একথা ঠিক মনে রেখ–নারীই যুবকের উন্নতির পথে একমাত্র বাধা। নারীর চিন্তা মাথায় ঢুকলে তার কোনো উন্নতি কখনও হবে না।
যে কাজে দিন দিন কোনো উন্নতির আশা নেই–যা জুয়াচুরি, প্রতারণা, দুর্বলের প্রতি অত্যাচারের কাজ, এসব যুবক বয়সে করবে না, শিক্ষকতা যুবকদের সাজে না, জামিদারি সেরেস্তার কাজ ঐসবও ভালো নয়। বুড়া নিষ্কর্মা লোকের পক্ষে শিক্ষকতা মানায়। সরকারি স্কুলে যেখানে উন্নতির আশা আছে, সেখানে অবশ্য চাকরি গ্রহণ করলে অনুদিত উন্নতি হতে থাকে।
শিল্প শিক্ষা করে এবং তা ব্যবসারূপে অবলম্বন করে হিন্দু ভদ্রসন্তানেরা বেশ পরিবার প্রতিপালন করেছেন। সততা ও বিনয় জিনিস দুইটি উন্নতির মস্তবড় সহায়।
.
১২. বাক্যের মূল্য–চটক দেখান পোশাকের বাহার
যদি কেউ পাণ্ডিত্যে দেশকে বিস্ময়-বিমুগ্ধ করে, সাহিত্য প্রতিভায় নোবেল পুরস্কার পায়, ধার্মিকতায় শত সহস্র মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি লাভ করে, বিজ্ঞান আলোচনায় অশেষ কৃতিত্ব লাভ করে, প্রবীণতায় আগা জারোর মতো ভক্তি ভাজন হয়, তথাপি যদি তার কথার ঠিক না থাকে, তবে সে ব্যক্তি তুচ্ছ, মূল্যহীন, অপদার্থ, তুণের মতো নগণ্য। সে কোনোমতে শ্রদ্ধার পাত্র হবার যোগ্য নয়।
বড়ই দুঃখের বিষয়–সমাজের ছেলেরা এবং প্রৌঢ়েরা ভয়ানক মিথ্যা কথা বলে, মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করে, অকারণে মিথ্যা বলে। যেন মিথ্যা কথায় কোনো দোষ নাই। যার কথার ঠিক নাই তাকে ভদ্রলোক-তো বলা চলেই না। তাকে ইতরের ইতর বলা যায়, তিনি যতই কোনো পদস্থ ব্যক্তি হউন না। ভদ্র ইউরোপীয়ানদের মধ্যে মিথ্যা কথার চলন খুব কম। কিন্তু আমাদের দেশের বিশিষ্ট লোকেরাও মিথ্যা কথা বলে এবং পত্র লেখে। কি নারী, কি পুরুষ, কি যুবক, কি যুবতী, কি বালিকা–সকলেই মিথ্যাবাদী। দায়ে পড়ে মিথ্যা বলাও সব সময় যায় না। কিন্তু বিনা কারণে, বিনা স্বার্থে যারা মিথ্যা বলে তাদের কান মলে দেওয়া উচিত। হয়তো বলবে কাল সন্ধ্যায় আসবো, কিন্তু যথাসময়ে তাকে তুমি পাবে না। লোকটা এসে তোমাকে বাড়িতেই পেলো না। একজন অধ্যাপককেও Stupid বলা যায় কারণ ঠিক সময়ে হয়তো তিনি ওজু করে নামাজ পড়বেন–কিন্তু তার কথার ঠিক নাই। বাক্যকেই মানুষ বলা যায়। কারণ বাক্যের যদি মূল্য না থাকে তবে কী করে তার উপর নির্ভর করে কাজ করা যায়।
একজন লক্ষপতি দিন-রাত্রি জপমালা হাতে করে লক্ষবার আল্লাহর বিশেষ নাম উচ্চারণ করেন, অতিশয় পীরভক্ত সেই ব্যক্তি একবার আমাকে একখানি পুস্তক লিখতে বললেন। আমি অনেক কষ্ট করে, বইখানি লিখলাম। এই লেখা শেষ হলে, একদিন বললেন–বই নেবো না। ইনি যদি সত্যবাদী হতেন তা হলে নিশ্চয়ই নিজের বাক্যের মূল্য রাখতেন।
