জগতে বহু মানুষ জন্মেছেন। তাদের মধ্যে প্রতিভাবান অপেক্ষা পরিশ্রমী মানুষই অধিক। এক লেখক বলেছেন-প্রতিভার অর্থধৈর্য ও পরিশ্রম।
নিউটন বলেছেন—আমার আবিষ্কারের কারণ আমার প্রতিভা নয়। বহু বছরের পরিশ্রম ও নিরবচ্ছিন্ন চিত্তার ফলেই আমি আমাকে সার্থক করেছি; যা যখন আমার মনের সামনে এসেছে, শুধু তারই মীমাংসায় আমি ব্যস্ত থাকতাম। অস্পষ্টতা হতে ধীরে ধীরে স্পষ্টতার মধ্যে উপস্থিত হয়েছি।
ডাক্তার বেনটলেকে তিনি একবার বলেছিলেন-মানব সাধারণের যদি কোন কল্যাণ আমার দ্বারা হয়ে থাকে, তবে তা আমার অনেক বছরের সহিষ্ণু সাধনার দ্বারাই হয়েছে।
ভলটেয়ার বলেছেন—প্ৰতিভা বলে কোন জিনিস নাই। পরিশ্রম কর, সাধনা কর-প্রতিভাকে গ্রাহ্য করতে পারবে।
লোকে বলে সব মানুষ কবি হতে পারে না। বক্তা হওয়াও ঈশ্বরের দেওয়া গুণ, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।
ডালটনকে লোকে প্ৰতিভাবান বলতো। তিনি অস্বীকার করে বলতেন– পরিশ্রম ছাড়া আমি কিছু জানি না।
পরিশ্রম, পর্যবেক্ষণ ও সহিষ্ণু সাধনার সম্মুখে কিছু অসম্ভব নয়।
জগৎ ও সমাজ যারা গড়ে তুলেছেন, তারা যে সব প্ৰতিভাবান অসাধারণ, বিশিষ্ট-ক্ষমতায় ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়। তারা ছিলেন পরিশ্রমী এবং সহিষ্ণু সাধক।
প্ৰতিভাকেও যদি সাধনা বা পরিশ্রম দ্বারা উজ্জ্বল করে না তোলা যায়, তবে তার আদর হয় না। জগতের কল্যাণে তা বড় আসে না।
স্যার রবার্ট পিল যখন বালক, তখন তার বাপ তাকে একখানা ছোট টেবিলের উপর তুলে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলতেন। প্রথম প্রথম কিছু হতো না। কিন্তু বারে বারে চেষ্টা করার ফলে বালকের শক্তি জেগে উঠল। শেষ বয়সে তিনি বলতেন তার অসাধারণ বাগিতা ও তর্ক করার ক্ষমতা সেই ছেলে বয়সের সাধনার মধ্যেই ছিল।
ধীর হয়ে লেগে থাক, তোমাকে দুঃখ করতে হবে না। ধীরভাবে লেগে থাকাই হচ্ছে কৃতকার্য হবার পথ। হাল কখনও ছেড়ে না। তরী জেগে উঠবে।
ভাল রকম কাজ করতে হলে তোমাকে অসহিষ্ণু হলে চলবে না। সে যে কাজই হোক না। এক বাদককে এক যুবক জিজ্ঞাসা করেছিল–বাজনা শিখতে আমার কত দিন লাগবে? তিনি বলেছিলেন–প্ৰত্যহ ১২ ঘণ্টা করে যদি পরিশ্রম কর, তাহলে বিশ বছর লাগবে।
এক পণ্ডিত বলেছেন-যে ব্যক্তি ধীরভাবে অপেক্ষা করে, সে-ই সফল হতে পারে। বস্তুত কত কাল অপেক্ষা করতে হবে, তা কে জানে? আশায় বুক বেঁধে খোদাকে ভরসা করে কাজ করতে থাক, তুমি সফল হবে।
সাধনাকে আনন্দ দিয়ে পূর্ণ করে তোল। কবে তুমি কৃতকার্য হবে, সে কথা ভেবো না। তাহলে সাধনায় ক্লান্তি আসবে। ব্যর্থতা তোমাকে ভেঙ্গে দেবে, আনন্দ ভরা, সাধনা-নিয়ত ফল সম্বন্ধে উদাসীন তোমার মন ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে তোমার গন্তব্য স্থানে নিয়ে যাবে। শুভ প্ৰভাতে দেখতে পাবে, তোমার মাথা বিজয়-মুকুট শোভিত হয়েছে। তুমি নিজেই জয়ে বিস্মিত হবে।
