প্রথম জীবনে যুবকেরা খুবই লম্বা কথা ছাড়ে। তার ধারণা সংসারে তার মতো বুদ্ধিমান আর কেউ নাই। জ্ঞানবৃদ্ধ পিতাকেও সে মনে মনে এবং প্রকাশ্যে মূর্খ এবং ভ্রান্ত মনে করে। যেন এ জগতে তার মতো জ্ঞানী বুদ্ধিমান আর দ্বিতীয়টি নাই। ভবিষ্যতে সে যে কি একটা মহাজন হবে, সে কথা ভেবেও সে ঠিক করতে পারে না। সংসারের সমস্ত জনই তার কাছে বোকা। সে যে কাজে হাত দেবে তাতেই সে জয়ী হবে নিশ্চয়! দুর্ভাগ্যক্রমে হতভাগ্য পিতা যে কয়দিন বেঁচে আছে, সে কয়দিন সে তার বুদ্ধি, চাতুরী কাজে লাগাতে পাচ্ছে না! পিতা বেটা কতদিনে সংসার ত্যাগ করে যাবে! রাত-দিন ফ্যাচ ফ্যাচ করতে আছে। মায়ের কাছে পিতৃনিন্দা এবং বিবাহিত হলে পত্নীর কাছে নিজের বাহাদুরি এবং রাজ্যের লোকের নিন্দা করা তার কাজ। প্রথম জীবনে ভাবে, সে কম হলেও একজন হাকিম হবে, তার পর যখন লেখাপড়া আর ভালো লাগে না তখন ভাবে লেখাপড়া শিখে কে কী করেছে! সে একজন বড় ব্যবসায়ী হয়ে লক্ষপতি হবে। সংসারে সে যে অবাধে একজন বিশিষ্ট লোক হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
তার মুখে সদাই তাচ্ছিল্য লেগে থাকে। সামান্য কারণে, সামান্য কথায় ম্যাচের কাঠির স্পর্শে দপ করে জ্বলে ওঠে। সর্বদাই রেগে আগুন হয়ে থাকে–যেন সকল মানুষই তার কাছে অপরাধী। সে ভাবে তার চিন্তা ধারা নির্ভুল, তার কাছে কোনো গলদ নাই।
কিন্তু এই ধরনের আত্মবিশ্বাস যে কত ভ্ৰম-প্রমাদপূর্ণ, তা যুবকেরা নিজেরাই কিছু দিনের মধ্যে বুঝতে পারে। তখন বুঝে আর কোনো ফল হয় না।
ক্ষুদ্র অবস্থা থেকেই বড় হতে হয়। রাতারাতি বড় মানুষ হবো, প্রথমেই চেয়ার-বেঞ্চ খাঁটিয়ে সাহেব হয়ে জীবনে নামজাদা লক্ষপতি হবার আকাঙক্ষা যদি করে থাকে, তবে শেষকালে মজুরের সৌভাগ্যও লাভ হবে না। প্রথম জীবনে, জীবন যাত্রার আরম্ভে মান অপমান জ্ঞান ত্যাগ করে মজুর সাজ। বড় ঘরের বন্ধু-বান্ধব বা স্বশ্রেণীর বন্ধু-বান্ধবদের সমালোচনাকে ভয় করো না-লোকে যদি তুই করে কথা বলে, তা হলেও দুঃখিত হয়ো না। ঐগুলি হচ্ছে তোমার উন্নতির পথে শিক্ষা। কেউ তোমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুক বা না করুক-গ্রাহ্য করো না। নীরবে, নত মাথায়, মুখ বুজে ছোট হয়ে নিজের কর্তব্য করে যাও। দিন-রাত্রি উন্নতির চিন্তা করো না, কর্তব্য করে যাও।
