চরিত্রকে উন্নত করো—মিথ্যা, নীচতা, অন্যায় পরের ভাবের প্রতি অশ্রদ্ধা ও ঔদাসীন্য, অসভ্যতা, স্বার্থপরতা যাবে; ধাৰ্মিক ও সাধক কোন আশ্চর্য জীব নয়।
নীচ, স্বার্থপর, মুখ, চোর, পরের সুখ ও পয়সা অপহরণকারী, ঘুষখোর উপাসনা ও উপবাস করুক তাতে কোন লাভ নাই। পরমেশ্বর তোমাদের ভোলেন। না-তিনি চান। সত্য প্ৰাণ, তিনি চান মানুষ। শুধু উপাসনা করে মানুষ মুক্তি পাবে না। তাকে কমী ও পরদুঃখকাতর, জ্ঞানী ও দৃষ্টিসম্পন্ন, চিস্তাশীল ও যুক্তিবাদী মনুষ্যত্বসম্পন্ন এবং ন্যায়নিষ্ঠ হতে হবে। সে কখনও অন্ধের মতো ধর্ম পালন করবে না। পিতা রৌদ্রের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে নিষেধ করছেন-পিতৃআজ্ঞা লঙ্ঘন ভয়ে সুবোধ বালকের মতো অগ্নিদগ্ধ ঘরখানিকে রক্ষা করতে সঙ্কুচিত হয়ো না। আত্মার এই জ্ঞান মৃত্যু-জাতির পক্ষে সর্বনাশের কথা।
মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তার ভিতর অজেয় পুণ্যশক্তির আবির্ভাব হয়। সে শক্তিকে দমিয়ে রাখা একেবারেই অসম্ভব। জাতির প্রত্যেক মানুষ যখন চরিত্রবান হয়, তখন তাদের শক্তি হয় অসাধারণ। দুর্জয় শক্তির আধারই চরিত্র। কখনো ভেবো না— মুখতার সঙ্গে চরিত্রের কোন যোগ আছে। লোকটি মুর্থ হলেও তার চরিত্র ভাল, একথা বলার কোন অর্থ নাই। মূর্থের আবার চরিত্র কি? নিরক্ষার মানুষের ভিতর যদি চরিত্রবান লোক দেখতে পাও, তাহলে মনে করো পুঁথির বিদ্যা সে পায় নাই— কিন্তু বিদ্যার উদ্দেশ্য যা, তা তার লাভ হয়েছে। না পড়েও সে বড়।
মুসলিম জাতি চরিত্রবলেই বড় হয়েছিল; এখন সে চরিত্রহীন— তাই সে নিম্নাসন গ্রহণ করছে। জ্ঞান, মনুষ্যত্ব, দৃষ্টি এসব গুণ যখন জাতির ভিতর দেখতে পাই তখনই তাকে বলি সভ্য ও বড়। পতিত জাতির সভ্যতা বিস্তারের অর্থ, মানুষকে উচ্চত্রজীবনে দীক্ষিত করা, উন্নতভাবে ভাবকরা–মানুষকে উদার চরিত্রবান ন্যায়ের সেবক করে তোলা।
১২. শারীরিক পরিশ্রম
এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক চমৎকার ঘর তৈরী করতে পারতেন। এক সাহেবকে জানতাম, তিনি চেয়ার বেঞ্চ তৈরী করতে পারতেন।
সংসারের কাজগুলি যদি তুমি নিজের হাতে তৈরী করতে শেখ, তাহলে তোমার জীবনের গুণ বেড়ে যাবে।
হাতের কাজে যে অগৌরব নাই, এ আর বারে বারে বলে। লাভ কি? আগৌরব হয় মিথ্যায়। আর নীচতায়।
এক ব্যক্তি একদিন আমার কাছে গৌরব করে বলেছেন-আমি কোন দিন বাজারে যাই না। তিনি যে একজন অপদাৰ্থ ব্যক্তি, একথা তোমাকে বলে রাখছি।
বেড়ার বাঁধন ও ঘর ছাঁইতে জানা, ঝাড়ন, ঝাটা বঁধতে পারা, এসব জীবনের গুণ। কাজ জান না বলে তুমি যদি গৌরব কর, তাহলে বলবো তুমি একটা মুর্থ। সম্মান হয় কিসে? জ্ঞান, চরিত্র ও মনুষ্যত্ত্বে। সংসারের কাজ না জানার মধ্যে সম্মান নাই।
তুমি রান্না করতে জান না-তোমাকে কি সেজন্য বাহাদুর বলা হবে? তোমাকে কি বলা হবে-তোমার মতো ভদ্রলোক আর নাই?
