সাইকেল, ঘড়ি–এসব কিনবার বাতিক যুবকদের এক সময়ে চেতিয়ে তোলে–অথচ এগুলোতে প্রকৃত আবশ্যকতা ছেলেদের খুবই কম। যেখানে আবশ্যকতা, সেখানে ব্যবহার করা অবশ্যই উচিত! আসল কথা লোক দেখান প্রবৃত্তিটা বড়ই খারাপ।
.
১৩. সাহিত্যের সঙ্গে যোগ
যে-সকল যুবকের বাঙলা সাহিত্য অর্থাৎ দেশীয় সাহিত্যের উপর প্রভাব নেই–তাদের পরিপূর্ণ শক্তির স্ফুরণ হয় না। তাদের আত্মিক মূল্য জীবনে অনেক কমে যায়। সু-সংস্কৃতি ভাষা, সূক্ষ্ণ চিন্তা আপন মাতৃভাষায় প্রকাশ করবার ক্ষমতা মুসলমান যুবকদের একটা সহজ পারিপার্শ্বিকতা, ঘটে ওঠে না, তারা ভালো করে কথা বলতে পারে না, যেন সবসময় একটা বন্ধন, একটা জড়তার ভাব প্রকাশ্য (public) জীবনে লেগেই থাকে। দেশের মাতৃভাষা, বাঙলা ভাষায়। লিখিত খবরের কাগজ, বিভিন্ন মাসিকের সঙ্গে যোগ রাখা চাই–নইলে দেশের অন্তর্নিহিত আত্মার সঙ্গে একটা গভীর যোগ, আত্মীয়তা এবং পরিচয় হয় না। যুবকদের স্বভাবে যেন সর্বদা একটা বিদেশী অনাত্মীয়ের ভাব জড়িয়ে থাকে, আপন দেশের সঙ্গে যেন তারা অপরিচিত, যেন ভুল করে ঘটনাক্রমে মুসলমান যুবকেরা, এদেশে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই যে অস্বীকারের ভাব, এটা মুসলমান যুবকদের জন্য কত বড় ক্ষতির কথা তা বলবার নয়।
জীবন যত জটিল হয়, দেশের সাহিত্যও তত জটিল হয়। আমাদের দেশের যুবকদের জীবনে কোনো সাধনা নাই, নূতনত্ব নাই, বৈচিত্র্য নাই–শুধু, একঘেয়ে পরাধীন জীবন। বাল্যকালে লেখাপড়া শেখ, প্রৌঢ় অবস্থার চাকরি বা ব্যবসা বা কৃষি কর, বুড়াকালে বিশ্রাম কর। ধর্ম জীবনেও তাদের কোনো আন্তরিকতা নাই–একটা সাধারণ অভ্যাস পালন করে গেলেই কাজ শেষ হল। এ জীবনে আর কী বৈচিত্র্য থাকবে? নারী-পুরুষের সঙ্গে জীবনের যে একটা আত্মীয়তা, সেখানেও কোনো সাধনা বা কষ্ট করতে হয় না। যেখানে বন্ধন সেখানেই মুক্তির চেষ্টা। আমরা পরাধীন জাতি–সুখের নন্দদুলাল। সুবোধ শিষ্ট হয়ে কাজকর্ম করে যাচ্ছি। আমাদের জীবনে বন্ধন নেই–মুক্তির চেষ্টাও নেই।
লোক-সমাজে মিশতে গিয়ে বহু চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। লোক-চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হলে, যেসব সাহিত্যিক গল্প-উপন্যাসের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্মভাবে লোক-চরিত্র অঙ্কন করতে পারেন তাদের বই পড়া উচিত। সমাজের মধ্যে মানুষের দৈনিক জীবনে যে-সব ঘটনা ঘটে, তার সুখ-দুঃখের কাহিনী, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার, প্রতারণা, উন্নত ধর্মজীবন–এসব উপন্যাসে অঙ্কিত করা হয়। সে-সব পুস্তক পাঠ করলে মনুষ্য সমাজ সম্বন্ধে সূক্ষ্ম অভিজ্ঞতা জন্মে। পূর্বেই বলেছি,–আমাদের সমাজে জীবনের বৈচিত্র্য নেই। বিশেষ করে মুসলমানদের জীবন যেন একেবারেই একঘেয়ে–যেন সবাই মৃত। সজীব আত্মায় চিন্তা, বিচার, পাপের সঙ্গে সগ্রাম যা মনুষ্য জীবনকে বিচিত্র করে, তা যেন মুসলমান সমাজে নেই। সুতরাং এই সমাজে ভালো কথাসাহিত্য সৃষ্টি হওয়া খুব কঠিন। তবু এ সমাজে দুঃখ ব্যথার অন্ত নাই। সমাজকে