লোকে বলে কে ধার্মিক, কে অধার্মিক, কে মনোনীত, কে অমনোনীত তা কেউ জানে না। কথাটি অনেকাংশে ঠিক। জীবনের কাজ দেখে সব সময় বুঝতে পারা যায় না। লোকটি নিরপরাধ কিংবা ঈশ্বরের কাছে অপরাধী–প্রভুই জানেন, কে সাধু এবং কে অসাধু।
মানব জাতির একটি সাধারণ ধর্ম আছে। ধর্মের উদার ক্ষেত্রে সকল মানুষই সমান। তান্ত্রিক সন্ন্যাসী গোপনে যদি ব্যভিচার করে, মরণের পূর্বে একটিবারও কি সে আত্মপাপ অনুভব করে না? যদিও সে জীবনে মানুষের অফুরন্ত ভক্তি লাভ করেছে। সবাই অন্তরে জানে সে নিজে ভালো কী মন্দ–যদিও মানুষ মুখে বড়াই করতে ত্রুটি করে না। মুসলমান, হিন্দু, জৈন, খ্রিষ্টান, পারসীক, বৌদ্ধ সকল জাতির মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে আপন আপন চিত্তে একটা পরিষ্কার ধারণা আছে। জীবনকে বেদনা দেওয়া, নারীকে দুঃখ দেওয়া, পরের ধন অপহরণ করা, মিথ্যা বলা, ছলনা করা, ব্যভিচারের পাপে লিপ্ত হওয়াকে কোন্ ধর্মে ভাল কাজ বলে জানে? অথচ সকল ধর্মের অধিকাংশ লোক এই সমস্ত পাপ কাজ করে। জীবনে ভালবাসা, পরোপকার, মানব-দুঃখ, সহানুভূতি, সতীত্ব, ক্ষমাশীল, দরদ, বিনয়-কে না শ্রদ্ধার চোখে দেখে! মানব ধর্মের কোনো ধার ধারে না–মারামারি করে ধর্মের নাম নিয়ে। পাষণ্ড যারা তার ধর্মের নামেই বড়াই করে বেশি। যদিও তাদের জীবনে ঈশ্বরের কোনো আসন নাই।
‘জীব মাত্রেই শিব’ এ কথা হিন্দুরা মানে? মুসলমান শাস্ত্রে নামাজের প্রতি জনসাধারণকে এত কঠিনভাবে ভক্তিমান হতে আদেশ করা হয়েছে, নামাজ পালন করতে এতবার অনুজ্ঞা করা হয়েছে নামাজ ত্যাগ করলে এত ভয়ানক শাস্তির ভয় দেখান হয়েছে মুসলমান জাতি সব ভুলে নামাজই সর্বাগ্রে পালন করতে অগ্রসর হয়,–নামাজ ছাড়া আর কোনো কর্তব্যের কথা তাদের মনে আগে আসে না। নামাজ পড়া তাদের জীবনের বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোনো দায়িত্ব তারা ভালো করে অনুভব করে না। বুঝে হোক, না বুঝে হোক নামাজ পড়তে হবে। যে সব ঈশ্বর বাক্য তারা পাঠ করে সেই বাক্যের মর্ম গ্রহণ–তদানুসারে জীবন গঠন করা বিশেষ আবশ্যক বোধ করে না। কোনো রকমে আবৃত্তি করে নামাজ পড়তে পারলেই তারা মনে করে ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ আজ্ঞা পালন করা হল, তারা ইসলাম ধর্ম পালন করলো। নামাজের জন্যে এই অতিরিক্ত ভীতি প্রদর্শন মুসলমান সমাজের ধর্ম জীবনের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। তার আধ্যাত্মিক জীবন চূর্ণ হয়ে গেছে। নামাজকে ছেড়ে ধর্ম সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে কিছু ভাবতে তারা মোটেই সাহস পায় না। নামাজ-রোজা হয়ে পড়েছে তার কাছে দুই সশরীরী দেবতা। সে এইভাবে প্রাণে মূর্তিহীন প্রতিমা পূজা শুরু করেছে। সে ঈশ্বরকে চেনে না শুধু নামাজ পড়ে। তার বিশ্বাস, নামাজ ত্যাগই সকল পাপের। বড় পাপ। কিন্তু তা তো নয়। অকৃতজ্ঞতা, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্রুরতা, মিথ্যা, কথন, দয়াশূন্যতা, ছলনা, প্রতারণাই বড় পাপ কিন্তু সে তা বিশ্বাস করে না, এই অবিশ্বাসই তার পতনের কারণ। এই জন্যেই তার জীবন মানুষের কাছে এত দুঃসহ। নামাজ অর্থাৎ প্রার্থনা দুই-এক বার ত্যাগ করলে তেমন ক্ষতি হয় না। আসল ধর্ম ঠিক রাখা চাই।
.
