আজগুবী গল্প রচনা করার ঝোঁক মুসলমান লোকদের মাঝে কেন বেড়েছিল তা বুঝা যায় না। খ্রিষ্টান সমাজে পাদ্রীরা কোনো কোনো সাধুর জীবন সম্বন্ধে সাধারণে ভক্তি বাড়াবার জন্য মিথ্যা গল্প যোজনা করতে উৎসাহ দিতেন–এমন শোনা যায়। মুসলমান। সমাজে লেখকদের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল বলে মনে হয় না, অথচ তারা অসম্ভব মিথ্যা কথা মুসলমান সাধুর জীবনে যোজনা করে ইসলাম ধর্মের গৌরব খর্ব করেছেন। হযরতের জন্মবৃত্তান্ত যে-সব পুস্তকে লেখা হয়েছে তাতে মুসলিম তাপসদের জীরনী পুস্তকে এই শ্রেণীর মিথ্যা অলীক গল্পে অবতারণা দেখা যায়। হযরত মরা মানুষকে জীবন দিয়েছেন, ইতিহাসে তার কোনো প্রমাণ নেই–আমরা এরূপ কথা বিশ্বাস করি না। তার শিষ্যেরা। মৃতকে জীবিত করেছেন, লোহাকে সোনা করেছেন, তাল গাছে কাঁঠাল তৈরি করেছেন–পাথরে চড়ে নদী পার হয়েছেন, স্রোতের উপর বসে নামাজ পড়েছেন,–এরূপ অসংখ্য মিথ্যা গল্প দেখতে পাওয়া যায়। মাটি, বৃক্ষ, শুকনা গাছের ডাল প্রথম কলেমা (বিশ্বাস মন্ত্র) পাঠ করে ইসলাম ধর্মের সত্যতার প্রমাণ দিয়েছে–এমন গল্প শোনা যায়। এই সমস্ত মূর্খ। মোল্লা-মৌলবী টিকিমার্কা টুপি নেড়ে ভক্তির ভান করে, মিথ্যা কাঁদার ভান করে সভার মাঝে বলে থাকেন। প্রবীণ ব্যক্তিরা এই সমস্ত কথা বলে নিরক্ষর মুসলমানদের ভক্তি ও বিশ্বাস বাড়াতে চেষ্টা করেন। বস্তুত এইসব গল্প শুনে বিশ্বাসের ভান করতে বাধ্য হয় মাত্র। বিশ্বাস ও ভক্তি এ দুটি স্বর্গীয় জিনিস–মানবাত্মার স্বাভাবিক ঘটনা। বল প্রয়োগে, ভয় দেখিয়ে হঠাৎ এ জিনিস তৈরি হয় না। আত্মা ক্রমানুগতিতে বিশ্বাসী হয় এবং ভক্তিরসে আপুত হয়। এ কি চপেটাঘাত করে মুহূর্তের মাঝে সৃষ্টি করা যায়? একটা আজগুবী কাণ্ড করা আর আত্মাকে চপেটাঘাত করা এক কথা।
কখনো কখনো আশ্চর্য, অস্বাভাবিক ঘটনা বিশ্বাস করবে না। ধর্ম জীবনের সঙ্গে এ সকলের কোনো সম্বন্ধ নেই। ঈশ্বরের কোনো কাজ অস্বাভাবিক এবং অকস্মাৎ হয় না। সৃষ্টির বহু পূর্বে তার প্রকাশের আয়োজন চলতে থাকে। কখনো আম গাছে কাঁঠাল হয় না–এ মিথ্যা কথা। এমন কাজ কোনো সাধুর দ্বারা হয়েছে, এ কথা বললেও পাপ হয়। মেসমরিজম বলে এক রকম বিদ্যা আছে, তাতে মানুষ অন্যের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে অনেক ভুল জিনিস দেখে, কিন্তু এর সঙ্গে তো মানুষের ধর্ম জীবনের কোনো সম্বন্ধ নাই।
এমন একটা সময় এসেছে যে পুরাতন শ্রেণীর ভ্রান্ত মোল্লা-মৌলবীকে ধর্মমন্দিরে আর প্রবেশ করতে দেওয়া উচিত নয়। নব-আলোকপ্রাপ্ত, সংস্কৃতিতে অভ্রান্ত বিশ্বাস যারা পোষণ করেন, তাদের প্রার্থনায় অগ্রগামী করা উচিত। তারা বাড়িতে বাড়িতে হযরতের জীবনী পাঠের উৎসব–ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা পাঠ করে হযরতের বাণীর ব্যাখ্যার বর্ণনা দিয়ে। জনসাধারণকে ধর্ম জীবনে অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করবেন।