সুখময়, শান্তিপূর্ণ, সম্পদশালী, সম্মানী করার সাধনা যেদিন সমাজে জাগবে, সেদিন থেকে সমাজে ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া শুরু হবে। এই দিক দিয়ে মুসলমানদের এক অভিনব সৃষ্টির পথ পড়ে আছে। যোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়লে অভিনব সাহিত্য প্রভাবে সমাজে নব জীবনের সঞ্চার হবে, বিপুল কর্মসাধনা জাগবে, সমাজের জয়যাত্রা শুরু হবে। সে শুভ সময় কতদিনে আসবে, তা বলা যায় না। শিক্ষিত মাত্রেই আপন আপন সুখ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ সমাজের জন্য দুকলম লেখেন না। সাহিত্যিক হওয়া তো দূরের কথা, যারা লেখেন, তাদের প্রতি কোনো উৎসাহও নাই। বাল্যকালে কিছুদিন কোরান পড়লে, ছাত্র জীবনে পাঠ্য-পুস্তকগুলি পড়ে শেষ করতে পারলেই জীবনের শিক্ষা পূর্ণ হল। নতুন নতুন বই পড়বার আকাঙ্ক্ষা সমাজের নেই। হিন্দু সমাজের মেয়েরা যে-সব বই পড়ে, মুসলমান সম্রান্ত ও পদস্থ ব্যক্তিরাও ততখানি বই পড়ে না। কী উন্নতি আমাদের পক্ষে সম্ভব? আপন দেশ, মাতৃভাষা, জীবিত মনুষ্য সমাজে এবং পৃথিবীকে অস্বীকার করে চলাই আমাদের স্বভাব। আমরা যেন সবাই পরকালের মানুষ, যেন এ জগতের সঙ্গে আমাদের কোনো সংশ্রব নেই। এতেই আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে। আমাদের বোঝা উচিত–ইহজগতের কাজের উপর পরকাল নির্ভর করে। ইহকালের। জীবনের উন্নতির উপর পরকালের উন্নতি নির্ভর করে। কবি বলেছেন–
সংসারে সংসারী সাজ;
কর নিত্য নিজ কাজ।
ভবের উন্নতি যাতে হয়।
এই বিশ্ব সংসারকে স্বীকার করতে হবে–এ বিরাট বিপুল সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশতে হবে। জীবিত মনুষ্য সমাজের সঙ্গে যোগ রাখতে হবে। জীবিত মনুষ্যের নতুন নতুন চিন্তাধারার সঙ্গে আমরা যদি যোগ না রাখি, তা হলে আমরা দুর্বল, শক্তিহীন হবোপদে পদে লাঞ্ছিত হবো। আল্লাহর এবাদত শুধু ঘরের মধ্যে নয়–পৃথিবীর কাজের ভিতর দিয়ে তা করতে হবে। জীবিত জগৎ এবং মনুষ্য সমাজকে নিয়ে তা করতে হবে। জীবিত জাতির প্রাণের চিন্তা ও ভাবধারা সাহিত্যে ব্যক্ত হয়। সেই সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগ রাখতে হবে–যদি আমরা জীবিত জাতিসমূহের অন্তর্ভুক্ত হতে চাই। মৃতের কোনো সাধনা নাই।
কবিতা পাঠ করলে এবং সঙ্গীত শ্রবণে মন পবিত্র ভাবাপন্ন হয়, এ কারণে লোকে কবিকে সম্মান করে। অশ্লীল কবিতা–যাতে নারীর রূপ অশ্লীল ও তরলভাবে আলোচিত হয়, তা পাঠ করলে মন অপবিত্র হয়। খারাপ বই পড়লে কোনো লাভ হয় না। বিজ্ঞানের বই, উন্নত কবিতা, কাব্য, ভালো উপন্যাস, জীবনী, ইতিহাস, উন্নত চিন্তা, এসব নিত্য পাঠ করলে মানুষের প্রভূত কল্যাণ হয়–দিন দিন মানুষ উন্নত হয়। যে সমস্ত যুবকের সৎ সাহিত্যের সঙ্গে সংস্রব নেই, যারা অনুন্নত নিম্ন সমাজে সদা মেশে, কথা বলে, আলাপ করে, ভদ্রসমাজে ওঠা-বসা করে না–তাদের রুচি, চরিত্র, ব্যবহার দিন দিন জঘন্য ও কদর্য হতে থাকে। অহঙ্কার, অশিক্ষা, মন্দভাব, সংকীর্ণতা তাদের জীবন ও মনকে অজ্ঞাতসারে দুর্গন্ধময় করে, যা তারা নিজেরা বুঝতে পারে না।