সমস্ত মুসলমান জাতির ভিতর এই ভ্রান্তি এসেছে। জীবনের কার্যে তারা ধর্ম পালন করতে চান না–জীবনকে তারা মিথ্যা অন্যায়, সর্ববিধ পাপ থেকে রক্ষা করবার কোনো চেষ্টা করেন না। কোনো অন্যায় করবার আগে তারা ভীত হন না–ভাবেন না, আমরা পাপ করছি, ঈশ্বরের আজ্ঞার অপমান করছি। দিনে দিনে মহৎ হতে মহত্তর, সুন্দর হতে সুন্দরতর হয়ে ঈশ্বরের যোগ্য হবার কোনো চেষ্টা মুসলিম জীবনে নাই। আউজুবিল্লাহ তাঁরা মুখে পাঠ করেন মাত্র। এই বাক্য অনুসারে শয়তানের প্রভাব হতে মুক্তি পাবার চেষ্টা তাঁরা বিশেষ দরকার মনে করেন না। সুর করে প্রাতঃকালে বাক্যটি পড়লেই তাদের বিশ্বাস বহু পুণ্য সঞ্চিত হল। হায় কী ভ্রান্তি।
এই হাজি সাহেব। তিনি হজ করে ফিরে এলেন। সম্পত্তির যে-সব শরীক ছিল, তারা তাকে বয়োজ্যেষ্ঠ জ্ঞানে সম্পত্তি পরিচালনার ভার তার হস্তে সমর্পণ করলেন। তিনি গোপনে তহশীলদারের সঙ্গে যোগ করে, সম্পত্তির খাজনা আত্মসাৎ করতে লাগলেন, ফলে সম্পত্তির খাজনা বাকি পড়ায় সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল। হাজি সাহেবের কত সম্মান ছিল, তিনি অন্ধকারে থাকতে উঠে সুর করে প্রাতঃকালীন নামাজ পড়তেন এবং অনেক বেলা পর্যন্ত কোরান পাঠ করতেন। রোজার মাসে রোজা করতেন। তার এই রোজা, নামাজ ও কোরান পাঠ দ্বারা কি ধর্মের পুণ্য তিনি সঞ্চয় করেছিলেন? তাঁর মনে হয়তো একটা গোপন বিশ্বাস ছিল, আমি যতই অন্যায় করি, এই রোজা, নামাজ এবং কোরআন পাঠে সব কেটে যাবে। তা কি কাটে! মানুষ অনবরত দিনের মধ্যে পাঁচবার ঈশ্বরবাক্য পাঠ করলে–পাপ করতে, অধর্ম করতে তারা ভীত হবে, তারা মানুষ হবে, জীবনে ধার্মিক হবে, এই জন্যেই রোজা নামাজের এত কঠোর ব্যবস্থা। কার্যের দ্বারা ধার্মিক হবে। নামাজ পড়ে মানুষ ধার্মিক হবে না। তসবীহ্ পাঠ, রোজা-নামাজ করা দেখে মানুষকে ধার্মিক বলা যায় না।
জীবনের কার্যে সাধু হতে হবে। প্রতি দিনকার পাপ কার্যে যদি মানুষ ধর্মে পতিত না হয় তবে বেশ্যাখোরের রোজা-নামাজ সিদ্ধ হবে না কেন? পাপ ও মিথ্যা জীবনের সঙ্গে রোজা-নামাজ সিদ্ধ হয় না। জীবনকে সুন্দর ও সংস্কৃত করতে আপ্রাণ চেষ্টা কর এবং সেই। সঙ্গে বুঝে প্রার্থনা কর। সত্য জীবনের প্রার্থনা গ্রাহ্য হয় এবং প্রভু তার উত্তর দেন। চোর, বাটপাড়, কুর, কুক্ৰিয়াসক্ত ও ঘুষখোর এবং লজ্জা ও অনুশোচনাশূন্য সৃষ্টির আবার নামাজ রোজা কী? একবার নামাজ ত্যাগ করলে পাপ হয় না,–একটা মিথ্যা বললেই, অন্যায় কাজ করলেই পাপ। এর বিপরীত বিশ্বাস মুসলমানেরা পোষণ করেন।
.
০৮. পাপ, মিথ্যা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
পাপ, মিথ্যা, অন্যায়, অত্যাচার–এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চাই, এই-ই ধর্ম।
পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর। ঈশ্বরের সৈনিক হও।–ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার কর।
হে ঈশ্বরের সন্তানেরা! তোমরা থাকতে ঈশ্বরের এই অপমান? দেখতে পাচ্ছ না, কেমনভাবে চারদিকে পাপের আগুন জ্বলে উঠেছে। মানবাত্মা কীভাবে অহঙ্কার চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে? অত্যাচারে ব্যথিত নর-নারী কীভাবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছে?
