো চিহ্ন নাই, যৌবন তো দূরের কথা।
.
০২. নরহত্যা
প্রাচীন বর্বর যুগের অবসান হল না। বৃথাই সভ্যতার দাবি। সে পশু ছাড়া আর কী? তার আবার ধর্ম!
মানব-যৌবনের স্বভাব সদাই বিদ্রোহী হওয়া ন্যায় ও বিচারের মাথায় পদাঘাত করে যৌবন তার উচ্ছলতা নিয়ে দুর্দম ব্যক্তিত্বে খেয়ালী জীবন যাপন করতে চায়। তার কাছে বিচার, শৃঙ্খলা, মনুষ্যত্ব ও বিবেকের কোনো মর্যাদা থাকে না। সে বেতাল তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবীতে, মনুষ্য সমাজে আপনার উদ্দাম বেগে চরণ ফেলে চলতে চায়। তাই তার শাসন প্রয়োজন। তরবারি ও অগ্নিবাণের ভীতিতে তার সকল উচ্ছলতাকে শাসন করে রাখতে চায়। যৌবনের স্বভাবই বিদ্রোহ–সে চির অশান্ত, উন্মাদ, পাগল।
যদি জগতে রাজা না থাকতেন, শাসন না থাকত, তা হলে মনুষ্য সমাজ আপন যৌবন তেজে বিদীর্ণ হয়ে যেত। রাজার শক্তি দেশ ও জাতিকে, মনুষ্য সমাজকে প্রতাপপূর্ণ শাসন ক্ষমতায় বাঁচিয়ে রেখেছে। জগতে পিতার মতো রাজারও আবশ্যকতা আছে। যেখানে পিতা দুর্বল, সেখানে ছেলেরা এবং মেয়েরা সবাই বিদ্রোহী–যেখানে রাজা শক্তিহীন দুর্বল, সেখানে প্রজার মধ্যে অরাজকতা বিরাজ করে–জাতি বিশৃঙ্খল গতিতে ধ্বংসের পথে যায়।
মানব সমাজের জন্য শাসনের আবশ্যকতা আছে স্বীকার করি, কিন্তু কথায় কথায়। রাজ্য-লোভে বক্ষের রক্ত-পিপাসায় প্রচণ্ড উন্মাদন হাতিয়ার নিয়ে বের হওয়া–বড়ই বেদনার কথা।
Battle; Battle; Battle; এছাড়া যেন আর বীরত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্র নাই। যে জাতি যত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, তার তত সুনাম। কী করে মানুষ তার নিজের দ্বিতীয় মূর্তির বুকে বর্শা বিদ্ধ করে? বড় বেদনার কথা। জাতির বিরুদ্ধে জাতি তীর ধনুক, কামান নিয়ে, আগুন নিয়ে কেমন করে ছোটে! মানুষের ঘরে কি মা, বোন, সন্তান, পিতা নাই–কেমন করে মানুষ একটা শান্তিনিষ্ঠ জাতিকে খুন করতে অগ্রসর হয়। মানুষ কয়দিন বাঁচে? কয়েক দিনের জীবনের জন্য, কীসের জন্য মনুষ্য হত্যা? এই ছাই মাটির পৃথিবীর জন্য? বাংলার শেষ নবাব মীর কাসিম, বান্দ রাজবল্লভ, মহাতাপ চাঁদ, জগৎশেঠ, কৃষ্ণ দাসকে নিজের নিরাপত্তার জন্যে নিশিথ রাত্রে গঙ্গা নদীতে জীবন্ত অবস্থায় গলায় মাটির থলি বেঁধে ডুবিয়ে মারেন। মহাপ্রাণ বৃদ্ধভমতো চুনী সহানুভূতিতে প্রভুদের সঙ্গে স্বেচ্ছায় গঙ্গার পানিতে নিজ প্রাণ দিল। মানুষের প্রতি এই নির্মমতা, মানুষের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা কী প্রকারে মনুষ্য সহ্য করে? এ পাপের শাস্তি মানুষকে ভোগ করতেই হবে। এই ছার রাজত্বের জন্যে মানুষ এতবড় নৃশংস আচরণ করতে পারে?
