ওয়াট ত্ৰিশ বছর ধরে পরিশ্রম করে জগৎকে ঋণী করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সাধনা-কম নয়! কমতি-দি-বাফুন দেখিয়েছেন, ধীরভাবে পরিশ্রম করলে আমরা কত বড় হতে পারি। তিনি বলতেন-প্ৰতিভা মানে ধৈর্য ও পরিশ্রম। বাফুনের স্মরণশক্তি ছিল না, কিন্তু সাংসারিক অবস্থা ছিল খুব ভাল। ফলে স্বভাবে কুড়েমি ঢুকেছিল। অনেক বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকা তার একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক চিন্তা করেও তিনি এই রোগ হতে অব্যাহতি না পেয়ে, শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে ভৃত্য যোসেফকে বলেন-কাল হতে সকাল সকাল তুমি আমায় উঠিয়ে দেবে। প্রত্যেক দিনের জন্য পুরস্কার এক টাকা। পরদিন বেচারা যোসেফ প্রভুকে উঠাতে গিয়ে কিল-ঘুষি খেয়ে ফিরে এল। বাফুন যখন দুপুর বেলা যোসেফসে তার কর্তব্য কাজের অবহেলার জন্য খুব তিরস্কার করলেন, তখন মনে মনে পণ করলো, পরের দিন প্রভুকে যেমন করেই হোক উঠবে। সকাল বেলা বিছানার কাছে যেয়ে যোসেফ আগের দিনের মত প্ৰভুকে উঠাতে চেষ্টা করলো, ঘুমের ঘোরে। প্ৰভু ভৃত্যকে গালি দিলেন। বললেন—আমার অসুখ হয়েছে। রাত্রিতে ভাল ঘুম হয়নি—যাও, বিরক্ত করো না। প্রভুর কথা অমান্য করলে চাকরি থাকবে না-ইত্যাদি। যোসেফ ফিরে গেল।
পরদিন প্রভুকে উঠাতে যেয়ে যোসেফ কোন কথাই শুনলো না। প্ৰভু কিছুতেই ঘুম থেকে উঠবেন না-যোসেফও নাছোড়বান্দা। বালতি ভরা ঠাণ্ডা পানি প্রভুর বিছানার উপর সে যখন ঢেলে দিল, তখন বাফুনকে বাধ্য হয়ে আরাম ছেড়ে উঠতে হলো। যোসেফ পুরস্কার লাভ করলো!
প্রত্যহ নয় ঘণ্টা করে চল্লিশ বছর ধরে বাফুন পরিশ্রম করেন। পরিশ্রম না করে তিনি থাকতে পারতেন না। সেটা তাঁর অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। তাঁর জীবনচরিত রচয়িতা লিখেছেন—খেলার চেয়ে কাজই তার আমোদের জিনিস বেশী ছিল। অনবরত পড়তে তাঁর কোন কষ্ট হতো না।
এক একখানা বই তিনি কতবার করে বদলিয়েছেন–লিখেছেন। পুস্তক প্রণয়নে কোন সাহিত্যিক বোধ হয় বাফুনের মত পারেন নাই।
পঞ্চাশ বছর ভেবে তিনি একখানি বই লেখেন; আশ্চর্য!—এতেও তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নাই। একবার, দু’বার এমনি এগারবার তিনি সেই বইখানা লেখেন।
বাফুনের মত ধৈৰ্য আর কারও ছিল না।
পীড়ার মধ্যে থেকেও তিনি বড় বড় বই লিখেছেন। কাজে থাকাই ছিল। তাঁর আনন্দ ও শান্তি।
স্যার ওয়ালটার স্কট পরিশ্রমী ছিলেন। অফিসের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞানালোচনা ও সাহিত্যসেবা করতেন। অফিসের কাজ কম নয়—তার উপর সাহিত্যসেবার কঠিন পরিশ্রম!
