কুষ্ঠব্যাধির মতো মহাব্যাধি আর নাই। যে কুষ্ঠী সেই জানে এই রোগের বেদনা। কুষ্ঠীর জীবনের সকল সাধ আকাঙক্ষা চিরতরে বিলুপ্ত হয়–জীবন চরম দুঃখময় হয়। এর উপর কুষ্ঠীদেরকে মানব সমাজের ঘৃণা ও উপেক্ষা মাথা পেতে নিতে হয়। কুষ্ঠীর কাছে কোনো মানুষ যেতে চায় না–কারণ তার সংস্পর্শে এলে, তার সঙ্গে ওঠা-বসা করলে স্বাস্থ্যবান মানুষেরও কুষ্ঠ ব্যাধি হয়। কী কারণে বিধাতা মনুষ্য সমাজে এই ভয়াবহ ব্যাধি দ্বারা পীড়িত করেন, তা জানি না। তবে এ কল্পনা-সাধ্য মহাপাপের অনুরূপ একটা মহাব্যাধি। এই মহাব্যাধির অনন্ত দুঃখ যার শিরে পড়েছে তার চিরদিনের জন্য সর্বনাশ হয়েছে।
পূর্বকালে ইউরোপ মহাদেশে আইন দ্বারা কুষ্ঠীদেরকে নির্বাসন দেওয়া হতো। যার কুষ্ঠ হয়েছে তাকে মনুষ্য সমাজ থেকে ছিন্ন করে বহুদূরে সমুদ্রের মাঝে রেখে আসা হতো। সেখানে সামান্য খাদ্য দেওয়া হতো। কুষ্ঠী নর-নারীর জীবন ছিল চরম দুঃখের জীবন। অভাব, দৈন্য, মারামারি, কাটাকাটি, অবিচার, ব্যভিচার, দুঃখ–এই সব ছিল তাদের নিত্য সহচর।
কুষ্ঠীর প্রতি মনুষ্য সমাজের দয়া বড় ছিল না। কুষ্ঠীকে দেখে ভয়াবহ শার্দুল জ্ঞানে মানুষ তার কাছ থেকে পালাত। কিন্তু সত্যি কি কুষ্ঠীদের মনুষ্য সমাজের দয়া থেকে বঞ্চিত থাকা উচিত? এই হতভাগ্যদের জীবনের দুঃখ-লাঞ্ছনার প্রতি মানুষ মুখ তুলে চাইবে না? এত বড় দুঃখ লাঞ্ছনার জীবন দেখে কি মানুষ কাঁদবে না? মানুষ এতদিন বোঝে নাই–করুণা সেবা ও প্রেমই ঈশ্বরের পূজা। নিষ্ঠুর শুষ্ক উপার্জনা, গোবিন্দ’ বলে চিৎকার, পাপ জয়ের সংগ্রাম বর্জিত রোজা-নামাজ–এসব ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু না। মনুষ্য সমাজের কাছে বাহবা নেবার প্রচেষ্টা মাত্র। এইসব মূর্খের দল প্রাণে অনুভব করতে পারে না–ঈশ্বর কী! পরকাল ও স্বর্গের লোভে, অপ্সরী সঙ্গ-সুখাশায় অথবা শান্তির ভয়ে এরা মুখে আল্লা আল্লা’ করেন মাত্র। দুঃখী, পীড়িত আর্তের সেবা, অবোধকে জ্ঞানদান করা–এসবই হচ্ছে মানব-জীবনের বড় উপাসনা। উপাসনা আসলে ধর্ম-জীবনের একটা দিক মাত্র। উপাসনার বলে মানুষ কি স্বর্গের দাবি করতে পারে? রোজা নামাজ করলেই মানুষ এক লম্ফে বেহেস্তে যেয়ে বসবে, এও কি সম্ভব? মানুষের জন্য দরদ চাই–প্রেম চাই–আল্লার গুণ জীবনে লাভ করা চাই।
মানব-প্রেমিক দামিয়ান যৌবনের ভোগ-লালসা ত্যাগ করে মালাকো দ্বীপের কুষ্ঠীদের সেবার জন্য একদিন যাত্রা করেন। কতবড় মহান জন ইনি! সার্থক এর জীবন। তাই সর্বজাতিকে আন্তরিকভাবে বলি–আপন আপন জীবনের পাপ বর্জন করে ঈশ্বরের গুণে গুণান্বিত হও, জীবের কল্যাণ কর, আর্তের সেবা কর, বুঝে প্রার্থনা কর।-–এছাড়া সমস্তই বৃথা।
দামিয়ান কুষ্ঠীদের জীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের জীবনের আশা ভরসা মিশিয়ে দিলেন, তাদের মধ্যে থেকে উচ্চ জীবনের কথা বলতে লাগলেন। তাদের জন্য ভালো খাবার, ঔষধ-পথ্য উৎকৃষ্ট পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেন। তাদের মধ্যে বসে একসঙ্গে দয়াল আল্লাহ্ তালার কাছে প্রার্থনা করলেন। আহা! আল্লার একি দয়া! দশ বছর পরে। একদিন তার শরীরেও কুষ্ঠ রোগ দেখা দিল। সেই দিন যেন তার সেবার জীবন সার্থক হল–যে ভেদটুকু ছিল তা দূর করে নিয়ে তিনি তাদের সঙ্গে এক হয়ে গেলেন। তিনি প্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন–”প্রভু! আজ আমার সেবা-নিবেদন তোমার আশীর্বাদের ঐশ্বর্যে রঙিন হয়ে উঠেছে। আজ আমার প্রেম সকল পরিপূর্ণতায় সফল ও সার্থক হল। তোমার এ করুণ প্রেমের নিমন্ত্রণ যেন শেষ পর্যন্ত বহন করতে পারি।” ধন্য বীর! ধন্য তোমার যৌবন! সার্থক হে মহামানুষ তোমার জীবন! কুষ্ঠীদের সেবা করতে করতে একদিন তিনি মহাপ্রস্থান করলেন।