যদি উন্নতি করতে চাও, তবে বিবাহিত হও, অবিবাহিত হও (বিবাহিত না হওয়াই ভালো) নারীর চিন্তা বিষবৎ বর্জন করবে। নারীর চিন্তা যদি মনে ঢোকে তা হলে কোনো উন্নতির আশা করো না। নারীর কথা যতই ভাববে ততই অধঃপতনের পথে যেতে থাকবে। প্রথমে যোগ্য হও, তারপর সুখ আপনাআপনি চারদিক থেকে হেঁটে আসবে। বিশেষ করে আমাদের দেশে নারী কখনও জীবনের সহায় নয়। তারা সকল ক্ষেত্রেই জীবনের মস্তবড় বাধা। নারীর সংস্রব থেকে যত দূরে থাকবে, ততই তোমার মঙ্গল হবে। বড় বড় শহরের কোনো কোনো লোক পশুবৃত্তি শান্ত করবার জন্যে রক্ষিতা রাখে, মুসলমান হলে বাড়িতে ভদ্রঘরের পত্নী রেখে বিদেশে আর একটি নিম্নশ্রেণীর মেয়েমানুষকে বিবাহ বা নেকাহ্ করে। এর মতো ঘৃণিত কাজ আর নাই। এতে নিজের মর্যাদা নষ্ট হয়, মনুষ্যত্বের ঘোর অপলাপ হয়। কামকে যথাসম্ভব চেপে রাখ। প্রথমে যোগ্য হও, তারপর ভদ্রভাবে নারীসঙ্গ আকাঙক্ষা করবেনইলে জীবনে চিরদারিদ্র্য, অফুরন্ত দুঃখ ভোগ করতে হবেই।
যৌবনকালে একটু লেখা-পড়া শিখলেই যেমন প্রথমেই কবি হতে সাধ হয়, তেমনি প্রায় যুবকেরাই ইচ্ছা হয় একেবারে কলিকাতায় যেয়ে মস্তবড় দোকানদার হই। যদি দোকানদার হবার ইচ্ছা হয় তবে যেখানেই কর, খুব ছোট হয়েই তা আরম্ভ করতে হবে। অজানা-অচেনা স্থানে মুটে মুজুর, বিড়িওয়ালা হওয়া এবং ভালো তত্রাচ ব্যবসা আরম্ভ করতে না করতে কোট-প্যান্ট পরতে যাওয়া ঠিক নয়। ও হচ্ছে পতনের লক্ষণ বরং Show-ওসবের কোনো মূল্য নেই।
যাতে হাত দেব তাতেই সোনা ফলবে। অপরেরা উন্নতি করেছে অতএব আমিও নিশ্চয় করতে পারব। এ বিশ্বাস পোষণ করাও উচিত নয়। সুদে টাকা কর্জ করে কোনো ব্যবসা করতে যাওয়াও ঘোর বোকামি। অন করের মতো অনেক খেয়ালই আমাদের মাটি হয়ে যায়। খেয়াল, হিসাবে, অনেক সময় হঠাৎ বড় মানুষ হওয়া যায়। কিন্তু কার্যত বড়লোক হওয়া দূরের কথা, দুটি পেটের অন্ন সংগ্রহ করাই অনেক সময় কঠিন।
সুদ জিনিসটা এখন সমস্ত সভ্য জগত ছেয়ে ফেলেছে। সুতরাং অযথা গোড়ামি করে সুদ খাব না বলে বসে থাকলে চলবে না। টাকা ধার দেবার ব্যবসাও সমাজে একটা মস্তবড় শক্তি। সমাজে মহাজনের আবির্ভাব হওয়া বিশেষ দরকার। মুসলমানের সমস্ত আর্থিকশক্তি, সমস্ত অর্থ-সম্পদ হিন্দু মহাজনদের হাতে দিনে দিনে কবলিত হচ্ছে। ভিক্ষুক মোল্লাদের বক্তৃতা শুনে চুপ করে বসে থাকলে আজ আর কাজ চলাবার উপায় নেই।
বড়লোক হবো, ধনী হবো, জমিদার হবো–এই আকাঙক্ষা নিয়ে যাত্রা শুরু করা ভালো নয়। এসব হচ্ছে দুরাশা, দুরাকাঙ্ক্ষা। কোনো রকমে ভদ্রতা রক্ষা করে জীবনে বেঁচে থাকবো, তার জন্যে যা হয় একটা কিছু করছি–এরূপ চিন্তা যারা মনে পোষণ করে, তারাই জগতে টিকে থাকে। এমন কি ঘটনাক্রমে তারা বড়লোকও হয়ে পড়ে।
যারা দুরাশা পোষণ করে, তারা বড়লোক তো হয়ই না, বরং জীবনে দুবেলা স্ত্রী-লোক নিয়ে তাদের দুমুঠো অন্ন সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে ওঠে। তাদের জীবনে কোনো শান্তি থাকে না, দৌড়াদৌড়ি করে হয়রান হওয়াই তাদের কাজ হয়ে পড়ে।