এই সময় কার্থেজের কাউবার সম্ভান্ত অতিথি রাজধানী টায়ার নগরে এসেছিলেন। কার্থেজ টায়ার নগরের অন্যতম বিশাল সমৃদ্ধিশালী উপনিবেশ যেমন আজকাল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ইংরেজ জাতির উপনিবেশ। তেমনি প্রাচীন পরাক্রমশালী ফিনিসীয় জাতির উপনিবেশ ছিল আফ্রিকার উত্তরকূলে অবস্থিত মহানগরী কার্থেজ। কার্থেজের অতিথিরা বল্লেন–আলেকজাণ্ডার কখনও শুভ অভিপ্রায় নিয়ে নগরে প্রবেশ করবেন না। দেবীর পূজা দেওয়া তার একটা ছল মাত্র। যদি এজন্য অস্ত্রধারণ করতে হয়, তবে কার্থেজবাসী তার জন্মদাতা টায়ার নগরকে অবহেলা করবে না। আলেকজাণ্ডার দিগ্বিজয়ী রাজ্য-লোলুপ সম্রাট। তাকে নগরে প্রবেশ করতে দেওয়ার অর্থ তার কাছে আত্মসমর্পণ করা, তার ক্ষমতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করা। মানুষের প্রতি যৌবনশক্তির কী দারুণ অপব্যবহার হতে পারে, তাই বোঝাবার জন্যে আলেকজাণ্ডারের টায়ার ধ্বংসের কাহিনী এখানে দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত রাজ্য জয় করেও গর্বিত যৌবনের রক্ত দমে না। এর মতো আক্ষেপ আর কী? মানুষ চোর ও দস্যুকে ঘৃণা করে। কারণ তার শক্তি কম। সে বাধা দিতে সমর্থ হয় না। সে আপনার ক্ষমতাকে অপরাজেয় করে রাখতে সমর্থ নয়। অত্যাচারী সম্রাট আর দস্যুতে পার্থক্য নাই। আলেকজাণ্ডার টায়ারের উদ্ধত অস্বীকারে অতিশয় বিরক্ত হলেন–তিনি। রামের মতো সমুদ্র বন্ধন করে টায়ারে প্রবেশ করতেই স্থির করলেন। যে অজেয় মনুষ্য শক্তি মনুষ্য হিতে ব্যয় হতে পারত, তাই প্রযুক্ত হল মনুষ্য হনন আশায়। আজ্ঞামাত্র সহস্র সহস্র সৈন্য সাগর বন্ধনে শক্তি নিয়োগ করলো। সহস্র সহস্র বিশালাকার পাষাণ খণ্ড, বৃহৎ বৃহৎ বিশাল বৃক্ষরাজির জলমধ্যে নিক্ষিপ্ত হল, তার উপর পর্বত প্রমাণ মৃত্তিকাক্কুপ স্থাপিত হল। টায়ারবাসী তখন নিরাপত্তা আশঙ্কা করে সম্রাটের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য। বিরুদ্ধ চেষ্টা করলেন। তারা শত শত বিশাল তরী সেতুর পাশে আনয়ন করে ডুবুরি পাঠিয়ে সেতুকে ভগ্ন ও শিথিলমূল করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। উভয় পক্ষে সমানভাবে চল্লো। একদল মানুষের হৃদয় রক্ত পান করবার দুরাশায়, আর একদল আত্মরক্ষার বেদনায়। নগরের বহু নারী এবং প্রাচীন ব্যক্তি পূর্বেই কার্থেজে প্রেরিত হল।
টায়ারবাসী ভীষণ বাধার সম্মুখে যখন সম্রাট ভ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়লেন–তখন তিনি কাউবার নৌযুদ্ধবিশারদ জাতির সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তারা রোষ উৎপাদনের ভয়েই আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে যোগ দিলেন।
অতঃপর টায়ার প্রবেশের পূর্বেই সেতু বন্ধন ব্যাপার অবলম্বন করে উভয় দলে সুতীব্র যুদ্ধ চলতে লাগলো। বহুদূর হতে তীর নিক্ষেপ, অগ্নিবর্ষণ, গলিত তপ্ত লৌহ এবং উত্তপ্ত বালুকারাশি পরস্পরের গায়ে বর্ষিত হতে লাগল। আলেকজাণ্ডার মাত্র চতুর্বিংশ বর্ষকাল জগতে বেঁচেছিলেন, এরই মধ্যে জগতে তিনি যে নৃশংস লোমহর্ষক কাণ্ড করে গেছেন, দেশে। দেশে রক্তের অক্ষরে তা চিরদিন লেখা থাকবে। এই কী যৌবনশক্তির যোগ্য ব্যবহারঃ
অবশেষে বহু শত্রু-পরিবেষ্টিত, অভিশাপ, অত্যাচার ও দানব শক্তির প্রতীক আলেকজাণ্ডারের হাত থেকে টায়ার আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হল না। টায়ারের রাস্তাসমূহ নররক্তে ধৌত হয়ে চল্লো। একই দিনে ক্রুদ্ধ সম্রাটের আজ্ঞায় ত্রিশ সহস্র ব্যক্তির শিরচ্ছেদ হল, পনের হাজার ব্যক্তিকে দাসরূপে বন্দি করা হল। এই তো মানুষের পৌরুষ!
