মানুষকে গোপনে দান কর যেন তোমার দানশীলতার পরিচয় কেউ না পায়।
দানে যার হস্ত পবিত্র হয় না, সে যেন অজু করে নামাজ না পড়ে।
যে বাহুল্য ব্যয় করে, যার নিজেরই বিলাস আকাঙ্ক্ষার তৃপ্ত হয় না, সে ক্ষুধিত, মরণ মূৰ্ছিতকে কী দেবে? সেই নিষ্ঠুর আপন সুখ-চিন্তায় ব্যস্ত-ব্যথিতের বেদনা-চিৎকার তার কানে কী পৌঁছাবে?
Lay by something in youth, so that you may not sharve in old age.
মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক ধর্ম যা তাই বড় ধর্ম। মানব-সমাজে থেকে নিত্য মানুষ যা করবে, মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে নিত্য ব্যবহার করবে, তারই আদর্শ এ ধর্ম জীবনে দেওয়া হয়েছে। কোনো গুপ্ত মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব এখানে প্রচার করা হচ্ছে না। আম গাছে কাঁঠাল তৈরি করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, মরা মানুষ বাঁচান–এসব জগতে হয় না! ওসব কথা সত্য হলেও বা শুনতে ভালো শোনা গেলেও ধার্মিকের কাজ নয়। ঈমানের বলে মরা মানুষকে জীবিত করা যায়–এসব বিশ্বাস বর্তমানে না করাই উচিত।
“কাল কী খাবে, তার চিন্তা আর করো না–
কালকের জন্য কালকের চিন্তাই যথেষ্ট।”
যে জাতির পুরোহিত এই বাণী প্রচার করেছেন, তার শিষ্যেরা কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করে বসে আছেন। রিক্তহস্ত হওয়া তাঁরা পাপ ও মূর্খতা মনে করেন। এই বাণী যতই মহৎ কার্যত মানুষের অভাব সঞ্চয় ব্যতীত, নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত অতি কঠিনভাবে পূরণ হয়-এক রকম হয় না। অভাবে, দুঃখে-দারিদ্রে মানুষ মরে যায় অথবা চির অবহেলিত হয়ে শৃগাল-কুকুরের মতো জগতে বাঁচে। এ অভাব পূরণ করা পূর্ব হতে সতর্ক হওয়া, বুদ্ধি করে পূর্ব হতে বিপদের দিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখাই ধর্ম করা–অভাবের দিনে আল্লাহই পূরণ করবেন, এ বিশ্বাস পোষণ করা ধার্মিকের কাজ নয়–এই বিশ্বাস মূখেরাই পোষণ করে। সন্তান হবার আগে মায়ের স্তন দুগ্ধ ভর্তি হয় এ কি দেখ না।–পূর্ব হতে সঞ্চয় করে রাখ এবং সতর্ক হও। এ জগতে কেউ কারো কথা ভাবে না। নিজের অভাব পূরণ না করে মানুষ তোমার অভাব পূরণ করবে, এ আশা করা উচিত নয়।
এক দরবেশ দেখলেন মাঠে এক মরা পড়ে আছে। সিংহ বৃষ হত্যা করে রেখে গেছে, শৃগাল আনন্দে বিনা পরিশ্রমে তাই খাচ্ছে। দরবেশ ভাবলেন, শৃগাল যখন বিনা পরিশ্রমে বসে বসে খাচ্ছে, তখন খোদাতায়ালা ইচ্ছা করে এইভাবেই বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, তবে আমি কেন অন্নের জন্য উদ্বিগ্ন হই। এক স্থানে বসে থাকি, আপনা-আপনি আহার আসবে। সেই কথা ভেবে দরবেশ এক অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। ১৫ দিন অতিবাহিত হল, কোনো সাহায্য এলো না। তখন তিনি জ্ঞান–বাণী পেলেন। কেন শৃগালের মতো হতে চাও? সিংহের মতো নিজে চেষ্টা করে বৃষ হত্যা কর–শৃগালেরা খাবে।
কথাও তাই, শৃগাল হতে ইচ্ছা করা বীর ধার্মিকের কাজ নয়।
তার পক্ষে সিংহ হওয়াই উচিত।
যার অর্থ নাই, সে মানুষকে কি করে বাঁচাবে?–মানুষকে কি খাওয়াবে?