হে বন্ধু, তোমার পায়ে ধরি! মনুষ্য বুকে বর্শা চালিও না। এ মহা-পাপ করো না। কীসের জন্যে মানব প্রাণের অভিশাপ, তাঁর আঁখিজলের বিষবাণ বুক পেতে নিচ্ছ? দেখ দেখি কেমন করে তোমার বর্শাঘাতে আহতের চোখ দু’টি চিরদিনের জন্যে মুদিত হয়ে যায়, আর কথা বলে না–অভিযোগ করে না।
দস্যু, নর হন্তাকে মানুষ ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলায়–এ সমর্থন করা যায়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষ রোষবশত নিজের পার্থিব সামান্য সুবিধার জন্যে; রাজ্য লোভে মানুষ খুন করে কেন, জাতি বিশেষকে সমূলে চূর্ণ করে ফেলে কেন? এতো জরদস্তি। জোর যার, মাটি তার–এ বর্বর নীতির অনুসরণ।
কথায় কথায় মনুষ্য হত্যার যুগ, রাজনৈতিক অপরাধে মানুষকে ফাঁসি দেবার যুগ, সভ্য জাতিদের ভিতর থেকে বর্তমানে হয়ত চলে গেছে। কিন্তু মানব জাতির যুদ্ধসজ্জা, জাতিতে জাতিতে মারামারি, রক্তারক্তি, কাটাকাটি–এ তোমার কী?
এই সেদিনের কথা–বিশ্ব জয়ের দুর্বার বাসনায় সুসভ্য জার্মান জাতি যৌবন গর্বে ন্যায়-ধর্মকে পদদলিত করে নিরপরাধ বেলজিয়ামকে চূর্ণ করে দিল। ফরাশি সীমান্তে যে ভীষণ অগ্নি তারা প্রজ্বলিত করেছিল–জগতের ইতিহাসে তার তুলনা নাই। ধন্য ফরাশি জাতি! শক্তির অসাধারণ পুত্র ফরাশি, ইংরাজ ও মার্কিনের সাহায্যে নিজের ও পৃথিবীর অবস্থা রক্ষা করেছে। যদি ফরাশি রাজ্য জার্মান হস্তে বিধ্বস্ত হতো, তা হলে না জানি আজ পৃথিবীর অবস্থা কী হতো। হায়, মানুষ ক্ষমতার গর্বে এত অন্ধ হয়! মানুষের শান্তি সুখ সে সহ্য করতে পারে না–এমনই তার হিংসাভরা প্রাণ। সে দেবতা না পিশাচ তা কে জানে? পৃথিবীতে কি পুনঃপুনঃ রক্তারক্তি হতে থাকবে? কি জানি কি কারণে গাজী আবদুল করিমের শান্তিপুর্ণ রাজ্যে ইতালী অশান্তির আগুন জ্বেলে দিল। একটা নিরীহ জাতিকে ইতালী অযথা চূর্ণ করে দিল। হায় রাজ্যলোভ! হায়, মানুষের অবিচার। জোর যার রাজ্য তার। জগতে বিচার কোথায়? ধর্মই বা কোথায়!–মনুষ্য হত্যার বিচার নাই। মনুষ্য হৃদয়ে দয়া কই? মনে হয় পরাভব স্বীকার করাও ভালো, তত্রাচ সমর-প্রবৃত্তি ভালো নয়। রাজ্য ত্যাগ করে বনে গমনও ভালো, তত্রাচ মানুষের বুকের রক্ত দেখতে ভালো লাগে না। জগতের সকল মানুষই কি নিষ্ঠুর ধর্মহীন বর্বর? মানুষ মাত্রেই মানুষের দয়ার পাত্র, মানুষ মাত্রেই মানুষের নমস্য। মনুষ্য হত্যা না করলে কি মানুষের কল্যাণ করা যায় না? সভ্যতার প্রচার হয় না? আঘাত না করলে কি মানুষের সুবুদ্ধি জাগে না? মানুষ কি এতই অন্ধ? সে নাকি ঈশ্বরজাত? মানুষ জাতি নাকি ঈশ্বরের অংশ? আপন আত্মা হতে নাকি ঈশ্বর আদি পিতা আদমকে সৃষ্টি করেছেন? তার পরিচয় কি এই? তার কাজ দেখে তো মনে হয় সে শয়তানের অংশ।