গৃহ এবং বিশ্রাম বার্ধক্যের আশ্রয়। যৌবনকালে পৃথিবীর সর্বত্র ছুটে বেড়াও, রত্ন মাণিক্য আহরণ করে গৃহে সঞ্চিত কর, যাতে বৃদ্ধকালে সুখে থাকতে পার। যৌবনকালে যেমন আয় তেমনি ব্যয় করা সংসারী লোকের কাজ নয়। এ হচ্ছে নিতান্ত অপদার্থ লোকের কাজ। চিরজীবন পরিশ্রম করে যদি বৃদ্ধকালে অনাহারে মরতে হয়, তবে আর যৌবনে এত পরিশ্রম কেন করলে? বৃদ্ধকালে কি কাজ করবার ক্ষমতা থাকে? তখনকার জন্যে পূর্ব হতে সতর্ক হতে হয়–যে হয় না তার অনুতাপই হয় সার। আপন বাহু যখন শেষকালে বাধ্য থাকে না, তখন অপরের কথা, আপন সন্তানদের কথা কি বলা যায়?
মানুষের উপদেশের অন্ত নেই। কতজন যে কত রকম কথা বলে তা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। নিজেই ভেবে-চিন্তে যা ভালো বোঝ, সমস্ত শক্তিতে তাই করতে থাক। যা হয় তাই হবে, হয় জয়ী হবে না হয় ঠকবে। জায়গায় বসে কেবল চিন্তা করা, লাভ-লোকসানের কথা ভাবা মূর্খ লোকের কাজ। এরূপ লোক কোনো কাজ করতে পারে না। জীবনের সব সময়ে যে জয়ী হবে, তার কোনো মানে নাই। হারতেও হয়।
.
০৯. যুবকের ভবিষ্যৎ চিন্তা
আজিকার প্রচুরতায় শান্ত হয়ে থাকা ঠিক নয়। সংসারে ক্রমশ জনসংখ্যা বাড়ে, লোক লৌকিকতা বাড়ে সুতরাং খরচ বাড়তেই থাকে। রাজা হবো, বাদশা হবো, বড়লোক হবো–কখনও জীবন এরূপ দুরাশা পোষণ করতে নেই। এরূপ লোকের ভাগ্যে ভস্মও জোটে না। যৌবনকালে বৃথা বসে না থেকে অর্থ সঞ্চয়ের দিকে মনোনিবেশ কর। অবশ্য জমাজমি থাকলে, ক্ষেত-খামার থাকলে, সেগুলি দেখে-শুনে সংসারের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করতে চেষ্টা করাও মন্দ নয়। দিন-রাত্রি তাস পিটান, সংসারের কোনো কাজ না করা, দিন-রাত্রি ঘুমান আর বছর বছর পুত্র-কন্যার পাল বাড়ান অলক্ষ্মী লোকের কাজ। এ সুখের দিন চিরকাল থাকবে না। পূর্ব হতে সতর্ক হও।
মুসলমান ছেলেদের ভবিষ্যৎ চিন্তা মোটেই নাই। পরের ঘাড়ে চেপে বসে খেতে পারলে, যেন এরা আর নড়তে চড়তে চায় না। বয়স্ক হয়েই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র হয়ে নিজের আর্থিক উন্নতির পথ সন্ধান করবে। যে সমস্ত যুবকের সঞ্চয়ের বুদ্ধি নাই, যারা কোনো কাজকর্ম করে না বা শিখতে চেষ্টা করে না, শুধু টো টো করে ঘুরে বেড়ায়, যারা ঘোর আলস্যপরায়ণ–তাদেরকে নির্মমের মতো বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়াও মন্দ নয়। যে তাকে অন্ন দেয়, সেই তার ক্ষতি করে। এই সমস্ত যুবকদের প্রতি কোনো রকমে দয়ার্দ্র হবে না। অভাবে মানুষের মনুষ্যত্ব থাকে না–তার জীবনে দুঃখের অবধি থাকে না। অভাব ও দারিদ্র্যকে পাপ বলা যায়। এহেন অভাব দুঃখে যে সতর্ক হয় না, তাকে