লাউডেনের মনের দৃঢ় বাসনা ছিল, জীবনকে উন্নত ও গৌরবময় করামানুষের কল্যাণ করে জীবনকে ধন্য করা।
একজন সামান্য বালকের মনে এই উন্নত কল্পনা কত সুন্দরা অল্পকালের মধ্যে লাউডেন ফরাসী ভাষায় বুৎপত্তি লাভ করলো। ফরাসী ভাষা শেখা হলে সে জার্মান ভাষা শেখার জন্য আগ্ৰহান্বিত হলো। জার্মান ভাষাও অল্পকালের মধ্যে তার আয়ত্ত হয়ে গেল।
স্যামুয়েল এবং জেবেজ বলে আরও দুইটি বালক ছিল। তাদের বাপ ছিলেন একজন মুটে। দরিদ্র পিতা দু’ভাইকে এক পাঠশালায় পাঠালেন। জেবেজের বেশ স্মরণশক্তি ছিল। কিন্তু স্যামুয়েল ছিল যেমন দুষ্ট, তেমন বোকা। লেখাপড়ায় সুবিধা হলো না দেখে কিছুদিন পরে বাপ তাকে কাজ শেখাবার জন্য এক জুতোর মিন্ত্রির কাছে দিলেন। সেখানে কাজের চাপে চােখে তার সরষে-ফুল ফুটতে লাগল।
বদমাইশী, আম চুরি এসব কাজে স্যামুয়েলের খুব উৎসাহ ছিল। একবার এক দুষ্টুমি করতে যেয়ে তাকে সমুদ্রের মাঝে নৌকা ড়ুবে প্ৰাণ হারাতে হয়েছিল আর কি। তুমি শুনে বিস্মিত হবে—দুই মাইল সাঁতরিয়ে কুলে উঠে সে প্ৰাণ বাঁচায়।
এই ঘটনার পর থেকেই দুৰ্দাত্ত স্যামুয়েলের স্বভাব বদলে গেল। এই চাের, এই বদমাইশ, এই মাথা-গরম যুবক যে একদিন তার বিদ্যা ও বুদ্ধির দ্বারা জগৎকে চমৎকৃত করবে একথা তখন কে ভেবেছিল?
তার মনের এই দুৰ্দমনীয় উগ্রতা ভাল হবার দিকে ফিরে গেল। জীবনের এই দুর্ঘটনার পর হতে তার স্বভাবে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। সে চাপল্য, সে হঠকারিতা আর রইল না। সে সময় হতে স্যামুয়েল জ্ঞানানুশীলনের দিকে মন দিলেন। যতই পড়তে লাগলেন, ততই নিজের অজ্ঞতা ও মূর্খতা বুঝে লজ্জিত হতে লাগলেন। মনের এই অন্ধকার দূর করবার জন্য ভিতরে এক দুৰ্দম বাসনা জেগে উঠল! এরূপ জীবিকা অর্জনে যে সময় ব্যয় হতো তা ছাড়া বাকী সময় লেখাপড়া করতে লাগলেন। এক মিনিটও তিনি বৃথা সময় নষ্ট হতে দিতেন। না। কাজের ভিড়ে পড়বার সময় যখন পেতেন না, তখন খাবার সময় সামনে একখানা বই রেখে স্যামুয়েল ভাত খেতেন।
বিশেষ একখানা বই পড়ে তার মন আরও উন্নত হয়ে গেল-নিৰ্মল চরিত্র ও আধ্যাত্তিক ভাবাপন্ন হয়ে পড়লেন।
কিছুদিন পরে তিনি স্বাধীন ব্যবসা আরম্ভ করলেন। ধার হবে এই ভয়ে অনেক সময়ে রাতের বেলা না খেয়েই শুয়ে থাকতেন।
ব্যবসা, সাহিত্যসেবা ও জ্ঞানালোচনা করে যে সময বাঁচত, সে সময় তিনি জনসাধারণের সম্মুখে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন।
ঘর-সংসার হলে, ছেলেদের কাই-মই হৈ-চৈয়ের ভিতর, এমনকি রান্নাঘরে বসে তিনি লিখতেন। আর পড়তেন।
শেষ বয়সে তিনি বলতেন-নিতান্ত জঘন্য অবস্থা হতে আমি নিজেকে টেনে তুলেছি। আমার এই সাধনার সঙ্গী ছিল পরিশ্রম, চরিত্র এবং মিতব্যয়িতা।
০৪. ব্যবসা, শিল্প বাণিজ্য
এক ওয়াচ-মেকারের দোকানে দেখতে পেয়েছিলাম, তার ছেলে চমৎকার যন্ত্র তৈরী করেছে। এরূপ জিনিস যে আমাদের দেশে সম্ভব তা আগে জানতাম না।
ঢাকা জেলার পশ্চিম বানানির একটা লোক স্টিমারের ভিতর হাতের তৈরী কতকগুলি ঝিনুকের গহনা আমাকে দেখায়। আমি সেই সব জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম।