মুসলিম জগতে হযরতের জীবনী পাঠ মুসলিম গার্হস্থ্য জীবনের একটা মস্ত বড় উৎসব। মোল্লাদের দৌরাত্মে একেবারে মাটি হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠজ্ঞানী মহৎ ব্যক্তিদের অগ্রণী হওয়া উচিত। বাংলাদেশে কিন্তু যারা অশিক্ষিত, অপদার্থ ভিক্ষুক তারাই মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনে কর্মকর্তা হয়ে ওঠে। পরবর্তী মুসলমান সাধুদের জীবনের সঙ্গে অল্প শিক্ষিত মিথ্যাবাদী ভক্তদের দ্বারা এমন সমস্ত অসম্ভব গল্প রচিত হয়েছে, যে সব গল্পে ঘটনা হযরত রসুলের করিমের জীবনে সম্ভব হয় নাই। কেরামতিতে গুরুর চাইতে শিষ্যরা দুই-চার সিঁড়ি উপরে উঠেছেন। গল্প। রচয়িতাদের এমনই কলমে জোর আর ছাপাখানার প্রাদুর্ভাব ফল!
০৬-১০. ধর্মের জীবিত উৎস
০৬. ধর্মের জীবিত উৎস
মানব হৃদয়ে স্বাভাবিক ধর্মের উৎস আছে। কোনো বাঁধাধরা পথ তার জন্য নির্দেশ করা। চলে না।–কালধর্মে নিত্য নব নব সমস্যা তার জীবন সম্মুখে উপস্থিত হয়। তখন সে কোনো গ্রন্থের বাণীর অপেক্ষা করে না। আপনার জীবিত আত্মার আসনে জীবিত ঈশ্বরের বাক্য সে শুনে এবং কাজ করে। হৃদয় আসনে জীবিত ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা, সত্যের আত্মা, প্রজ্ঞার বাণী মেনে চলাই তার ধর্ম। যে আত্মায় ঈশ্বর বাক্য অনুভব করে না–কোনো ধর্মগ্রন্থ তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ জন্য প্রত্যেক ধার্মিক মানুষকে পবিত্র আত্মায় বিশ্বাসী হতে হবে।
পবিত্র সত্যের আত্মা মানুষের প্রতি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ দান। আল্লাহ্ স্বয়ং মুমীনের আত্মায় আসন গ্রহণ করেন। আত্মায় আল্লাহর সত্তা অনুভব এবং তার বাণী শ্রবণ করা। ভাববাদী পয়গম্বরের কার্য। যে মানুষ অপবিত্র চিত্ত, মিথ্যাবাদী, সে কখনও প্রাণে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করে না। নিষ্কলঙ্ক, সত্যবান, বিনয়ী, প্রেমিক, দরদী, ক্ষমাশীল, আত্মশ্লাঘাবর্জিত, বৈধ অন্নভোজী মহব্যক্তি যাঁরা, তাঁরাই হৃদয়ে ঈশ্বরবাক্য শ্রবণ করেন এবং সেই বাক্যমত কাজ করেন।
প্রার্থনা ব্যতীত কখনও মনুষ্যচিত্তে ঈশ্বরের আসন অধিষ্ঠিত হয় না–দুরাত্মা লোকদের সঙ্গে ঈশ্বর কথা বলেন না।
হৃদয়ে ঈশ্বরের সত্তা অনুভব করা এবং জীবনে তার উপদেশ মতো কাজ করাই তোমার ধর্ম। প্রচলিত ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে তোমার কাজের কথা তত ভাববে না। নিজের কাজে নিজে মিথ্যা হবে না, তা হলেই যথেষ্ট হল।