এক Stupid রোজ প্রভাতে তার স্ত্রীকে বলতো, আজ town-এ যাব। ৮টায় ট্রেন। ৭টায়ই ভাত চাই। তার পত্নী তাড়াতাড়ি করে রোজ ৭টায় ভাত প্রস্তুত করতেন। রোজই প্রতিজ্ঞা করতেন–আজ আর যাওয়া হল না, কাল ঠিক যাবো। হয়তো জীবনভরই পত্নী এবং কত মানুষের সঙ্গে কত কাজে ইনি মিথ্যাচার করে চলেছেন, তার ইয়ত্তা কী? এই শ্রেণীর লোক জগতের কলঙ্ক এবং দাস জাতির নমুনা।
বহির্জগতের কাছে সাধু বলে পরিচিত, রোজা-নামাজের একনিষ্ঠ ভক্ত (খোদাতালা অপেক্ষা এরা রোজা-নামাজের অধিক ভক্ত) এমন লোকও মিথ্যা কথা বলতে, মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করতে লজ্জাবোধ করে না। যদি কোনো সময় কেউ তাদের ব্যবহারের সমালোচনা করে, অমনি বলবে–সংসারে অত পারা যায় না। গ্রন্থকার প্রথম জীবনে যখন সর্বপ্রথম মানুষকে সাধুতা, সততা ও সত্যনিষ্ঠার কথা বললেন–তখন পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, অতি শ্রদ্ধাভাজন প্রবীণ আপনার জনেরা পর্যন্ত বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে। সংসারের আবার সাধুতা কী? মানুষ কি অত পারে। ওসব পীর, দরবেশ, সাধু, ফকিরদের জন্যে এ তোমার ওপথ নয় বাবা! ও-পথে হাঁটলে মারা পড়বে। সত্যি করেই এই বর্বর সমাজে, এই অনুন্নত সমাজে সত্যের পথে যাত্রা করে জীবনে মরে আছি। প্রতিকূল অসংখ্য বাধাকে জয় করে সংসারে মাথা খাড়া করে রাখতে পারি নি। জীবন অসংখ্য দুঃখের ভারে নুইয়ে পড়েছে–তবুও অন্তরের সুখ এইটুকু, আপন জীবন দিয়ে সত্যের পতাকা ধরে আছি।
যুবকদের লোককে চটক দেখানোর একটা মস্ত বড় আগ্রহ জন্মে। সাইকেল, চশমা, ঘড়ি–এসব দরকারই। ভালো একটি করে কোট মাঝে মাঝে ৮/১০ টাকা খরচ করে তৈরি করা চাই। নইলে বন্ধু মহলে নাম জাগে না।
আসল কাজে মন নেই, কীভাবে দশজনের মধ্যে বড়লোক বলে বাহবা নেওয়া যায়, সেই হয় যুবকদের আগ্রহ। অসভ্যের মতো সাজ-সজ্জা করা উচিত নয়। সর্বদা চটকদার নতুন নতুন পোশাক পরে বন্ধুদের কাছে বাহবা নেওয়ার কোনো মূল্য নেই। কোনো গতিকে কাজ চললেই হল। পোশাকে মানুষের কালো রূপ সাদা হয় না, বোচা নাক সরু হয় না, কুতকুতে চক্ষুও পটলচেরা হয় না।
জীবনের প্রকৃত মূল্যের দ্বারা জগতে বড় হওয়া যায়। চটকে, দামি পোশাকে মানুষের প্রভুত্ব ও মূল্য বাড়ে না। যা দরকার, অবস্থানুসারে তা ব্যবহার করা উচিত। অবস্থায় কুলায় না, তত্রাচ চটকদার জামার কিংবা ভালো ফারনিচারের স্বপ্ন দেখা, দিন-রাত্রি মন খারাপ করা, বড়ই হীনতা–ও-তো লোক দেখান প্রবৃত্তি মনে গোপন ভাবে বিরাজ করে। অলঙ্কার ছাড়া জগতের কোনো জিনিস দেখানোর জন্যে নয়–যারা তাই ভেবে জিনিসপত্র করে, তারা যেমন জীবনে একদিকে দুঃখ পায় অন্যদিকে তেমনি হীনতার পরিচয় দেয়। জীবনের রূঢ় আবশ্যকতার জন্যে জিনিসপত্র করতে হবে।