.
১৪. যুবকদের বাহুল্য খরচ
অভিভাবকহীন যুবকেরা যে কত রকমে বাহুল্য খরচ করে তার ইয়ত্তা নেই। কলেজে পড়ার সময় যুবকদের মনে বুড়া বাপ-মা’র জন্যে কিছুমাত্র মমতাবোধ থাকে না। কেবল টাকার জন্য চিঠি বাড়ি আসে। কত অজুহাত–যেমন নতুন বই কোনো, কলেজের মাইনে, ঔষুধ খরচ ইত্যাদি দিয়ে নানা ভাবে বুড়া বাপের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। পড়ার বেলা হয়তো গল্পসল্প করেই সময় কাটে। পোশাক এবং ইয়াকী করতে ষোল আনা, যুবকদের পিতৃনিন্দাও মুখে লেগে থাকে। এত যে টাকা দেওয়া হয়, তবু ছেলের মন পাবার জো নেই। এইসব হতভাগা কাণ্ডজ্ঞান হীন ছেলের লেখাপড়া হবার আশা খুব কম। তবু বুড়া বাপ-মা আশা ও আনন্দে এদের পেছনে অজস্র টাকা ব্যয় করতে থাকেন।
শাসন করেও কোনো ভালো নেই–সেয়ানা যুবক ছেলেকে শাসন করে পড়তে বাধ্য করা যায় না। এত দৌড়াত্ম করেও যদি পরীক্ষায় পাস করতে পারে, তা হলে মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়।
যুবকদের মনে করা উচিত, সংসারে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করা বড় কঠিন। বাবা বিশেষ হিসাবী বলে টাকা দিতে পারছেন। নিজের শত অভাব ঠেলে ফেলে ছেলের অভাবের কথাই আগে ভাবেন–যদি যুবক ছেলে বাপের হৃদয় বেদনা একটুখানি বুঝতো, তা হলে নিশ্চয় সে সুবোধ হতো। পড়া-লেখাও মন দিয়ে করতো। যথা সময়ে পাস করে দেশের ও দশের প্রশংসাসহ বাড়ি ফিরে আসতো, সংসারে সুখে থাকতে পারত।
বাপ-মাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে, নানা প্রকার বাহুল্য খরচ করে, থিয়েটার-বায়োস্কাপ দেখে, পোশাক-পরিচ্ছদ করে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে ছেলে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি আসে, শেষকালে দেখা যায়, ছেলে ফেল ডিভিসনে পাস করেছে। বাড়ির কাছে যদি কোনো মাইনর স্কুল থাকে, তবে ছেলে সেখানে যেয়ে অবৈতনিক শিক্ষক হয়। টাকার দংশন বেদনা সহ্য করা বড়ই কঠিন কার্য। হাতে টাকা থাকলে যত বেলা তা খরচ করে নিঃসম্বল এবং রিক্ত হস্ত না হওয়া যায়, তাবৎ যেন আর শান্তি থাকে না। বুদ্ধিহীন যুবকদের হাতে টাকা পড়লে তা যে অতি অল্প সময়ে নিঃশেষিত হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংসারে যদি কোনো নগদ টাকা থাকে তবে তা খুব গোপনে কোনো প্রবীণের হেফাজতে রাখা উচিত, নইলে সে টাকা কিছুতেই থাকবে না। পিতার মৃত্যুর সঙ্গে যুবকেরা হাতে টাকা পেয়ে দুই হাত দিয়ে বাহুল্যভাবে খরচ করতে থাকবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা কেউ বোঝে না। যতদিন টাকা থাকে, ততদিন যুবকেরা তার মূল্য বুঝে না।
