স্বরচিত ব্যক্তিগত প্রার্থনা এই ধরনের হবে। যেমন প্রাতে উপাসক নামাজ শেষে ব্যক্তিগত প্রার্থনা করছেন, প্রভু! হে মহামহিম, রাত্রির নিরাপত্তার জন্যে তোমায় ধন্যবাদ। রাত্রিতে যখন আমি দ্রিায় অচেতন ছিলাম, তখন তোমার দৃষ্টি আমাকে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করেছে। আজকাল আমার এই জীবনের দিন যেন তোমার কার্যে ব্যবহৃত হয়–যেন আমার জন্য আজকের দিন বৃথা এবং ব্যর্থ না হয়। দিবসের প্রতি কথা এবং প্রতি কাজে যেন তোমার গৌরব রক্ষা করি। যেন সকল কাজে তোমার ইচ্ছা পালন করি। যেন তোমায় ভুলে না থাকি। আমার জীবনের দ্বারা পৃথিবীর মঙ্গল হউক। যেন মানুষের অভিশাপের পাত্র
হয়ে জগতে বাস করি। মানবকল্যাণে আমার দিনগুলি সার্থক ও সুন্দর হউক। যেন হৃদয়ে নীচ চিন্তা, পাপের চিন্তা প্রবেশ না করে–আমাকে অহঙ্কারী হতে দিও না। তোমার স্বভাব ও ভাবে আমার জীবনকে রঙিন কর। পার্থিব চিন্তায় আমার জীবনকে ব্যর্থ করো না। যেন অবৈধ অসিদ্ধ অন্ন মুখে তুলে না দিই। ছলনা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতায় আমার জীবন যেন কলঙ্কিত না হয়। প্রতিদিন যেন তোমার কাজ সার্থক হয়। আমাকে বিধর্মীদের মতো করো না। যেন সব বিষয়ে তোমার উপর নির্ভর করি, তোমার কাছে শক্তি ভিক্ষা করি, অধার্মিকদের উপর আমার কর্তৃত্ব দাও। আমায় বল, স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান, রূপ, ঐশ্বর্য, আনন্দ, শান্তি, বিশ্বাস দাও–যেন তোমার যোগ্য দাস হই ইত্যাদি।
অথবা এইরূপ : প্রভু! আজ প্রভাতের উজ্জ্বল আলোমুকুরে দেখলাম তোমার নির্মল সুখ। প্রভাতের নির্মল বাতাস কুসুমের সৌন্দর্যের মতো, প্রভু। আমায় নির্মল কর, সুন্দর কর ইত্যাদি।
.
১৭. সম্মানিত ব্যক্তি ও পণ্ডিতদের সঙ্গে নিঃস্বার্থ সাক্ষাৎ
পণ্ডিত, আলেম, জ্ঞানী, সম্মানিত, পূজনীয় ব্যক্তির সাথে নিঃস্বার্থভাবে মাঝে মাঝে দেখা করা ধর্ম জীবনের অঙ্গ। আজকাল নিঃস্বার্থ দেখা-সাক্ষাৎ উঠে গিয়েছে–যেখানে লাভের আশা থাকে, স্বার্থসিদ্ধির আশা থাকে, সেইখানে মানুষ মধু-মক্ষিকার মতো ঘোরে। যে মানুষ অর্থশালী, যে রাজপদে নিযুক্ত তার বাড়িতে লোক ধরে না, তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আত্মীয়তা করতে মানুষের উৎসাহের সীমা থাকে না। কিন্তু মহাজনেরা কখনও স্বার্থ চিন্তায় বড়লোকের কাছে আসা যাওয়া করেন না।
ঈশ্বর উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর কার্যে জীবিত থাক–সেই উদ্দেশ্যে সজ্জনের সঙ্গে দেখা কর। এই-ই তোমাদের জীবিত থাকবার একমাত্র দাবি হোক।
ঈশ্বরের কার্য কী? তা মানব কল্যাণ, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সংবাদ বহন, বিদ্যালয় স্থাপন, হাসপাতাল নির্মাণ, মানুষকে সুখী ও মানুষ করবার প্রচেষ্টা, নিজে সুখী ও সম্পদশালী হওয়া, পরিবারবর্গ প্রতিপালন, প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা, নিজের মধ্যকার পশুভাব দমন, মানুষকে সত্যময় ও সুন্দর করা। ঈশ্বরের কাছে ঐশ্বরিক শক্তি ও সাহায্য ভিক্ষা এবং এই জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা, সামাজিক ধর্ম জীবনের মর্যাদা রক্ষা, অর্থাৎ রোজা এবং আজানসহ সমবেতভাবে নামাজ পড়া।
