সংসার-যাত্রা নির্বাহের জন্য যত প্রকার কাজ শেখা সম্ভব, সে সব শিখে রাখায় আদৌ অমর্যাদা নাই। সত্য ও মনুষ্যত্বের উপরই তোমার মর্যাদার ভিত্তিএকথা সব সময়ে যেন তোমার মনে থাকে। সংসারে চিন্তাশূন্য ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে দেখে ভয় পেয়ে না। অপেক্ষা কর, মানুষ শেষে তোমাকেই অনুকরণ করবে।
১৩. কথার মূল্য— প্ৰতিজ্ঞা রক্ষা
মানুষের কথার যে একটা মূল্য আছে। এ কথা যথার্থ ভদ্রলোক ছাড়া তা আর কেউ ঠিক অনুভব করতে পারে না। তুমি কতখানি ভদ্রলোক তা তোমার বাক্যের মূল্য হতে বোঝা যাবে।
শ্ৰীরামের মতো পিতৃ-সত্য রক্ষা করবার জন্যে তুমি বনে না যেতে পার কিন্তু প্রতিদিনকার জীবনে তুমি কি তোমার ছোট ছোট বাক্যের মূল্যগুলি রক্ষা করতে পার না? তুমি কোন ভদ্রলোককে কথা দিয়েছ। আগামীকল্য ২টার সময় তার সঙ্গে দেখা করবে— ঠিক সেই সময় তোমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে হবে, কেননা তুমি ভদ্রলোক, তোমার কথার একটা মৰ্যাদা আছে।
মুখ দিয়ে বলেছ, পাওনাদারকে অমুক দিন টাকা দেবে, সে ব্যক্তি দিনের পর দিন শুষ্ক-মুখে তোমার কৃপাপ্ৰাখী হয়ে দুয়ারে এসে ঘুরে যাচ্ছে, তুমি নিত্যনতুন প্ৰতিজ্ঞা করছে, তোমার মতো ভণ্ড কাপুরুষ আর নাই। যদি নিতান্ত রিক্তহস্ত হয়ে থাক, প্ৰকাশ্যভাবে তোমার কথা সাধারণের কাছে ঘোষণা কর, পাওনাদার যত ছোটই হোক, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। সে তোমার কিছু করতে পারবে না। তা সত্য। অন্তত মানুষ। শুধু জানতে চায়—তুমি মিথ্যাবাদী নও।
সভ্য জাতি শুধু অট্টালিকা ও অর্থে হয় না। অট্টালিকা ও ধন-সম্পদের সঙ্গে আর একটা বড় জিনিস সভ্যতার পরিচয়, সেটি বাক্যের মূল্য।
যে বাক্যের মর্যাদা তুমি রক্ষা করতে পারবে না, সেরূপ কথা তুমি বলো না। কখনও জিহবার অমর্যাদা করো না। এর মতো কাপুরুষতা আর নাই।
যে সমস্ত কথায় অন্যায়ের সংস্রব আছে, সে সব কথা খুব কম বলাই ভাল—এর চেয়ে বাচালতা বরং উত্তম। বাচাল নিজে মূল্যহীন লোক, নিজের ক্ষতি সে নিজে করে। মিথ্যাবাদী, জিহবার অবমাননাকারীর মতো সে সমাজের সঙ্গে প্রতারণা করে না।
এক ইংরেজ ভদ্রলোককে এক দসু্যু বন্দী করেছিল। ইংরেজ পুরুষটি। দসু্যর দয়া ভিক্ষা করলে দসু্যু বললো— যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করেন, যদি সরকারকে আমাদের সন্ধান না বলে দেন, তাহলে আপনাকে আপনার বাড়ীতে দিয়ে আসতে পারি। প্ৰত্যেক বন্দীকে হত্যা করাই আমাদের নিয়ম। সাহেব প্ৰতিজ্ঞা করলেন। কখনও তিনি দাসুর অনিষ্ট সাধন করবেন না। দসু্য ইংরেজকে নিয়ে রাত্রে তার বাড়ীতে উপস্থিত হলেন। ইংরেজ পুরুষটি গোপনে পুলিশকে সংবাদ দিয়ে দৗসুকে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, দসু্যু সঙ্গে প্ৰতিজ্ঞার কোন মূল্য নাই।
সাহেব কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছিলেন নিশ্চয়। কথার মর্যাদা তোমার রাখতেই হবে। সকল দেশের জ্ঞানী ব্যক্তিগণ তাই অল্প কথা বলেন, অল্প প্ৰতিজ্ঞা করেন-কাজ করেন। অনেক।
১৪. উত্তপ্ত স্বভাব
অসহিষ্ণু হয়ে কথার উত্তর দেয়া, সামান্য কারণে উগ্র হয়ে উঠা বর্বর জাতির লক্ষণ। অতীত সভ্যতা, পুথি-লিখিত জ্ঞান-গৌরবের ভণ্ডামি কি উপকারে আসবে, যদি না প্রতিদিন জীবনের সর্ব কাজে মাধুরী, বিনয়, ভদ্রতা ফুটিয়ে তুলতে পারি?