ভোর পাঁচটার সময় উঠে নিজেই চুলো ধরাতেন, একটু কিছু খেয়ে বই-এর বোঝা সামনে নিয়ে সাহিত্যসেবায় বসে যেতেন। ছেলেপিলে, বউ-ঝিরা ঘুম হতে উঠবার অনেক আগে তিনি অনেক কাজ করে ফেলতেন।
বহু বছরের পরিশ্রম ও গভীর জ্ঞানার্জন সত্ত্বেও স্কট বলতেন—আমি আমার অজ্ঞতার কথা মনে করে লজিত না হয়ে পারি না।
ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপকের কাছে যেয়ে এক ছাত্র বি. এ. উপাধি লাভ করে। বললেন—মহাশয়, আমার লেখাপড়া তো শেষ হয়েছে। কতকাল পরিশ্রম করবো-বাড়ী যেয়ে এখন আরাম করি। অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে উত্তর দিলেন— তোমার জ্ঞানার্জন শেষ হয়েছে? আমি কিন্তু মাত্র আরম্ভ করেছি।
যারা কিছু জানে না। তাদেরই কাজ শেষ হয়ে যায়। মহাপণ্ডিত নিউটন জীবন শেষে বলেছিলেন—জ্ঞানসমুদ্রের বেলায় দাঁড়িয়ে কেবল ধুলোবালি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি—অনন্ত সমুদ্রের কিছুই দেখা হয়নি।
জন ব্রিটনকে তার কাকা দোকান হতে একেবারে অসহায় করে তাড়িয়ে দেন। ব্রিটন যখন ছোট তখন তার বাপ পাগল হয়ে যান। বাপ ছিলেন রুটিওয়ালা।
ব্রিটন তার হোটেলওয়ালা কাকার কাছে থাকত এবং কাজ-কাম করে। কিছু কিছু পয়সা উপায় করতো। হঠাৎ তার অসুখ হয়ে পড়লো—এমন অসুখ যে, তাতে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল, কাজ করার সামৰ্থ্য রইল না। নিষ্ঠুর কাকা এ ক্ষতি সহ্য করতে পারলেন না। ভাইপোর হাতে গোটা দশেক টাকা ফেলে দিয়ে বললেন— এখানে আর তোমার থাকার দরকার নেই।
এরপর সাত বছরের বালক ব্রিটনের কষ্টের অবধি ছিল না। কিন্তু কোন দিন সে পড়া ত্যাগ করে নাই। সকল অবস্থায় সে একটু-একটু করে জ্ঞানার্জন করতো। স্কুলে যাওয়া হয় নাই বলে বোকার মত চুপ করে বসে থাকত না।
জ্ঞান এবং শক্তি যার মাঝে আছে, সে কোনকিছু পাস করুক আর না করুক, তার উচ্চাসন হবেই, একথা বিলাতের সব লোকে জানে।
ব্রিটনের জীবনী পড়ে জানি, কত কষ্টের তার জীবন। যে ঘরে সে বাস করতো, সে ঘরখানি কত হীন। পায়ে কত সময় জুতো জুটতো না। দারুণ শীতে কত সময় গা খালি থাকতো। কত সময় পকেটে পয়সা থাকতো না। হাতে পয়সা নাই-না পড়লেও চলে না। খানিকক্ষণের জন্য হলেও পরের বই নিয়ে ব্রিটন তাঁর ব্যগ্ৰ মনের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতো।
যখন তাঁর বয়স আটাশ, তখন প্রথম তিনি গ্ৰন্থকাররূপে আবির্ভূত হন। এরপর পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি সাহিত্যসেবা করেন। জন ব্রিটন মোট সাতশিখানি বই লেখেন। কোন বাধা তাঁর জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে নাই।
জীবনের মালিক তুমি-দুঃখ-বেদনা ও অভাবকে বাধা না মনে করে। সেগুলিকে বরং আশীর্বাদরূপে ধরে নাও। কিছুই তোমার গতিকে রোধ করতে পারবে না। যেমন করে হোক, তুমি বড় হবেই। বুক ভেঙ্গে গেছে-ভয় নাই। ভাঙ্গা বুক নিয়ে খোদা ভরসা করে দাঁড়াও।
এডিনবাৰ্গ শহরের কাছে লাউডেন নামে এক বালক ছিল। তার বাপ ছিলেন একজন কৃষক। বাপ ইচ্ছা করলেন ছেলেকে বাগানের কাজ শিখবেন। এই কাজে লাউডেনকে দিনের বেলা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হতো। খাটুনির মধ্যে বালক লাউডেন সপ্তাহে দুইদিন সারা রাত জেগে পাঠাভ্যাস করতো।