০৭. ধর্ম কী চোখে দেখলাম
একদিন আষাঢ়ে বৃষ্টি এবং শীতল বাতাসের মাঝে একটি দরিদ্র শিশুকে খালি গায়ে খালি পায়ে একেবারে উলঙ্গ অবস্থায় আমার পার্শ্ব দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। সেই দিন ধর্ম কী তা চোখে দেখলাম।
মনুষ্য শিশুকে মানুষ করে ভোলা ইহাই ধর্ম। তাকে বস্ত্র দাও, তার জন্যে স্কুল তৈরি করে দাও–এ জন্য তোমরা অর্থ দান কর। মনুষ্য শিশুর সেবা কর। নামাজ পড়লে কি স্বর্গে যাওয়া যায়? নামাজ পড়ার মধ্যে ধর্ম নাই। যুদ্ধের পূর্বে কি বাদ্য এবং যুদ্ধসঙ্গীত গায় না? তাতে সৈন্যদের বুকে উৎসাহ আসে। গান আর বাদ্যই যুদ্ধ নয়। গানে যুদ্ধ জয় হয়। ধর্ম জীবনের সঙ্গীত, নামাজে ধর্ম পালন হয় না। ওর দ্বারা আত্মার মহত্ত্ব ধর্ম সাধনের জন্য তৈরি হয় মাত্র। ধর্ম পড়ে আছে জীবনের ক্ষেত্রে, জগতের মাঝে-ধর্ম সেখানে, যেখানে শত কাজে মিথ্যাকে দমন করে, পরোপকারে মানব কল্যাণে, বিশ্বের সেবায়, লোভকে জয় করে। নিজেকে জয় করে পালন করতে হবে–কাজ করে ধর্মের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। শুধু মুখে ঈশ্বর বাক্যের আবৃত্তি করলে কোনো লাভ হবে না। ঈশ্বর মনুষ্যজাতিকে কী কথা বলেছেন :
প্রাচীন কালে ঈশ্বর তাঁহার বন্ধু ইব্রাহীম নবীকে মনুষ্য জাতির জন্য দশটি আজ্ঞা দিয়েছিলেন :
১. মনুষ্য হত্যা করো না।
২. মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না–অর্থাৎ মিথ্যা ঘটনা সত্য বলিয়া সমর্থন করিও না। অন্যায়ের পক্ষে কথা বলিও না।
৩. প্রতিবেশীকে প্রেম করিও। প্রতিবেশীর সহিত অসদ্ভাব করিয়া অপরের সহিত মিত্রতা করিও না।
৪. মিথ্যা কহিও না।
৫. কাহারও অনিষ্ট করিও না।
৬. ব্যাভিচার করিও না।
৭. পরের কুৎসা রটনা করিও না।
৮. পিতামাতাকে মান্য করিও।
৯. পরের দ্রব্যে লোভ করিও না।
১০. চুরি করিও না।
তোমরা কি মনে কর ঈশ্বরের এই আদেশগুলি বসে বসে শুধু পাঠ করলেই হবে, না আদেশ অনুসারে কাজ করতে হবে? কোরানে ঈশ্বর বাক্যগুলি শুধু পাঠ করবার জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, না ঈশ্বরের আদেশের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে হবে? তবে কেমন করে বল নামাজেই সব–নামাজের দ্বারাই ধর্ম পালন হল। এমন পাগল ভ্রান্ত জাতি তো কোনো কালে দেখি নি। মুসলমান জাতি এত ভ্রান্ত কীভাবে হলেন? এমন কী শিক্ষিত লোককেও জীবনে সত্য সুন্দর হবার সাধনা করতে তাদের লজ্জা হয় না। কোনো মহৎ হিতানুষ্ঠানে তারা সেরূপ। উৎসাহ দেখান না। সত্যকে মিথ্যা করেন, মিথ্যাকে সত্য করেন–কী ব্যাপার?