মৌলানা রুমীর কবিতায় দুই ছত্রের অনুবাদ লিখেছেন–তোমার মধ্যে দেবত্ব ও পশুত্ব দুই-ই আছে, যদি পশুত্বটুকু দূর করতে পার, তুমি দেবতাদেরকে (ফেরেস্তা অর্থাৎ আল্লাহর অর্চনারত ফেরেস্তা) অতিক্রম করে যেতে পার।
ধর্ম সম্বন্ধে নিজের মতামত লিখেছেন শয়তানের উপর জয়যুক্ত হওয়াই মনুষ্যত্বের সার ধর্ম। এই-ই বিশ্ব মানব ধর্মের মূলমন্ত্র। …কেবল আনুষ্ঠানিক প্রার্থনা ও উপবাসই ধর্ম নহে।
সৈয়দ আবদুর রব ‘মাসিক মোয়াজ্জিন’ পত্রিকায় ৭ম বর্ষ ১৩৪১, বৈশাখ সংখ্যায় ৮ম পৃষ্ঠায় লিখেছেন;
“আত্মায় সত্যের আসন প্রতিষ্ঠা করাই ধর্ম। সত্যের যে প্রাণবন্ত ঝঙ্কার সজ্ঞান মানুষ আপন আত্মায় অনুভব করিবে তাহাই তাহার ধর্ম।”
এই দুটি বস্তু এবং যারা ধর্মের প্রকৃত পরিচয় আত্মীয় অনুভব করতে পেরেছেন, তাদের কালবিলম্ব না করে একসঙ্গে মিলিত হওয়া উচিত। বিদ্রোহ ব্যতীত কোনো সত্যের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যে সত্যের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে, মিথ্যাকে দলিত করে।
ইসলামের পরম দান ঈশ্বরের একত্ব। পূর্বে মনুষ্য সমাজে ঈশ্বরকে বহু ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ঈশ্বরের শক্তি ও ভাব যার মাঝে বহুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে, মনুষ্য ভক্তি আপুত প্রাণে তাকে ঈশ্বরের আসন দিয়ে এসেছে। এই মনুষ্য-ঈশ্বরের ভক্ত যারা, আত্মার যাঁরা, তাঁরাও ক্রমে ঈশ্বর হয়েছেন। যিশু খৃষ্টের মাতাকে মনুষ্য জ্ঞানে তার ভক্তগণ বর্জন করতে পারেন নি। ঈশ্বরের মাতা যিনি, তাকে কীভাবে বাদ দেওয়া যায়?” খৃষ্ট বলেন; আমাকে পরিধান কর। যারা তাকে পরিধান করলেন তারাও খৃষ্ট অর্থাৎ ঈশ্বর হলেন। ধার্মিক রাম, বুদ্ধ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, ঈশ্বরের বিরাট শক্তির প্রতিচ্ছবি।–সমুদ্র, বিশাল বৃক্ষ, হিমালয়, পর্বত, বিষধর সর্প ভক্তের শ্রদ্ধা হতে বঞ্চিত হলেন না। এরা হলেন ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি। আর্য সমাজীরা বললেন Let us try to make every man a god। এসব ফকিরি কথার মূল্য ফকিরদের কাছে আছে–সাধারণ মানুষের কাছে এইসব কথার গুরুতর অপব্যবহার হয়। কোথায় ঈশ্বর রইলেন পড়ে–বুদ্ধের পাষাণ মূর্তি ঈশ্বর হয়ে হাট, ঘাট, পর্বত, মন্দির ছেয়ে ফেলো। মানবচিত্তের চরম অধঃপতন হল।
ইসলাম বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। ভ্রান্ত কাফেরগণ! ক্ষান্ত হও–ঈশ্বর নিরাকার, সর্বব্যাপী, তিনি জন্মগ্রহণ করেন না, তাকেও কেউ জন্ম দেন না। ইসলাম সত্যই বলেছেন। জগতকে বিশাল পতন হতে রক্ষা করেছেন। ইসলামের আজান এবং রোজা-নামাজ পৃথিবীতে ঈশ্বরের নাম অতি সুন্দরভাবে বজায় রেখেছে। ইসলামের আবির্ভাব না হলে জগতের মানুষ ঈশ্বরের নাম একেবারেই ভুলে যেতো। ইসলামের কল্যাণে চরম পৌত্তলিকও বলে-ঈশ্বর এক, যদিও সে ব্যবহার জগতে আদি শক্তি দুর্গারূপিনী মূর্তিতে জগতে ঈশ্বরের জননী ভাবের ছবি জগধাত্রীরূপে পূজা করে। এই প্রকাশ্য রোজা নামাজ ও আজান জগতে ধর্মের বাহ্যিক চর্চা রেখে–পৃথিবীর মহাকল্যাণ করেছে। রাজা থেকে পথের বেশ্যা মুসলিমের আজান ও শরিয়তের কল্যাণে আল্লাহর সত্তা