আল্লাহর আদেশ–পরের দ্রব্যে লোভ করো না। পরের দ্রব্যে তো লোভ লেগেই আছে–পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার দুর্নিবার ইচ্ছা সব হাজি, সব নামাজির আছে। কে কবে আপন বোনের সম্পত্তি তাকে দিয়ে থাকে? এসব আগুন খেয়ে নামাজ পড়লে, নামাজ হবে না। মৃত ভ্রাতার নাবালক সন্তানগণকে বঞ্চিত করে, বিধবা পত্নীকে বঞ্চিত করে তাদের সম্পত্তি নিজে ভোগ কররার কী লোভ তোমার!
কেউ যদি কিছু গচ্ছিত রাখে, তাও ভোগ না করতে পারলে, মোটেই ভালো লাগে না।
পরের দ্রব্যকে হারাম ভাব। তোমার উপর কেউ সম্পত্তি পরিচালনার ভার দিলেন। তুমি ধীরে ধীরে তার অজ্ঞাতসারে একে একে সব গ্রাস করতে থাকলে। তোমার নামাজ রোজার কামাই নাই। ধর্ম খুবই ঠিক রাখছ বটে। ভাবছো আল্লাহ কিছুই বুঝতে পারছেন না। তোমার লম্বা কুর্তা দিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছ–আল্লাহকে ঠকাতে পারবে না।
আল্লাহর আদেশ-চুরি করো না।
জনৈক পদস্থ রাজপুরুষ গোপনে রাত্রে ঘুষ আদায় করতেন–শুক্রবারে বাচ্চাহারা গাভীর মতো মসজিদ ঘরে দৌড়ে যেতেন। এ তো চমৎকার নামাজ! নামাজের ত্রুটি হয়।
কিন্তু ঘুষ গ্রহণ, প্রতারণা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, এসব লেগেই আছে। বোধ হয় বণিকের খাতার মতো জমা-ওয়াসীল হয়ে পুণ্যের ভারই বেশি হবে। আর সেই পুণ্যবলে বেহেস্তে লেজ দোলাতে দোলাতে উপস্থিত হবে।
এই যে নামাজ–আমার মনে হয় এও অর্থ উপার্জনের একটি পন্থা। ধার্মিক বলে। সমাজে নাম থাকলে, অর্থ উপার্জনের কেননা বিঘ্ন হবে না। এই হচ্ছে ধারণা।
.
১৫. অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা
মানুষকে অন্ন দেবার মতো মহাধর্ম আর নাই। ভরা পেটে খাবার দান করা এমন কিছু নয়, কিন্তু জগতে তাই হয়। বাইরে রাস্তায় পড়ে মানুষ এক মুঠো অন্নের জন্য কাতর চিৎকার জানাচ্ছে। ভিতরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি জোড়হস্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেও তাকে আরো খেতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, বড়লোক, এদের প্রীতিভোজ দিতে নিষেধ করি না–কারণ এরও একটা আবশ্যকতা আছে। যার আছে তারও তো ক্ষুধা লাগে। আনন্দ তার। জন্যেও দরকার। অন্নহীন দরিদ্রের কথা একেবারে ভুলে যেও না। তোমরা বড়লোকের সন্তান, ঘরে অন্নের অভাব নেই। কিন্তু রোজার মাসে আল্লাহ তোমাদের অন্নহীন উপবাসীর বেদনা বুঝবার সুবিধা করে দিয়েছেন সেই ব্যথা ভেবে দরিদ্রের কথা চিন্তা কর। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পেট ভরে খেয়ে শুয়ে থেকো না–তার মতো পাপ আর নাই।
দেশের অন্নহীনদের অর্থ উপার্জনের সুবিধা করে দেওয়া মহৎ লোকের কাজ–দেশ সেবকের কাজ, পুণ্যবানের কাজ। শুধু শুক্রবারে সমবেত উপাসনা করলে উপাসনা সিদ্ধ হবে না–ওরে অবোধ!
