প্ৰত্যেক দেশের সাহিত্যের ভিতর দিয়ে এইসব শিক্ষিত শ্রেণী জাতিকে উর্ধের্ব টেনে তোলেন। ক্ষুধাতুর আর্ত তাদের স্পর্শে রাজা হয়ে ওঠে, পল্লীর কৃষক, দূর অজ্ঞাত-কুটিরের ভিখারী, জমিদারের ভৃত্য, দরিদ্র গো-যান-চালক, অন্ধকারের পাপী, বাজারের দরজী, নগরের ঘড়ি নির্মাতা, নবাবের ভৃত্য, গ্ৰাম্য উরুটে যুবক শ্ৰেণী তাঁদেরই মন্ত্রে মহাপুরুষ হয়। এই মন্ত্র গ্রহণ করবার উপযোগী তাদের কিছু শক্তি-অর্থাৎ কিছু বর্ণ জ্ঞান থাকা চাই। এরাই জাতির মেরুদণ্ড-ছােট বলে এদিগকে অস্বীকার করলে জাতি প্ৰাণ-শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
জাতিকে শক্তিশালী, শ্রেষ্ঠ, ধনসম্পদশালী, উন্নত ও সাধারণের মধ্যে সমভাবে বিতরণ করতে হবে। দেশে সরল ও কঠিন ভাষায় নানা প্রকারের পুস্তক প্রচার করলে এই কার্য সিদ্ধ হয়। শক্তিশালী দৃষ্টিসম্পন্ন মহাপুরুষদের লেখনীর প্রভাবে একটা জাতির মানসিক ও পার্থিব পরিবর্তন অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে সংশোধিত হয়ে থাকে। দেশের প্রত্যেক মানুষ তার ভুল ও কুসংস্কার, অন্ধতা ও জড়তা, হীনতা ও সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে একটা বিনয়হিমোজুল উচ্চ জীবনের ধারণা করতে শেখে। মনুষ্যত্ব ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করাই সে ধর্ম মনে করে, আত্মমর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন হয় এবং গভীর পুষ্টি লাভ করে। তারপর বিরাট শক্তি জেগে উঠে।
ইংরাজের বিরাট শক্তির অন্তরালে বহু লেখকের লেখনী শক্তি আছে। বস্তুত লেখক বা জগতের পণ্ডিতবৃন্দ নিভৃতে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে বিশ্বের সকল অনুষ্ঠান ও কামকেন্দ্রে গতি প্ৰদান করেন। তাদের অজানা হস্তের কার্যফলে অসংখ্য মানুষ মরুভুমে সাগর রচনা করেন, সাগরবক্ষে পাহাড় তোলেনজগৎ সভ্যতার নির্মাতা তাঁরাই।
কোন দেশের মানুষ যদি এই লেখকশ্রেণীর বা দেশীয় সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ না করে তবে তারা বড় হীন। জাতির ভিতরকার সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর-সমস্ত জাতিটা শক্তিহীন হয়ে পড়বে।
কোন সভ্য জাতিকে অসভ্য করবার ইচ্ছা যদি তোমার থাকে তাহলে তাদের বইগুলি ধ্বংস কর, সকল পণ্ডিতকে হত্যা কর, তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।
লেখক, সাহিত্যিক ও পণ্ডিতরাই জাতির আত্মা। এই আত্মাকে যারা অবহেলা করে, তারা বাঁচে না।
