নিত্য মারামারি, কলহ, শৃগাল-কুকুরের মতো কাড়াকাড়ি দ্বেষ-হিংসা, ঘৃণিত সাংসারিক বিষয়ে প্রতিযোগিতা, আড়াআড়ি, অর্থলোভ, স্বার্থপরতা, সম্পত্তি, অট্রালিকা এই-ই কি মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণের বস্তু? কয়দিন এগুলি ভোগ করতে পারবে? শেষকালে কোথায় যাবে?
.
১৭. জীবনে ফকরামি ও চালবাজী
দুই একটি যুবক এত ধাপ্পাবাজ, মিথ্যাবাদী, তা আর বলা যায় না। এসব ধাপ্পাবাজী করে তাদের লাভ হয় না, তবু তারাও না করে পারে না। নিজের একটুখানি সুবিধার জন্যে, শত মিথ্যা বলতে একটু লজ্জা এদের নেই।
কোনো কোনো যুবক শঠামিতে বেশি বিশ্বাসী। সত্যে কিছু মাত্র শ্রদ্ধাশীল নয়। মিথ্যা বলতে একটুও লজ্জা নেই। সর্বদা নিজের লাভের লোভে জোড়াতালি দিয়ে, অসরলভাবে কথা বলে। কথায় এদের বিন্দুমাত্র সরলতা নেই।
বিপদে পড়লে এরা কুকুরের মতো নত হয়। একটু শক্তি লাভ করলে পুনরায় আপন শঠতাপূর্ণ পথ গ্রহণ করে। দয়া, মনুষ্যত্ব, ত্যাগস্বীকার, পরোপকার–এদের কাছে স্বপ্ন, জীবনের খেয়াল মাত্র। এরা কখনও ধর্ম কথা শুনতে চায় না–ওসব বিশ্বাসও করে না। এদের ভয়াবহ জীবনের স্পর্শে যারা আসে তারাই বিপদে পড়ে।
এরা বেশ মিষ্টি কথা বলে–এদের মন্দ বলে ধরবার কোনো উপায় নেই। শুধু একটু ব্যবহার করলেই বোঝা যায়–এদের প্রকৃতি। এদের বিষ কোথায় লুকানো থাকে, তা প্রথমাবস্থায় মোটেই বুঝতে পারা যায় না। শেষকালে এদের পতন অপরিহার্য। আপন জালে আপনি আবদ্ধ হয়ে এরা শোচনীয় দুর্গতি লাভ করে। সত্য ও ধর্ম পথই একমাত্র। মানুষের জীবন ও কল্যাণের পথ। সত্যপন্থী হেরেও শেষ কালে জয়ী হয়।
.
১৮. প্রভু ভৃত্য
আজকাল দেখা যায় যুবকেরা প্রভুর অধীন কার্য করে প্রভুর অন্নে প্রতিপালিত হয়; কিন্তু মনে মনে প্রভুর প্রতি ষোল আনা অকৃতজ্ঞ থাকে। যিনি অন্ন দিয়ে পালন করেন, তিনি পিতার তুল্য। তার নিকট কৃতজ্ঞ থাকা সর্বতোভাবে কর্তব্য।
প্রভুকে অমান্য করা, তার নিন্দা করা, তার কার্য ষোলআনা না করা, ভৃত্যের উচিত নহে। প্রভুর মঙ্গল সর্ব প্রকারে অন্বেষণ কর–তাই প্রকৃত ধার্মিক ভুত্যের কাজ।
কোনো কোনো যুবক বলেন, অপরের দাসত্ব করা আমার পক্ষে শোভা পায় না। এ উদ্ধত শয়তানের ভাব ছাড়া কিছু নহে। অতি শ্রেষ্ঠ লোককেও সময় অবস্থাচক্রে কারও দাস হতে হয়, তাতে লজ্জার কিছু নেই। আলস্য করে জীবন নষ্ট করা পাপ। হয় নিজের কাজ, না হয় পরের কাজ কর। শক্তি ও জীবন ব্যর্থ কর না। সেবা ও দাসত্ব ছাড়া জগৎ চলে না। যতক্ষণ অপরের দাসত্ব কর, ততক্ষণ প্রভুর কাছে অহঙ্কারের পরিচয় দিও না। প্রভুর কাছে সর্ব প্রকারে নত হও–তুমি যতই পণ্ডিত ও শ্রেষ্ঠ হও যার কাছে দাসত্ব স্বীকার করেছ, তিনি মূর্খ ও ছোট হলেও তোমার প্রভু তিনি। প্রভুর মঙ্গল কামনা করাই ভৃত্যের ধর্ম। কারও সেবা করায় মানুষের অপমান হয় না, যদি পরিপূর্ণ সেবা দ্বারা প্রভুর সন্তুষ্টি সাধন করতে পার