১৬-২২. প্রার্থনা
১৬. প্রার্থনা
যখন-তখন, দিনের মধ্যে যতবার ইচ্ছা–যে অবস্থায় থাক না, আপন ভাষায় সময় ও অবস্থার সঙ্গে তাল রেখে প্রার্থনা করা যায়। প্রত্যেক কাজের প্রারম্ভে, যে কোনো প্রকার দুঃখে, অশান্তিতে, উদ্বেগে, বেদনায় এক অথবা দুই একজন মিলে শব্দ করে আল্লাহর কাছে। আন্তরিকভাবে, পরম নির্ভরশীর সরল শিশুদের মতো প্রার্থনা করবে। প্রার্থনা যদি আন্তরিক হয়–তবে সঙ্গে সঙ্গেই আত্মায় পরম ভরসা আসে। প্রার্থনা মানব জীবনের পরম অবলম্বন। মানবাত্মাকে ঈশ্বরের পথে আত্মোন্নতির পথে আকর্ষণ করার এই-ই একমাত্র পথ। সর্ব দুঃখের মীমাংসা প্রার্থনায় সম্ভব। প্রার্থনার দ্বারা পীড়া এমন কি সর্ববিষ শান্ত হয়। এই ধরনের প্রার্থনার সঙ্গে নামাজের কোনো সংশ্রব নাই। আজান ও নামাজ সামাজিক সঙ্গতি, এক কথায় পৃথিবীতে মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাস ও ধর্ম জীবনকে চিরজীবিত করে রাখবার জন্যে একটা বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। মানুষের স্মরণপথে তার মনের সম্মুখে ঈশ্বরকে সদাজাগ্রত করে রাখবার জন্য মুসলমান নামাজ পড়ে একটা অপরিহার্য কর্তব্য পালন করে।
প্রার্থনা দুই প্রকার : প্রথম সাধারণ শ্রেণীর জন্যে, যেমন আত্মোন্নতির মানব জীবনের কল্যাণের জন্যে, মানবাত্মার চির আত্মোন্নতির সমস্যা সমাধানের জন্যে। যেমন পাপের ক্ষমার উদ্দেশ্যে–ঈশ্বর নৈকট্য লাভ উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়, সাময়িক কোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে নামাজকে প্রথম প্রকারে অন্তর্গত করা যায়। না বুঝে প্রার্থনা, না বুঝে কোরান পাঠ অসিদ্ধ। সর্বদাই আত্মায় অনুভব করে এমন প্রার্থনা কর। শুক্রবারের নামাজ-পরিচালকের বক্তৃতা, সাধারণ ধর্ম কথা এবং উপস্থিত বা সাময়িক প্রসঙ্গ দেশীয় ভাষায় হবে। যদি বিদেশী ভাষায় হয় এবং শ্রোতৃমণ্ডলী না বুঝতে পারেন, তা অসিদ্ধ। নামাজ শেষে হাত তুলে যে ব্যাক্তিগত শেষ প্রার্থনা করা হয়, তা অবশ্যই নিজের ভাষায় হওয়া উচিত। মোট কথা, না বুঝে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কোনো বাক্য আবৃত্তি অসিদ্ধ। প্রার্থনা স্বরচিত হওয়া উচিত। ঈশ্বর রচিত কথাও যদি প্রার্থনার মতো হয়, তবে সমাজে তা ব্যবহার করা, যায়। অপ্রাসঙ্গিক কথা যেমন যুদ্ধ বর্ণনা, নারীর শুচিতার ও অশুচিতার কথা, ঐতিহাসিক কথা–এসব নামাজে ব্যবহৃত না হওয়াই উচিত।