আশাশূন্য ও নিরানন্দ মনে কোন কাজ করো না। পাদরী উইলিয়ম ক্যারি যেমন উদ্যমশীল কমী পুরুষ ছিলেন, তেমনি তিনি তার কর্ম সম্বন্ধে আশা ও বিশ্বাস পোষণ করতেন। শ্ৰীীরামপুর কলেজ তাঁরই চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
এক সময় এই বরেণ্য পুরুষকে এক ব্যক্তি মুচির ছেলে বলে উপহাস করেছিল। ক্যারি কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে উত্তর করলেন–এতে আমার একটু লজা নেই।
ছোটকালে একবার তিনি এক গাছে উঠতে যেয়ে পা ফসকে পড়ে যান। ফলে একখানা পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে বিছানা থেকে উঠে পুনরায় সেই গাছে উঠলেন, তবে ছাড়লেন। এইখানেই মহাপুরুষদের জীবনের বিশেষত্ব!
দার্শনিক ইয়ং বলতেন, মানুষ যা করেছে, মানুষ তা পারবে। এর সম্বন্ধে একটা মজার গল্প আছে। একবার তিনি এক বন্ধুর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে তিনি কখনো ঘোড়ায় চড়েননি, সেইবার প্রথম। বন্ধু খুব ভাল ঘোড়সোয়ার, তিনি অবাধে একটি উচু বেড়া পার হয়ে গেলেন। ইয়ং-এরও ইচ্ছা! হলো, বেড়া টপকে যান। যে কোনকালে ঘোড়ায় চড়েনি, তার পক্ষে কাজটা সহজ নয়। লাফ দিতে গিয়ে ঘোড়া হতে পড়ে গেলেন। ক্ষুন্ন না হয়ে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করলেন। এবারে ঘোড়া থেকে পড়লেন না ঠিক, কিন্তু ঘোড়ার গলা জড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আবার চেষ্টা। এবার কৃতকার্য হলেন।
বিশ বছর পরিশ্রম করে নিউটন একখানি বই লেখেন। তাঁর প্রিয় কুকুর একটা জ্বলন্ত বাতি ফেলে এই বইখানি মুহুর্তের মধ্যে ছাই করে দিয়েছিল। বিশ বছরের পরিশ্রমজাত-চিন্তা হঠাৎ সর্বনাশ হয়ে গেল। নিউটনের খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য সহিষ্ণুতা! তিনি দমলেন না। আবার সেই বই লেখা আরম্ভ করলেন এবং শেষ করলেন।
কারলাইল ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাস লিখে এক প্রতিবেশী সাহিত্যিককে পড়তে দেন। বন্ধু মহোদয় বইখানি ভুলবশত বাইরেই ফেলে রাখেন। ফলে বইখানি হারিয়ে গেল। অনুসন্ধানে জানা গেল বাড়ীর চাকরাণী বাজে কাগজ মনে করে সেই মূল্যবান গ্ৰন্থখানি পুড়িয়ে ফেলেছে।
কারলাইল যখন এই ভয়ানক সংবাদ শুনলেন, তখন তার মানসিক অবস্থা কি তা অনুমানসাপেক্ষ।
এই পুস্তক নতুন করে লিখতে কারলাইলকে কত কষ্ট পেতে হয়েছিল, তা বলা যায় না। না লিখে উপায় ছিল না। কঠিন অধ্যবসায়, ধীরতা এবং মনের বলে তিনি আবার সেই বই লিখলেন। কারলাইলের এই ধীরতা ও মনের বল যারপরনাই বিস্ময়াবহ। জর্জ স্টিফেনসন তাঁর ছেলেদিগকে বলতেন– তোমাদিগকে কি বলবো–আমাকে অনুসরণ করো-আঘাতের পর আঘাত করো!