হযরত মুহম্মদ (সঃ) মুসলমানকে ত্রাণ করেন, এই একটি অন্ধবিশ্বাস কিছুদিন থেকে ইসলাম ধর্মে চলেছে। অথচ মানুষ মানুষকে ত্রাণ করবে না–এই কথা প্রচার করাই তার খ্রিষ্টানধর্ম হতে পৃথক হবার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবি। হযরতের নামে দরূদ পড়ার তার অন্ত নেই অথচ হযরতের বাণী একজনও জীবনে অনুসরণ করে না। মুসলিম জীবনে কাজ নেই, মোটেই কাজ নেই। শুধু আছে মুখস্থ পাঠ এবং আল্লাহ দয়ালু এই কথা বলে মাফ চাওয়া। তাকে পথ দেখাইবার জন্যে কোরান–অথচ চোখ বেঁধে সে কোরান পড়ে। চোখ বুজে কে কার গন্তব্য স্থানে পৌঁছতে পারে। আল্লাহ্, তাকে কি বলেছেন, জীবন ভরেও সে তা শুনতে ও জানতে চায় না। তার আত্মার জন্য যা চরম কল্যাণের মন্ত্র, তা সে বুঝতে চায় না। যদিও সে জীবনে কত কঠিন পরিশ্রম সাপেক্ষ কাজ করে ফেলে। প্রার্থনাশীল জীবনের কোনো ভাব মুসলমান সমাজে নাই। আত্মার নিবেদনের নাম প্রার্থনা। অপ্রাসঙ্গিক ঈশ্বর বাক্য পড়লে কি প্রাণ ঘামে? দুই হাজার বার কুলহু’ পড়লে, দুই হাজার বার সূরা এখলাস পড়লে মহাপুণ্য হয় এইরূপ কথা আধ্যাত্মিকেরা অনেক সময় শিষ্যদিগকে বলে থাকেন। যে প্রার্থনা পাষাণ ভার হয়ে মনুষ্য চিত্তকে কষ্ট দেয়, তা প্রার্থনা নয়। প্রার্থনায় কখনও ক্লান্তি হবার কথা নাই। অথচ প্রায়ই দেখা যায়, ধর্ম মন্দিরে তাড়াতাড়ি প্রার্থনাটি সেরে দেবার জন্য অনেকে মোল্লা-মৌলভীকে অনুরোধ করেন। যে জিনিসের সঙ্গে প্রাণের যোগ নেই তাতে তো কষ্ট হবেই। না বুঝে দীর্ঘ সময় প্রার্থনার নামে ব্যায়াম করতে, উপস্থিত উপাসক জনমণ্ডলীর যে কি কষ্ট হয়, তার তাদের প্রাণ তাড়াতাড়ি ছুটি পাবার জন্য কীভাবে কাতর হয়ে উঠে, তা ভুক্তভোগীরা মাত্রই জানেন।
সামাজিক লোক-দেখান নামাজে কখনও প্রার্থনা হয় না। পৃথিবীতে মানব-সমাজে আল্লাহর সত্তা জীবন্ত করে রাখবার জন্যেই এই প্রকাশ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। প্রার্থনা যা, তা একান্ত আন্তরিক হবে তা হবে আত্মার স্বতঃউৎসারিত ভাব। দীর্ঘ পঞ্চাশ, ত্রিশ, বিশ, ও চৌদ্দবার উঠা-বসা না করে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু ফরয নামাজটুকু (ঈশ্বর নির্দেশিত অবশ্য পালনীয় সংক্ষিপ্ত উপাসনা) পালন করে সামাজিক প্রার্থনায় মর্যাদা রাখলেই যথেষ্ট হয়। উঠা-বসা করলে কখনও আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের ঘনিষ্ঠ যোগ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। সামাজিক নামাজ শেষ করে–আপন মাতৃভাষায়–সকলে মিলে বা একাকী নীরবে আত্মার ও সত্যের প্রার্থনা করাই যুক্তিযুক্ত। প্রার্থনায় কখনও বল-বাধ্যতা ভালো নয়। যখন ইচ্ছা নাই তখন প্রার্থনা করা উচিত নয়। পৃথিবীতে এখন কর্মের যুগ এসেছে। এখন বাইরে কর্মক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আল্লাহর এবাদত করতে হবে। ঘরের মধ্যে বহুক্ষণ বসে সময় নষ্ট করবার সময় নেই। যখনই ইচ্ছা তখনই মানুষ প্রার্থনা করতে পারে। এখন নতুন কালের নতুন নিয়মে চলতে হবে। তাতে ইসলাম ধর্মের ক্ষতি হবে না।