গৃহ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। পিতামাতাকে সুখী না করুক সে নিজে সুখী হোক। ১৩ নং শিব নারায়ণ দাস লেনে সিদ্ধিশ্বর মেশিন প্রেস এবং সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরীর মালিক একদিন বলেছিলেন–”আমি বাড়ি থেকে মাত্র এক টাকা পাঁচ আনা নিয়ে যাত্রা করি। এক্ষণে আমার ব্যবসার মূল্য এক লক্ষ টাকা। যে বাড়িতে বসে থাকে সেই মরে। বহু টাকা নিয়ে কেউ কখনও জীবনে উন্নতি করতে পারে না! আঘাত, অভিজ্ঞতা, সহিষ্ণুতা, বিনয়, সততা ব্যতীত কোনো কালে কারো উন্নতি হয় না।
যুবকদের আর একটা দোষ হচ্ছে অসহিষ্ণুতা। কোনো কাজেই ধৈর্য নাই। অতিরিক্ত বুদ্ধিমান হলেই স্বভাবে সহিষ্ণুতা থাকে না। যার স্বভাবে সহিষ্ণুতা নাই সে কোনোকালে কোনো কাজে উন্নতি করতে পারে না। লোকের সঙ্গে কলহ, ঝগড়া, কচকচি, চাকর বাকরদের প্রতি কাজে ভুল ধরা, মানুষকে সর্বদা গালি দেওয়া, সর্বদা মত বদলান, এ কাজ ছেড়ে ও কাজ করা, রাতারাতি মানুষ হবার ইচ্ছা করা, গুরুজনে অবাধ্য হওয়া, সম্মানী লোককে সম্মান না করা–এসব যুবক জীবনের মস্ত বড় দোষ।
যা হয় হবে, না হয় ভিক্ষা করে খাব, আল্লাহ মুখ দিয়েছেন, আহার দেবেন, এসব দরবেশী কথা অপদার্থ যুবকদের মুখে শোভা পায়। এ কাজ ভালো নয়, ও কাজ ভালো নয়, ওতে মান যায়, এসব কথা ভাবতে নেই। যতক্ষণ লজ্জা, মান, ভয়, আছে ততক্ষণ উন্নতির কোনো আশা নেই। আপন দেশে কাজের কোনো সুবিধা হয় না–দূরদেশে চলে যাওয়াই ঠিক।
ইতর জীবের ভবিষ্যৎ চিন্তা নেই। মানুষের সর্বদা ভবিষ্যৎ চিন্তা আছে। আজিকার যৌবনের একটি দিনের মূল্য বার্ধক্যের এক বত্সরের সমান, অতএব হেলায় যৌবনকাল নষ্ট করা উচিত নয়। উপায় করতে না শিখে বিবাহ করা যার পরনাই বোকামি, ওতে জীবনের জঞ্জাল বেড়ে ওঠে। বিবাহ যদি করেই থাক তা হলে অধিক জঞ্জাল বেড়ে ওঠবার আগে উপার্জনের জন্যে বিদেশে ছুটে পড়। অভাবে পরিবারসুদ্ধ মরবার চাইতে একজনের মরাই ভালো।
কোথায় স্কটল্যান্ড, ইংল্যাণ্ড, আয়ারল্যান্ড–সেখানকার যুবকেরা বাঙলার বুকে অর্থ উপার্জনের জন্যে চলে আসেন। ময়মনসিংহ জেলায় স্কটল্যাণ্ডবাসী দুটি যুবকের পাশাপাশি দুটি সমাধি দেখেছিলাম, যেন দুটি পুষ্প-আপন-আত্মীয়-পরিজনের সুখের জন্যে জীবনের মায়া ত্যাগ করে কোনো দূর দেশে এসে চিরদিনের জন্যে চিরদ্রিায় অভিভূত হয়ে অন্তরের জন্য শ্যামল সমাধি শয্যা গ্রহণ করেছেন। ঘরকুনো মুসলিম যুবকের এ দৃশ্য দেখে কি শেখবার নেই। কলকাতা ব্রিস্টল হোটেলের মালিক প্রথম জীবনে এক অতি দরিদ্র ব্যক্তি। ছিলেন! পরিশ্রম, সহিষ্ণুতা এবং অধ্যবসায় গুণে তিনি ক্রমে কোটিপতি হয়ে প্রাসাদতুল্য হোটেলের স্বত্বাধিকারী হতে পেরেছিলেন।