তোমাদের দৈনিক জীবনের আলাপ ও গল্পের বিষয় এইসব লোক। হায়! মুসলমান সমাজের দৈনিক্সআলাপ হয় কী বিষয়ে যা বলতে লজ্জা করে। মানুষ মানুষের সহিত দেখা করে অতি জঘন্য স্বার্থে। কেউ কারো সঙ্গে আল্লাহর জন্যে সাক্ষাৎ করে না।
যেমন জগতে রাজার শাসন সম্বন্ধে সর্বদাই তোমরা আলোচনা কর, সভা কর, তেমনি আল্লাহর রাজ্য, তাঁর শাসন, নীতি, তাঁর রাজ্য বিস্তার সম্বন্ধে তোমরা আলোচনা কর, সভা কর। মানুষের সঙ্গে ভক্তি ও প্রেমের প্রেরণার উৎসাহে আন্তরিকতায় দেখা কর, সাক্ষাৎ কর। কীভাবে আল্লাহর রাজ্য চলেছে, চলবে। প্রভুর সম্বন্ধে আমরা আরও কী করতে পারি। কীভাবে আল্লাহর সেবা আমরা তার কোটি কোটি ভক্ত সৈনিক সন্তান মিলে করতে পারব। কী করে পাপী আর তার অনুচরদলের অভিযান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেব। এ আয়োজনে, এ কল্পনা কি তোমাদের আছে? তোমরা আল্লাহর রাজ্যে বাস কর না তোমরা বাস কর ইংরেজদের রাজ্যে, সেই জন্যেই সেই কথা বল, সেই রাজ্যে বড় চাকরি পাবার জন্যে বড়লোকের দুয়ারে হানা দাও। তাঁর শাসন সম্বন্ধে কোনো আলোচনাও তোমরা কর না।
দেশের সম্মানিত ব্যক্তি যারা, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা উচিত। দাম্ভিক অহঙ্কারী হয়ে সম্মানিতকে তুচ্ছ করো না। প্রভুর কাছে দাস হয়ে নত হও এবং সর্ব প্রকারে তার। অনুগত থেকে তার মঙ্গল কর। সম্মানিতদের, পণ্ডিতজনকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা কর।
দুষ্ট, অনাচারী, যে আল্লাহর পথে নাই, তাকে সম্মান করো না, তার কাছেও যেও না।
.
১৮. হাসপাতাল নির্মাণ
হাসপাতাল নির্মাণের কথা একবার কেন, অনেকবার বলেছি। আবার বলি, দেশের সর্বত্র পীড়িতের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের পাশে পাশে হাসপাতাল, যক্ষ্মাগার স্থাপিত হওয়ার মতো ধর্মকাজ আর নাই। পীড়িতের সেবা কর। এই হচ্ছে ধর্ম। শুষ্ক লবণহীন রোজা নামাজে কোনো ফল হবে না।
ইচ্ছা থাকলে এসব কাজে টাকার অভাব হবে না। প্রত্যেক মসজিদ ঘরে সম্মানিত, সাধু এবং যোগ্য পণ্ডিতকে পুরোহিত নিযুক্ত কর। তিনি চাঁদা তুলবেন, তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করবেন, হাসপাতাল স্থাপন করবেন। মৃত্যুর জন্যে ফাতেহা উপলক্ষে যে অর্থ একবেলায় ব্যয় করে ফেল তার কতক অংশ এইসব মহৎ জনহিতকর কাজে ব্যয় কর শত শত নারী ‘হোম’ গড়ে উঠবে! হে বন্ধু, শুধুই রোজা-নামাজ করে, ধর্ম জীবনের ইতি করো না। তোমার ধর্ম–জীবনের সার্থকতা ক্ষেত্র আরও বৃহত্তর। কসম আল্লাহর, তা আরও বৃহত্তর–কী করলে পাগলেরা, ধর্মজীবনকে এমনভাবে মিথ্যা করে দিলে? তোমরা যে জীবনযাপন করলে ওকে কি ধর্মজীবন বলে? টিকির উপর টুপিটা রেখে গুনগুন করে সুর করে দরূদ পড়লেই কি ধার্মিক হওয়া যায়–মাঝে মাঝে বাড়িতে মৌলুদ দিলেই কি ধর্মের সংসার পাতা শেষ হল? তোমার জীবনের কাজ কই, পরিচয় কই?