দেশকে বা জাতিকে উন্নত করতে ইচ্ছা করলে, সাহিত্যের সাহায্যেই তা করতে হবে। মানব মঙ্গলের জন্য যত অনুষ্ঠান আছে, তার মধ্যে এইটিই প্রধান ও সম্পূর্ণ। জাতির ভিতর সাহিত্যের ধারা সৃষ্টি কর, আর কিছুর আবশ্যক নাই। কোন দেশকে সভ্য ও মানুষ করবার বাসনা তোমার আছে? তাহলে বিধি-ব্যবস্থার সঙ্গে সেই দেশের সাহিত্যকে উন্নত করতে তুমি চেষ্টা কর। মাতৃভাষার সাহায্যে সাহিত্যকে উন্নত করতে চেষ্টা করতে হবে। বিদেশী সাহিত্যে মানব সাধারণের কোন কল্যাণ হয় না। দেশীয় সাহিত্যকে উন্নত করতে হবে, আবার বিশ্বের উন্নত সাহিত্যের সার সংগ্ৰহ করতে হবে। নিজেদের যা কিছু আছে তাতেই সস্তুষ্ট থাকলে জাতির উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
পারে। মানুষের সকল বিপদের মীমাংসা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই হয়ে থাকে।
জাতি যখন দৃষ্টিসম্পন্ন ও জ্ঞানী হয়, তখন জগবার জন্য সে কারো আহবানের অপেক্ষা করে না, কারণ, জাগরণই তার স্বভাব।
০২. ব্যক্তিত্ব ও শক্তির সফলতা
যে যেখানেই থাক, নিজের বলে বড় ও উন্নত হতে চেষ্টা করা। জীবনের সকল অবস্থায় নিজকে বড় করে তোলা যায়-এ তুমি বিশ্বাস করা।
জাতীয়তা ও স্বাধীনতার কথা ভাববার আগে তুমি নিজকে মানুষ করো। মানুষের ব্যক্তিত্বের উন্নতি ও মার্জিত-বিকাশ ছাড়া স্বাধীনতা আর কিছুই নয়। এক ব্যক্তি বলেছেন-স্বাধীনতা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেশের এক একটা মানুষের আত্মোন্নতির কথা মনে না করে আমি থাকতে পারি না।
তুমি তোমার ব্যক্তিত্ত্বকে দৃঢ় করে তোল। কেউ তোমার উপর অন্যায় আধিপত্য করতে পারে না– একথা দার্শনিক মিল বলেছেন।
তুমি যদি নিজের ক্ষতি নিজে কর, অজ্ঞতা ও পাপে নিজের উপর অত্যাচার আরম্ভ করো, তাহলে কে তোমাকে বড় করবে? তুমি কাজ করাতোমার বন্ধু তুমি-হীন নও। তোমার ভিতরে যে শক্তি আছে, সেই শক্তির চর্চা তুমি কর, তুমি মহামানুষ হতে পারবে।
তুমি ছোট বংশে জন্মগ্রহণ করেছ বলে তোমায় যে ছোট করে রাখতে চায়-সে। বড় ছোট। তুমি মানুষ, তোমার ভিতরে আত্মা আছে, ইহাই যথেষ্ট। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট নাও।
খুব বড় বড় রাজরাজড়ারাই যে জগতে কীর্তি রেখে যাবে, এমন কোন কথা নয়। শিক্ষা শুধু ভদ্রনামধারী একশ্রেণীর জীবের জন্য নয়। বস্তুত ভদ্রবেশী বলে কোন কথা নাই। ক্ষুদ্র, ছোট এবং নগণ্য যারা তারাও ভদ্র হতে পারেতাদেরও শক্তি আছে, একথা তারা বিশ্বাস করুক।
শিক্ষা, জ্ঞানালোচনা, চরিত্র ও পরিশ্রমের দ্বারা দরিদ্র মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র তুমি হতে পার। যে অবস্থায় থাক না কেন-জ্ঞান অর্জন করু, পরিশ্রমী হও। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তুমি ব্যবসায়ী, তুমি সামান্য দরজী, তুমি পৃথিবীর এক কোণে পড়ে আছ—তুমি যদি সাধু ও চরিত্রবান হও, সেই অবস্থায় মনের দীনতা ও মূর্থিতা দূর করতে একটু একটু পড় ও বড় বড় লোকদের উপদেশাবলী ও জ্ঞানের কথা আলোচনা কর, দেখতে পাবে, দিন দিন তোমার সকল দিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে-তোমার সম্মান, তোমার অর্থ সবই বেড়ে যাচ্ছে।
মেহের উল্লাহ যশোহর জেলার সামান্য দরজী ছিলেন।