অনেক জায়গায় সামান্য অশিক্ষিত মুচি চমৎকার চমৎকার জুতো প্ৰস্তুত করে। ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে বহু মানুষ সুন্দর আশ্চর্য জিনিস প্রস্তুত করে। বিজ্ঞানের শক্তির সম্মুখে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না বলেই তাদের আদর হয় না।
বিলাতের লোকের মধ্যে নানা প্রকার সাংসারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ প্ৰস্তুত করার ঝোঁক চিরকালই বেশী। কোন চিন্তা বা ফল নিয়ে তারা বসে থাকে না। উন্নতির পর উন্নতি করতে চেষ্টা করে। আমাদের দেশের লোক তা করে। না। করা দরকার বিবেচনা করে না। বর্ধমান জেলায় চিকনের কাজ, শান্তিপুরের ফুল তোলার কাজ দেশের লোক শ্রদ্ধার চােখে দেখে না।
ব্যবসার মধ্যে জাতির বেঁচে থাকবার উপকার অনেক বেশী। লেখাপড়া শিক্ষা করা বা জ্ঞানানুশীলন চাকরির জন্য কিছুতেই নয়। জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে সকল দিকে উন্নতি করা তুমি ভাল চাষা, কামার, দরজি, মিস্ত্রী এবং কারিগরী হও। বিশ্বাস কর চাকরির জন্য জ্ঞান নয়। তোমাদের যেমন হাত-পা আছে, জ্ঞানও তেমনি তোমাতে থাক। চাকরির জন্য জ্ঞানার্জন করো না।
শিল্পী বা ব্যবসায়ী হলে তোমাকে ছোট থাকতে হবে তা নয়। সব জায়গাতেই অধ্যবসায়ী ও পরিশ্রমী হতে হবে। কতকগুলো লোকের কথা বলবো যাদের জীবন কাহিনী শুনে তুমি বুঝতে পারবে-হীন অবস্থা হতে অধ্যবসায়, বুদ্ধি ও পরিশ্রম দ্বারা কেমন করে শিল্প-বাণিজ্যে উন্নতি করে নিজের, দেশের ও মানুষের কল্যাণ সাধন করেছেন। সাধনাপথে বাধা এসেছিল—তারা সে সব গ্রাহ্য করেন নি। শিল্প-বাণিজ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার কঠিন শাস্তি মানুষকে চিরকালই ভোগ করতে হয়!
লেখাপড়া জান না, যদি অধ্যবসায়ী, চিন্তাশীল এবং দৃষ্টিসম্পন্ন হও—তুমি মানুষের উপকার করতে পারবে, তোমার উদ্ভাবনা শক্তি, প্রতিভা ও আবিষ্কারের দ্বারা তুমি বিশ্বের নর-নারীকে চিরকালের জন্য উপকার করে যেতে পার।
সাধুতাকে অবলম্বন করে তুমি ব্যবসা কর-পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন কর—তোমার আসন নীচে হবে না। প্রতারণা ও মিথ্যায় ভরা ভদ্ৰ(?)জীবন ত্যাগ করে তুমি সামান্য ব্যবসা অবলম্বন কর। অসার জীবনকে ঘূণা করতে শেখ, সত্য জীবনকে শ্রদ্ধা করতে শেখ। এখানেই তোমার মনুষ্যত্ব। ব্যবসায়ী ঘরের বহু প্ৰাতঃস্মরণীয় মানুষ জগতের কত উপকার করে গিয়েছেন। দেশীয় বা জাতীয় শ্ৰীবৃদ্ধির মূল কারণ ব্যবসায়ীর পরিশ্রম ও বুদ্ধি কৌশল। মিস্ত্রীর ছেলে ওয়াটের আবিষ্কারের ফলে জগতের কত উপকার হয়েছে। পৃথিবীর সভ্যতা তার কাছে কতখানি ঋণী। জ্বাল দিলে জল থেকে যে বাম্প ওঠে। সে বাম্পের যে কত শক্তি আছে তা কে জানত? হাজার ঘোড়ার শক্তিতে যা না হয়, বাম্পের কল্যাণে তা হয়। ওয়াট যদি মানুষকে এই কথা বলে না দিতেন, তা হলে পৃথিবীর সভ্যতা এত হতো না। রেলগাড়ির গতি, ছাপাখানা, যুদ্ধ সবই বাষ্পের শক্তিতে পরিচালিত হচ্ছে।