শুধু অক্ষর পালন করলে আল্লাহর আদেশ পালন হবে না। সমবেত হও সবাই, দেশের জনহিতে কাজ কর, মানুষের ক্ষুধার স্থায়ী মীমাংসা কর–ভিক্ষা দিয়ে কটা লোককে কদিন বাঁচান যায়। তথাপি ভিক্ষা দাও–দান কর, দান ব্যতীত নামাজ সিদ্ধ হয় না। দেশের লোকের বেদনার চিৎকার শোন না? ওরে অবোধ! এই কি তোমার প্রাণের দরদের পরিচয়! দরদ ছাড়া কি স্বর্গের যোগ্য হওয়া যায়? দরদ চাই, প্রেম চাই।
যদি জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, ফকিরিতে আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে পার, তবু তোমার কোনো মূল্য হবে না, যদি না তোমার প্রাণে প্রেম, দরদ, আদর-মহব্বত থাকে। প্রেম করতে শেখ, অহঙ্কার ত্যাগ কর–মানুষকে, আপন ভ্রাতাকে দরদের দাবি হতে বঞ্চিত করো না। ওরে পশু! ভ্রাতাকে বঞ্চিত করে মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছ? পশুতেও তো গোয়াল ঘরে তার বন্ধুর অঙ্গ চাটে। তুমি মানুষের বেদনা-চিৎকার শুনে কি ঘরের দরজা দিয়ে শুলে? হায়, মানুষের কী হল? মানুষ ঈশ্বরের সন্তান হয়ে কি এত নিষ্ঠুর হল! পিতার মৃত্যুতে ফাতেহা উপলক্ষে বৃথাই ৫০০ টাকা ব্যয় করলে? যে মানুষ জীবনে ধর্ম করে নাই, পয়সা দান করে নাই, মরণের পর তার দান আর একজন করলে কী হবে? জীবিতের জন্য ধর্ম। মৃতের জন্য নয়। জীবনে বেঁচে থাকতেই ধর্ম করে যাও। দেশের আর্ত পীড়িতের জন্য ফাতেহার পরিবর্তে বরং হাসপাতাল স্থাপন কর। এতে মানুষের কত মঙ্গল হয় তা কি একটু বুঝতে পার না! এমন পাগল কোথায় আছে?–যে আপন মঙ্গল, জাতির মঙ্গল ভাল বুঝে না? দেশের সর্বত্র শিশুদের জন্যে, পীড়িত প্রসূতির জন্যে, বৃদ্ধের জন্যে হাসপাতাল স্থাপন কর এবং মানুষকে বাঁচাও। এর মতো ধর্ম আর কী আছে? এই দুঃখের দেশে এই দরিদ্রের দেশে কি মান করা সাজে? অর্থশালী হও, অর্থ উপার্জন কর–সেই অর্থ দিয়ে পীড়িত দুঃখীর সেবা কর। মাঠে পরিশ্রম কর, ঘর ধানে অনে ভরে উঠুক। মানুষকে অনুদান কর। অন্নদানের মতো পুণ্য কী আর আছে! বাড়িতে অতিথি এলে যে অন্য বাড়ি দেখিয়ে দেয়, ধিক তাকে! মানুষকে, অতিথিকে, প্রতিবেশীকে অন্ন দাও–তারা পেট ভরে খাক এবং দোয়া করুক! কৃষি কর–এবং প্রচুর ধান গোল ভর্তি করে তোল। দান কখনো সুদি করে লাগাতে নাই। দানের জন্যেই অন্ন। মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অন্ন গ্রহণ করতে বল–এরই নাম প্রেম ও ভালবাসা। যাবৎ না মানুষকে আপনার ভাই বলে ভালবাসতে পার, তাবৎ স্বর্গের যোগ্য তোমরা হবে না। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে টাকার হিসাব করো না। অফুরন্ত উপার্জন কর এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দান কর। তোমার গ্রামের নিঃসহায় বিধবা পীড়িতেরা যেন অভুক্ত এবং বেদনায় ব্যথিত না থাকে।