আবার বলি—সহজে স্বভাবের ধীরতা নষ্ট করা, নিষ্ঠুর কথার উত্তরে ততোধিক নিষ্ঠুর কথা ব্যবহার করা, ভদ্রতা নয়, শান্ত হও। হত্যা করবার জন্য যে হস্ত উত্তোলিত হয়েছে, একবার নামাও, আবার চিন্তা কর।
বিরুদ্ধ মত শুনে যে উগ্র হয়ে উঠে-অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে, ক্ষমতা থাকলে প্রতিদ্বন্দীকে হত্যা করতে কুষ্ঠিত হয় না—সে বড় অসভ্য ও বর্বর।
যে জাতি মানুষের উপর অসহিষ্ণু শাসনের ব্যবস্থা করে, সে জাতির স্থান নিম্নে হবেই।
কি পল্লীগ্রামে, কি উচ্চ সমাজে, কখনও স্বভাবকে বলগামুক্ত করো না—সাবধান!
নিষ্ঠুর কথা বলতে, চোখ দুটিকে ক্ৰোধে খাড়া করে তুলতে কি তোমার লজা হয় না-এ যে নিম্নস্তরের লোকের কাজ!
যে জাতি সভ্য ও ভদ্রভাবে কথা বলতে জানে না, তারা অতি নীচ। তারা চিরকালই মানুষের মনুষ্যত্বের অশ্রদ্ধা লাভ করে।
প্রতি কাজে মানুষের কর্মজীবন ও উপাসনার পরিচয় পাওয়া যায়! এ তুমি বিশ্বাস করো।
যুবক বয়সে পরের দৃষ্টির উপর নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে প্ৰাণের খুবই একটা লোভ জন্মে। —নিজের মহিমা ও মর্যাদা চারিদিকে পাত্ৰেঅপাত্রে ছড়িয়ে দেবার জন্যে মন সর্বদা সজাগ থাকে। আত্মার এই নীচ আকাজক্ষাকে সবলে চুৰ্ণ করে দিতে হবে।
যে সহিষ্ণু ও ধীর হতে শেখে নাই, তার ধাৰ্মিক লোক হবার কোন অধিকার নাই।
তুমি দোকানদার, তোমার কাছে ক্রেতা জিনিস কিনতে এসেছে-ক্রেতা যতই বিরক্ত করুক না কেন, কখনও অসহিষ্ণু হয়ে তার প্রতি ইতর ভাষা প্রয়োগ করো না, যদি তা কর তাহলে বুঝবো তুমি একটা কাপুরুষ। একটা বিরুদ্ধ কথা শোনা মাত্রই উগ্র হয়ে উঠো না, একটু অপমানে স্বভাবকে উত্তপ্ত করে তুলো না— অপেক্ষা কর, ধৈর্য অবলম্বন করা-তোমার বিনয়ের জয় আসছে।
১৫. আদর্শ–জীবন্ত আদর্শ
যা দেখি তাই করি। —যা শুনি তা করতে মন চায় না। কতকাল ধরে বইয়ে পড়ে আসছি, মিথ্যা কথা বলে না— তবুও তো এ বদভ্যাস গেল না। এটা যে বদভ্যাস তাও কোনদিন চিন্তা করি না।
একটা বালক তার মাকে দোষারোপ করেছিল— তুমি মিথ্যা বলছো, মিথ্যা বলছে। মা ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠলেন—আমি এতো ছোট, মিথ্যা বলবো? বালক মায়ের ঘৃণাব্যঞ্জক মুখখানি দেখে ভােবল মিথ্যা তাহলে কত ছোট।