মানুষকে শৃগাল, কুকুর, গরু, ঘোড়ার মতো এককালে ব্যবহার করা হতো। মানুষের কাছে মানুষের কোনো সম্মান ছিল না। জীবিত মানুষের গায়ে এনাটমী শেখবার জন্য অস্ত্র চালনা করা হতো। যোগিনী মাতা রাবেয়া বসরীর শরীরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের কৌতূহল নিবারণের জন্যে তীক্ষ্ণ অস্ত্র চালনা করা হয়েছিল–সে দুঃখের নির্যাতন কাহিনী হয়তো অনেকে জানেন। দেবী রাবেয়া ছিলেন এক ধনী গৃহস্থের কৃতদাসী। নিমন্ত্রিতরা বলে এই দাসীর গায়ের অস্থিবিন্যাস কেমন আমাদিগকে দেখাতে হবে। গৃহস্বামীর আদেশে রাবেয়াকে পশুর মতো ধরে তার শরীরে অস্ত্র চালনা করা হলো। চরম দুঃখ সয়ে রাবেয়া প্রভুর আদেশ পালন করলেন। এই রাবেয়া মহাতপস্বিনীরূপে, সফলময়ী মাতা রাবেয়ারূপে। অনন্ত মানুষের শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। দিকে দিকে সকল দেশে ক্রীতদাস-দাসীর বেদনা উচ্ছ্বাস আকাশ-বাতাস বিষাদ অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে তুলেছিল। দাস-দম্পতির বুকের ধন কেড়ে নিয়ে প্রভু অর্থ লালসায় উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করতেন। যারা স্বামী-স্ত্রী রূপে এক সঙ্গে বহু বছর বাস করেছে, প্রভুর ইচ্ছায় একদিন তাদের একজনকে বহু দূর দেশীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা হল। এ জীবনে তাদের পরস্পর আর দেখা হবে না। বেত্রাঘাতে দাস-দাসীর শরীর ক্ষত-বিক্ষত করা হতো–কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদেরকে ধরা হতো। প্রভু ইচ্ছা করলে তাদেরকে হত্যা করতে পারতেন। মানুষের উপর মানুষের এই অত্যাচার-মহাপ্রাণ ক্লার্কসন নামক এক যুবক চিত্তে কঠিন আঘাত করেছিল! তিনি জ্বলন্ত ভাষায় ক্রীত দাস-দাসীর কঠিন দুঃখের বর্ণনা সভ্য মানুষের কাছে সর্বত্র নিবেদন করলেন। সেই মর্মস্পশী বেদনা কাহিনী পড়ে মানুষ বিচলিত হল। সর্বত্র ঘরে ঘরে এই মহাপাপ প্রথার বিরুদ্ধে কঠিন মন্তব্য প্রচারিত হতে লাগলো। মানুষের যৌবন গরিমা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি ক্লার্কসনের আন্দোলনে বিচলিত হল। দেশের সমবেত বিদ্রোহবাণী দাসপ্রথার মূলে কুঠারাঘাত করলো। বৃটিশ সাম্রাজ্যে দাস ব্যবসা বেআইনী বলে ঘোষিত হল। কালে সমস্ত সভ্য জগত বৃটিশ জাতির পদাঙ্ক অনুসরণ করল, জগতের সবাই মানুষ। সবাই মানুষের ব্যথা মুখ তুলে চেয়ে দেখে–কই একজনও তো একটা কথা কয় না! বিলাতের জনৈক ডাক্তার সমাজ পরিত্যক্ত মানবশিশু, গৃহহারা নারী, অন্ধ খঞ্জ কুষ্ঠীদের জন্যে প্রায় শতাধিক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে যে আর্দশ স্থাপন করে গেছেন, তার তুলনা কোথায়? সর্ব, দেশের যৌবন কি পৃথিবীর পাপ বেদনা দুঃখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হবে?–জাতি জাতিতে রেষারেষি কেন? পুণ্যে এবং পাপে, আলোকে এবং আধারে, সত্যে এবং মিথ্যায় যে মহাসংগ্রাম জগৎ জুড়ে চলেছে সেই মহাসগ্রামে হে মনুষ্য যৌবন, তোমার সমস্ত গরিমায় তুমি জেগে ওঠ। জগতে পুণ্যের আলোক এবং সত্যের জয় হোক। অন্যায়, অত্যাচার, মিথ্যা, পাপ, দুঃখ লজ্জ্বিত হোক।