যে টাকার উষ্ণতা সহ্য করতে পারে, কৃপণের মতো খরচ না করে টাকা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে–সে জীবনে সুখে থাকে। জীবনে তার দুঃখ হয় না। সঞ্চয়ের বুদ্ধি সকলের থাকে না অধিকাংশ যুবকই বাহুল্য খরচে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে।
নগদ টাকা বহু সম্পত্তি ছেলেদের না দিয়ে কোনো সৎ প্রতিষ্ঠানে দান করে যাওয়া ভালো। ছেলেরা যাতে ভদ্রলোকের মতো চলে, তার শি দিলে তাদের অধঃপতনের পথ প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। প্রথম জীবনে মনুষ্য নিতান্তই অপরিপক্ক বুদ্ধি ও ছেলেমানুষ থাকে! আঘাত, অভাব, বেদনা ছাড়া মানুষ কখনও শিক্ষাপ্রাপ্ত হয় না।
মানুষ কেউ কাউকে সুখী ভালো ও বড় করতে পারে না। আপন যোগ্যতায় মানুষ যোগ্যস্থান ঠিক করে নেয় উচ্চাসন দিলেও, সে আসনের মর্যাদা ঠিক রাখতে পারে না। এ কারণে ছেলেদের যতটুকু দরকার তার এক ক্রান্তি বেশি দিয়ে তাদের সর্বনাশ করা উচিত নয়। মানব কল্যাণের জন্য উন্নতপ্রতিষ্ঠানে জীবনের সঞ্চিত ধন ব্যয় করা, যথার্থ জ্ঞানীর কার্য–ছেলে-পেলেকে দেওয়া মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের কী এমন দাবি আছে। পিতার উপর, যাতে করে তারা পিতার সমস্ত ধনরত্ন নিজেরাই অধিকার করবে? সন্তানেরা বছরেও হয়তো পিতার কথা একবার মনে করবে না–পোতা ছেলেরা তো জীবনেও। একবার করবে না। ছেলেদের শিক্ষাকালে তাদের ন্যায্য খরচ দিতে কৃপণতা করা উচিত নয়। অবশ্য সে কথা পুত্রদের বলা উচিত নয়।
বড়ই দুঃখের বিষয়, অনেক লোক যুবকদেরকে তাদের পিতার নিন্দা করে তাদেরকে পিতৃদ্রোহী করতে চেষ্টা করেন। পিতার কার্যে কোনোরূপ ভুল ধরা পুত্রের পক্ষে অনুচিত। পিতা যে সাহায্য করতে পারেন, তাতেই সন্তুষ্ট থেকে জীবন পথে অগ্রসর হবে। পিতার কোনো কার্যের সমালোচনা করা মহাপাপ। পিতার অমতে কোনো ধর্মকাৰ্য, কোনো সন্ধার্য সিদ্ধ হয় না–তার ইচ্ছা পালন করাই সুবোধ পুত্রের কাজ। যা মহাপাপ তা করবে না, করলেও সে পাপ পুত্রের হবে না, পিতারই হবে। বিদেশে যুবকদের চরিত্র খারাপ হতে পারে। এর ঔষধ পুত্রকে সদুপদেশ দেওয়া, সস্নেহ ব্যবহার করা। যুবক বয়সে ছেলেদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করলে, তাদের চরিত্র খারাপ হবার খুবই সম্ভাবনা।
যুবকেরা যদি বেশ্যালয়ে গমন আরম্ভ করে, সমাজে মিশে সুরাপান অভ্যাস করে তা হলে তো সে বাহুল্য খরচ করতে শিখবেই। যুবকদের এ অভ্যাস হলে তো সর্বনাশের পথ রচিত হবেই। যদি তাই হয়, তবে লেখাপড়া বাদ দিয়ে বাড়ি এনে সাংসারিক কাজের ভার দেওয়াই ভালো।
যার ভিতর একবার এ পাপ প্রবেশ করেছে তাকে মরণ গহ্বরে টেনে না নিয়ে আর এ পাপ তাকে ত্যাগ করে না। এই সময় কোনো উচ্চস্তরের বন্ধুর চরিত্র প্রভাব এবং সহবাসই তার পক্ষে উত্তম ঔষধ। এ সম্বন্ধে প্রকাশ্যে বকাবকি করাও উচিত নয়–তাতে লজ্জা ভেঙ্গে যায়, ফল খারাপ হয়।