তোমার অবস্থা খারাপ—তুমি সাধু, তুমি মহৎ, তুমি জ্ঞানী, তুমি সংসারের কাজ করতে লজা বোধ করা না-আমি তোমাকে হীন মনে করি না।
কোন এক স্কুলের ছাত্র ডিসেম্বর মাসে ধান কেটে যে পয়সা পেতো তা গরীব ছাত্ৰাদিগকে দান করতো। এ দৃষ্টান্ত কি খুব মহৎ নয়?
গ্রামের ভিতর এক দুঃখীর ঘর দিয়ে বর্ষার জল পড়ে—আহা! কি কষ্ট। তোমরা দশজন মিলে তার ঘরখানা যদি সেরে দাও, তাহলে তোমাদের সম্মান কমে যাবে না। কিন্তু তোমাদের সে দক্ষতা ও হৃদয়বল নাই।
মানুষকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করা কি সব সময়ে সম্ভব? যদিও মৌখিক সহানুভূতির মূল্য এক পয়সা নয়।
মহৎ হতে চেষ্টা কর, অপদাৰ্থ মানুষকে অনুকরণ করে নিজের মনুষ্যত্বকে হীন করো না। শুধু অর্থ ও দালানের সামনে মাথা যেন নত না হয়।
একটা গল্প আছে, নবাবকে বন্দী করতে শক্ৰ আসছে, জুতো পরানোর লোক নাই বলে তিনি পালাতে পারলেন না। এই নবাবকে তুমি কি মনে করা?
একবার শুনেছিলাম, পঞ্চাশ-ষাটজন স্কুলের ছেলে কোদাল-কুড়ি নিয়ে একটা জলের খাল কাটছে। এ কথা যখনই আমি ভাবি, তখনই মনে আমার প্রভূত আনন্দের সঞ্চার হয়। জনৈক মহৎ প্ৰাণ ব্যক্তিকে কলকাতার কুলী-মজুর শ্রেণীর লোকের কাছে সুই, সুতা, চা বেচিতে দেখেছি। স্বভাবে তাঁর কিছুমাত্র অহঙ্কার নাই— আমি এঁকে শ্রদ্ধা করি।
যখন তুমি স্কুলের বালক, তখন পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের অনেক কাজ শিখে রাখতে পার। ছোট একটা বাক্সে একটা হাতুড়ি, একটা বাটালি, একখানা করাত তোমার বইয়ের পাশে থাকলে কোন ক্ষতি নাই। বৈজ্ঞানিক নিউটন যখন বালক, তখন তার বইয়ের পাশে হাতুড়ি করাতের স্থান ছিল। পড়তে মন চায় না, হাতুড়ি নিয়ে কাজ কর। প্রতি রবিবারে তুমি বাড়ীতে যেয়ে একটু ছুতোরের কাজ শিখতে পার। তাতে তোমার সম্মানহানি হবে না।
অপদার্থ মানুষের সমালোচনাকে ভয় করবে। কারা? যারা চিরকাল ছোট হয়ে থাকবে।
তোমার বাড়ীর কাছে কামারের বাড়ী। ক্ষতি কি, যদি তুমি জেনে ফেলো কেমন করে তারা কোদাল তৈরী করে, কেমন করে পোড়ান লাল লোহার উপর হাতুড়ি পিটে তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের করে।
রান্না করতে জানা, পুকুর হতে ঘড়া ভরে জল টানতে পারায় গৌরব ছাড়া আগৌরব নাই। পত্নীর অসুখ, চাকর আসে নাই বলে না খেয়ে ভদ্রলোক সাজতে যেয়ো না।
বাবুয়ানা করে চাকর-চাকরানীর উপর রান্নার ভার দেওয়াতে মর্যাদা নাই।
দাসী না রেখে নিজে কাজ চালান যদি সম্ভব হয়, তবে তাই ভাল। যার বাড়ীতে যত দাসী, সে তত ভদ্রলোক- এই বিশ্বাস অসভ্য জাতির মাথায়ই প্ৰবেশ করে।