আল্লাহ্ নিরাকার, এক তিনি কারো জনক নন, তারও কেউ জনক নাই–তিনি। আকবর–অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ–ইহাই ইসলামের প্রাণবাণী-এ কথার তো পরিবর্তন হচ্ছে না। কাল ও অবস্থাভেদে অন্যান্য বিষয়ের পরিবর্তন আবশ্যক। প্রার্থনায় কখনও সঙ্গীত নিষিদ্ধ হওয়া ঠিক নয়। নামাজে দাঁড়িয়ে কী সুন্দর সুরকে উপেক্ষা করা হয়! কণ্ঠে লালিত্য সকল দেশে সকল মানুষকে ঐশ্বরিকভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমরা যদি সঙ্গীতকে অসিদ্ধ ও অবৈধ বলে বর্জন করি, তা হলে আমাদেরই আধ্যাত্মিক জীবন পঙ্গু হয়ে উঠবে। সামাজিক প্রার্থনায় কোরানের বাক্য ব্যবহার করা যায়। কারণ, সমস্ত মুসলমান জগতের মিলনক্ষেত্র। হচ্ছে এই সামাজিক প্রার্থনা অর্থাৎ নামাজ। সামাজিক প্রার্থনাকে কখনও প্রকৃত প্রার্থনা বলা চলে না। ও যেন একটা কর্মশালার ভঙ্গি বজায় রাখা। অপ্রাসঙ্গিক কথায় কখনও প্রাণ ধর্মরসে বিগলিত হয় না। প্রার্থনা জিনিসটা কখনও সকলের এক প্রকার হতে পারে না। কখনো কখনো সমবেতভাবে এবং কখনো কখনো স্বতন্ত্রভাবে দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের স্বতন্ত্র ভাবে প্রার্থনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
প্রার্থনায় সঙ্গীত ও সুরযন্ত্র ব্যবহারের অর্থ অশ্লীলতা ও উচ্ছলতা নয় বা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নয়। নামাজিরা বলে–বেনামাজির হাতে খেতে নাই। এ কথাটি খুব সত্য। বাস্তবিক যার জীবন প্রার্থনাশীল নয়, যার কর্মবহুল জীবনে আল্লাহর প্রতি প্রেমের অভিব্যক্তি নাই,–যে জীবনে, কাজে-অন্তরে আল্লাহকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রমাণ করে না, জাগতিক সম্মান ও প্রতাপই যার জীবনের পরম আকাঙ্ক্ষিত বস্তু, সে জীবন নিশ্চয়ই অপবিত্র, তার স্পর্শিত খাদ্য খাওয়া মুসলমানদের উচিত নয়। জীবনই তার বৃথা–যে ঈশ্বরের বশ্যতা স্বীকার করে না–জীবনে নিত্য ঈশ্বরের অর্থহীন আশীর্বাদ লাভ করে একবারও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না।
প্রার্থনাশীল জীবনের শ্রেষ্ঠতম ভাব–ঈশ্বরে পূর্ণ আত্মসমর্পণ, বিনয় এবং সকলের উপর দরদবোধ।
দরদ চিরসহিষ্ণু, ক্ষমাশীল, ক্রোধবর্জিত। অভিশাপ করে না, গর্ব জানে না, বড়াই করে না, মিথ্যা কহে না, নিন্দা করে না, বঞ্চিত করে না, প্রতারণা করে না, দুঃখ দেয় না।
.
০৫. আজগুবী গল্প
মুসলমান সমাজে আজগুবী গল্পের প্রভাব অতিরিক্ত বেশি। বুজরুকী, মিথ্যা কেরামতিতে বিশ্বাস–মূর্খ মুসলমান সমাজকে পতনের গভীর গুহায় নিয়েছে। আত্মা দলের পর দল মেলে স্বাভাবিকভাবে ঈশ্বরের পরিচয়ে সুরভিত, বিকশিত হয়ে উঠবে–এইটিই হচ্ছে। স্বাভাবিক ও নিয়মসঙ্গত। তা তো নয়–হঠাৎ একটা কেরামতি দেখে ইসলাম ধর্মে আসক্ত হবার অর্থ ভয় পেয়ে মুসলমান হওয়া–গুণমুগ্ধ হয়ে নয়।