তাতেই মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব প্রকাশ পাবে। প্রভু হয়েও মানুষ মনুষ্যত্বে এবং কর্তব্য পালনে আপন ভৃত্যের কাছে ছোট হতে পারেন। ছোট ও বড় হও,–যিনি জীবনে আপন কর্তব্য পূর্ণভাবে পালন করতে পারেন, তিনিই মহৎ। রেলের একজন কুলিও মহৎ ব্যক্তি হতে পারে। একজন ডেপুটির আদালিও মনুষ্যত্বে ডেপুটির চাইতে শ্রেষ্ঠ হতে পারে। যে নমস্কার পায়, সেই শ্ৰেষ্ঠতা বলা যায় না। যে নত হয়ে প্রভুকে নমস্কার করে সেই মনুষ্যত্বে হয়তো প্রভু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
যে জীবনে আপন কর্তব্য পূর্ণভাবে করতে পারে সেই বড়। যে বিশ্বাস-ঘাতক, আলস্যপরায়ণ, উচ্চাসনে বসে থাকলেও সে ছোট।
নমস্কার করতে কখনও লজ্জাবোধ করো না। নমস্কার করলে মানুষ ছোট হয় না সে বড়ও হতে পারে। প্রভুর কাছে যত ছোট ও নত হও ততই ভালো। প্রভুকে যত প্রকার সেবা করতে পার, কর। আজকাল অকৃতজ্ঞতা, অবাধ্যতা ও ঔদ্ধত্যের যুগ পড়েছে। মন্দতায় মানুষ উৎসাহশীল, মন্দতায় মানুষ মানুষকে প্রশংসা করে। মানুষ যেন একেবারে ধর্মহীন হয়েছে। অধর্মের যুগ পড়েছে। তাই মানুষও মানুষকে প্রেম করে না। আজ পুত্র পিতার কাছে নত হয় না, প্রজা রাজাকে শ্রদ্ধা করে না, স্ত্রী স্বামীকে অপদস্ত করে, ভৃত্য প্রভুকে মান্য করে না। ফলে মানুষের যথার্থ উন্নতি হয় না। প্রত্যেকে প্রত্যেককে অবিশ্বাস করে–ফলে কাউকে কেউ ভালোবাসে না। শিক্ষা মানুষকে যেন পশু করেছে। যেন চড়াছড়ি, মারামারি, খুনোখুনি দ্বারাই জগৎ চলবে। প্রেম, সেবা, মনুষ্যত্ব, দয়া, ভালোবাসার প্রভাব যেন মানব সমাজে আর নেই। রাস্তার ভিক্ষুক রাস্তাতেই মরতে থাকবে। এই হচ্ছে এখনকার মানুষের কথা। কেউ কারো দিকে তাকাবে না।
কিন্তু এটি ঠিক পথ নয়। যা শয়তানি ভাব তা কখনও শান্তির পথ নয়। জগতে একটি সাংঘাতিক উলট পালট আসবে, তারপর মানুষ এক নূতন ধর্মের সন্ধান পাবে। সহজে মানুষের চৈতন্য হয় না।
.
১৯. Honourable ব্যবহার
যে ব্যবহার গলদশূন্য তাকেই Honourable ব্যবহার বলে। দোষশূন্য মহৎ ব্যবহার ভদ্রলোকের জীবনের ভূষণ। জনৈক পুলিশ ইনস্পেক্টর জীবন ভরে একটি নির্দোষ ব্যক্তিকে ক্রোধের বসে দুঃখ দিয়াছিলেন, শেষকালে একদিন অতিশয় বিপন্ন হয়ে এই ব্যক্তির হাতে পড়েন। ভদ্রলোক ইচ্ছা করলে পুলিশ কর্মচারীকে যারপরনাই অপদস্থ করতে পারতেন। কিন্তু সে কথা একবর্ণও না তুলে তিনি তাকে অতিশয় সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন, তাকে আহার করালেন, তার জীবন রক্ষা করলেন। এবং যথাসময়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিলেন। পরের দিনই কর্মচারী কর্মত্যাগ করে তার জীবনব্যাপী পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন। সেই ভদ্রলোকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, বালকের মতো তার সম্মুখে অশ্রু বিসর্জন করলেন।