নিত্য অনুভব করেছে। রোজা নামাজ মানব সমাজের ধর্মের ধ্বজা জীবিত রাখার জন্যে একটি সামাজিক জীবিত অনুষ্ঠান মাত্র। এই-ই সব নয়। এই-ই ইসলাম ধর্মের সব নয়–প্রাণের সঙ্গে যোগহীন আবৃত্তি অর্থাৎ মুখস্থ পাঠ ইসলাম ধর্ম নহে। জগতে ধর্মের ভাব জীবিত ও সবল রাখবার জন্যে তার নিজের আধ্যাত্মিক জীবন একেবারে মরে গেছে। তার প্রার্থনা একটা অভিনয়ে পরিণত হয়েছে। প্রকৃত প্রার্থনাশীল জীবন তার নাই, আপন আত্মায় সে ঈশ্বরের সজাগ বাণী শোনে না। সে নামাজে বুঝে নামাজই পড়ে, দিকে দিকে আজানের দ্বারা প্রভুর বাণী প্রচার করে–যে নিজে এক বর্ণ বোঝে না। পাপের প্রতি তার ঘৃণা নাই। সত্যের বাক্য তার আত্মায় নাই। ঈশ্বরের সত্তা তার আত্মায় অনুভব করে না।
মুসলিম জাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ইসলামকে সত্যরূপে আবার তার সামনে ধরতে হবে। তার ধর্ম শুধু মুখস্থ আর গুনাহ মাফ চাওয়া ধর্ম নয়। তার কাজ আছে–তার জীবনে সংগ্রাম আছে। ধর্মযুদ্ধ ও তার ধর্ম–মুমীনের হৃদয় ঈশ্বরের আসন; রুহে কুদুসের বিশ্বাসী–তাকে হতে হবে। মুহূর্তে মুহূর্তে তার আত্মায় সত্যের যে বাণী ধ্বনিত হয়–তাই মানা তার ধর্ম। যে মুসলমানের বুকে বিবেক, প্রজ্ঞা বা সত্যের বাণী জাগে না সে মৃত। মুসলমান জাতি আজ মৃত। ত্বকচ্ছেদই তার ধর্ম হয়েছে। কোরবানী করে ষাড়ের পিঠে চড়ে সে দৌড়ে স্বর্গে যাবে–এই অন্ধ বিশ্বাস সে পোষণ করে। পাপের সঙ্গে, মিথ্যার সঙ্গে, অন্যায়ের সঙ্গে, শয়তানের সঙ্গে, তার জীবনের সংগ্রাম নেই। মাথার উপর টিকির মতো এক টুপি রেখে সে মহাধার্মিক হয়েছে এই ভাব দেখায়। সে জ্ঞান বর্জিত, বিবেক বর্জিত, আত্মজিজ্ঞাসা বর্জিত চিন্তাশূন্য পশু।–মন্দতায় আকণ্ঠ সে ডুবে আছে।
মুসলমানের ধর্ম জীবন-কী? তার কাছে প্রার্থনাশীল জীবনের স্বরূপ কী? তার পরিষ্কার উত্তর এখানে দেওয়া হচ্ছে।
সর্ব পাপমুক্ত হওয়াই ইসলাম ধর্ম। মুসলমানের ধর্ম জীবনের একমাত্র সাধনা পাপকে জয় করা। হে আল্লাহ, আমি শয়তানের হাত হতে তোমার আশ্রয় চাই–এই হচ্ছে তার বড় প্রার্থনা। তার জীবনে পাপ-পুণ্যের কাটা-কাটি, জমা-খরচ হবে না। নামাজের পুণ্য আলাদা, পাপের শাস্তি আলাদা–তা হবে না! তা হবে না! নামাজ পড়লে পাপের ক্ষমা হবে না। না বুঝে নামাজ পড়া এও ইসলাম ধর্ম নয়, কোন ধর্ম নয়। প্রার্থনা তা আন্তরিক এবং আত্মার সত্য বেদনা নিবেদন হওয়া চাই। মানুষকে কোনো রকম দুঃখ দেওয়া পাপ। জগতে দুঃখ সৃষ্টি করা পাপ। তোমার জীবনের দ্বারা, কথা ও ব্যবহারে যদি পৃথিবীতে দুঃখ ও জ্বালা উপস্থিত হয়, তুমি পাপী। নামাজ দুই-একবার ত্যাগ করলে তত পাপ হয় না, যত হয় মিথ্যা, অন্যায়, প্রবঞ্চনা ব্যভিচার, লোভ, চুরি এবং মানুষকে দুঃখ দেওয়াতে। অথচ ঠিক এর উল্টা সমাজে চলছে। নামাজ ঠিক আছে–পাপ ও শঠতার অন্ত নেই। ত্বকচ্ছেদ,. আরবিতে নাম রাখা, মৃত্যুর পর ফাতেহা পাঠ করা, মসজিদ ঘর তোলা, মৃত্যুর পর খতম। পড়ান, লক্ষ কলেমা পাঠ, শুশ্রু রাখা এবং ইসলাম ধর্মের গর্ব করাই যেন এদের ধর্ম। আত্মার দিকে এরা তাকায় না। তওবা (অনুতাপ) ব্যাপারটিও এরা মোল্লার পাগড়ী ধরে এক টাকা নজর দিয়ে শেষ করে। কী বিড়ম্বনা! আত্মার লজ্জা প্রকাশ ও অনুতাপ তাও এরা না বুঝে করে।