মানুষের প্রতি মানুষের কী ভয়াবহ রোষ আর হিংসা! মানুষ কি সত্যিই কুকুর নয়?
এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বহুভাষাবিদ উইলিয়াম জোনক নাদির শাহের জীবনী ফরাশি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। নাদিরের শৌর্য-বীর্য না তার অমানুষিক অত্যাচার কাহিনী তিনি জগদবাসীকে জানাতে চেয়েছেন, তা তিনিই জানেন। রক্তলোলুপ নাদির শাহ মনুষ্য হত্যায় যেরূপ আনন্দ লাভ করতেন এমন অতি অল্প লোকই করে! মনুষ্য-জীবন এদের কাছে কীটের জীবন অপেক্ষা তুচ্ছ।
মোগল–শক্তি তখন ধ্বংসের পথে। প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সিংহাসনে দুর্বল শক্তি মুহম্মদ শাহ্ সমাসীন। নাদির দিল্লীতে প্রবেশ করে মোগল রাজ-প্রসাদে বাস করেছেন। কে বা কারা তার মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ বর্ণনা করে, তার কতিপয় সৈন্যকে হত্যা করে। ফলে নাদির দিল্লীর নিরপরাধ অধিবাসীবৃন্দকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শিরচ্ছেদের আদেশ দিলেন। বিচার নেই–সৈন্যগণ একদিক থেকে দিল্লীকে শ্মশানে পরিণত করলেন।
নর-শার্দুল আহমদ শাহের তরবারি ধারণ–যৌবনশক্তির নিতান্ত অপব্যবহারেরই পরিচয় দিচ্ছে। লুণ্ঠনই যেন এদের ব্যবসা নরহত্যাই যেন এদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। ধর্মহীন, মায়াহীন এইসব অর্থলোভী দস্যুর দল কী জন্যে জগতে এসেছিলো, জানা যায় না। খোদাতালা হয়তো মানব জাতির শাস্তির জন্যে অভিশাপরূপেই এদেরকে জগতে পাঠিয়েছিলেন। নাদির শাহ্ সাধের দিল্লী নগরকে মহাশ্মশানে পরিণত করলেন। তৃতীয়বার পানিপথ ক্ষেত্রে মারহাট্টা এবং আহমদ শাহের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, উক্ত যুদ্ধে দুই লক্ষ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ ত্যাগ করেন। কী উদ্দেশ্যে, কোন কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য এইসব হতভাগ্য একই দিনে প্রাণ বিসর্জন করে? ব্যক্তিবিশেষের হত্যা ও লুণ্ঠন স্পৃহাই বিরাট হোলিখেলার কারণ। এইসব ভয়াবহ চিত্রের পার্শ্বে ফরাশি সাধু দামিয়ানের চিত্র স্থাপন করা যাক। মানবপ্রেমিক দামিয়ান, চিরকুমার হাজী মহসীন, ক্লার্কসন, উইলিবার ফোর্স প্রভৃতি মহামানবের জীবনচিত্র পূর্বকথিত ভয়াবহ জীবনচিত্রের পার্শ্বে কত মহৎ, কত উজ্জ্বল। একটি যেন ঊর্ধ্বে নক্ষত্র বিখচিত দেবতোক আর একটি যেন নিম্নে আঁধার মরণ-শঙ্কাপূর্ণ জ্বালাময় প্রেতপুরী। একটিতে আনন্দময় জীবন আর একটিতে ভয়াবহ মৃত্যুর অভিশাপ।