কাতর ব্যথিতের ধ্বনি উঠেছে, সৈনিকেরা কি বসেই থাকবে?–প্রকাশ্যে এবং গোপনে আপন আত্মার বিচার সৎ, সুন্দর এবং নিষ্পাপ থাক–মানুষের মনে কোনো দুঃখ দিও না। তোমাদের জীবনের দ্বারা পৃথিবীর দুঃখ সৃষ্টি না হোক। এসব কথা কি আজ পর্যন্ত তোমরা শোন নি? তা হলে এখন শোন এবং গ্রাহ্য কর। এতদিন শুনেছ শুধু রোজা নামাজের কথা। এত দিন শুনেছ রোজা-নামাজই ধর্ম জীবনের কর্তব্যে শেষ হবে। না, তা হবে না–কখনও হবে না।
ঈশ্বরকে প্রচার কর, অথবা যারা করেন, অর্থ দিয়ে তাদের সাহায্য কর। ঈশ্বরের বাক্য সর্বত্র বহাল রাখ। যারা পাপী ও পাপিনী,যারা পতিত ও পতিতা, তাদের রক্ষা কর–ইহাই তোমার ধর্ম। শুধু ভেড়ার মত পেট ভরে খেয়ে এশার (রাত্রির) নামাজ পড়ে শুয়ে থেকো না।
ঘুষ খেয়ো না-প্রবঞ্চনা করো না, মানুষকে গালি দিও না–মনুষ্য সম্বন্ধে মিথ্যা কথা বলো না। তাতে তোমার ধর্ম থাকবে না। তোমরা কি ঈশ্বরকে ভয় করতে চাও না? এই ক্ষুদ্র জীবনে অনন্তকালের সুখ ভোগ করে নিতে চাও? তোমরা তো আমার চাইতে ঈশ্বরকে অধিক বিশ্বাস কর–তবে কেন তাকে ভয় কর না।
জীবনে অন্যায় করো না। মনুষ্য নামের অপমান করো না। এই সামান্য কয়দিনের জন্য এত অত্যাচার করতে, এত অধর্ম করতে কীভাবে সাহস কর? পোশাক পরলে, টুপি মাথায় দিলে কি ধর্ম রক্ষা হয়? আত্মায় ধার্মিক হও।
মানুষের ক্ষুধা ও দৈন্যের মীমাংসা কর। তাকে আলো দাও, জ্ঞান দাও, বুদ্ধি দাও। তাকে পশুর স্তর থেকে দেবতার স্তরে টেনে আন। ধর্মহীনদের সমস্ত অন্তর দিয়ে ঘৃণা কর। কারণ তারা ঈশ্বরের শত্রু–তথা মানুষের শত্রু। দিকে দিকে বেদনার ধ্বনিকে দুপুর রাতে রোজ কাঁদে? হে যুবকদের দল, তোমরা তার কাছে যাও এবং জিজ্ঞাসা কর কী তার বেদনা। তার পুত্র নাকি পীড়িত! চিকিৎসার খরচ নেই, পথ্যের পয়সা নেই, প্রদীপে তেল নেই। তোমরা সবাই দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে তার ঝুলি ভরে দাও, এইভাবে তার আশীর্বাদ গ্রহণ কর এবং ধর্ম অর্জন কর। . সে কি স্বামীহীন দুঃখী, অন্নহীনা? তোমরা সবাই মিলে তার দুঃখ দূর কর কর। এইভাবে তোমরা জীবন সার্থক কর। কোনো অত্যাচারী কি তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিচ্ছে? তোমরা সবাই অত্যাচারীর বিষদন্ত ভেঙ্গে দাও এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ কর। গান শোন কিন্তু আর সুর কেমন করে তোমাদের আত্মার কাছে বেদনার ফরিয়াদ তোলে, তা কি শোন না? জেনে শুনে যে অন্যায় করে, অপরকে অন্যায় করে বঞ্চিত করে, নিজের কোলের দিকে বড় মাছখানা টেনে আনে–সেই নরপিশাচকে শূকর বলা যায়। তার মুখ দেখতে কত কুৎসিত? কুকুরের মতোই তার মুখ। ঠিক সে-ই নরপিশাচ যার ন্যায় বিচার নেই, যে কুকুরের ন্যায় নিজেই সব গ্রাস করতে চায়।