ছোটলোকের ভিতর অনেক সময় আমরা যে মহত্ত্ব দেখি, তাতে মন আমাদের ভাবে মুগ্ধ হয়ে যায়। পর্যটক পার্ক সাহেব এক সময়ে আফ্রিকায় অত্যন্ত ক্লান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এক গাছের তলায় বসেছিলেন। অনেক জায়গায় তিনি আশ্রয় চেয়েছিলেন, কিন্তু কেউ তাকে আশ্রয় দিয়েছিল না, তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। পার্ক নিরুপায় হয়ে ভাবছিলেন, ক্ষুধার ক্লান্তিতে অথবা বাঘ-ভালুকের হাতে তাকে সেই অজানা দেশে প্ৰাণ হারাতে হবে। এমন সময় এক দরিদ্র অসভ্য রমণী এসে তাকে বললে–আপনাকে একজন ক্লাস্ত পথিক বলে মনে হচ্ছে, আমাদের ছোট কুটিরখানিতে আপনি আসুন। দরিদ্রের আহার দিয়ে আপনাকে তুষ্ট করবো। অসহায় পর্যটক এই বর্বর রমণীর আতিথ্যে জীবন লাভ করেন।
পার্কের সঙ্গে কিছু ছিল না। গায়ের কোটে মাত্র চারটা রুপার বোতাম ছিল। বিদায় নেবার সময় তারই দুটো খুলে দিয়ে তিনি রমণীর মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বকে পুরস্কৃত করলেন।
চরিত্রবান মনুষ্যত্ত্ব-সম্পন্ন মানুষ নিজের চেয়ে পরের অভাবে বেশী অধীর হন। পরের দুঃখের কাছে নিজের দুঃখকে ঢেকে রাখতে গৌরব বোধ করেন। এক সময় এক যুবক অভাবগ্ৰস্ত হয়ে এক ভদ্রলোকের কাছে চাকরি প্রার্থনা করেন। এই ভদ্রলোকের একজন মানুষ দরকার হয়েছিল। নিয়োগকালে যুবক দেখলেন, আরও এক যুবক সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। কথায় কথায় প্রথম যুবক যখন জানতে পারলেন, তাঁর নতুন বন্ধুটির অভাব তার চেয়েও বেশী, তখন তিনি নিজের অভাবকে গোপন করে বললেন, তার চাকরির কোন দরকার নাই। শেষের যুবকটিই নিযুক্ত হলেন।
চরিত্রবান ব্যক্তি মানুষ অপেক্ষা ন্যায়কে অধিক শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। ন্যায় ও সত্যের জন্য তিনি যে কোন বিপদ মাথায় নিতে সম্মত হন। অর্থ সম্পদ, আত্মীয়-বন্ধু সব পরিত্যাগ করতে পারেন, তবু নিজের বিবেকের বাণীকে অমান্য করতে পারেন না। কাজী গিয়াস উদ্দিন সম্রাটের ভীতিকে উপহাসের চাঃেখে৷ দেখেছিলেন। রাজা চতুর্থ হেনরীর পুত্র যখন তাঁর অপরাধী বন্ধুর জন্য জজের উপর ঘুষি উঠিয়ে বললেন— জজ, আমার বন্ধুকে ছেড়ে দাও। ন্যায়পরায়ণ জজ রাজকুমারের কথায় কৰ্ণপাত করলেন না। নির্ভীকচিত্তে তিনি তার কর্মচারীকে হুকুম দিলেন-ন্যায়দণ্ড বিধানের অবমাননাকারী রাজকুমারকে জেলে নিয়ে যাও।]
নিজেকে উন্নত ও চরিত্রবান করার উপায় কি? এর জন্য সাধনা চাই। তুমি হয়তো মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্ত। কেমন করে হাসি কথার মধ্যে মিথ্যা বল, তা বুঝতে পার না। হঠাৎ যদি প্ৰতিজ্ঞা করে বাস-পরের দিন থেকে একদম মিথ্যা কথা বলবে না, প্ৰতিজ্ঞা রাখতে পারবে না।
অভ্যাস ভয়ানক জিনিস- একে হঠাৎ স্বভাব থেকে তুলে ফেলা কঠিন। মানুষ হবার সাধনাতেও তোমাকে ধীর ও সহিষ্ণু হতে হবে। সত্যবাদী হতে চাও? তাহলে ঠিক কর— সপ্তাহে অন্তত একদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। ছ’মাস ধরে নিজেকে সত্যকথা বলতে অভ্যস্ত কর, তারপর এক শুভদিনে আর একবার প্রতিজ্ঞা কর, সপ্তাহে দুদিন তুমি মিথ্যা কথা বলবে না। এক বছর পরে দেখবে, সত্যকথা বলা তোমার কাছে অনেকটা সহজ হয়ে পড়েছে। সাধনা করতে করতে এমন এক দিন আসবে তখন ইচ্ছা করেও মিথ্যা বলতে পারবে না। নিজেকে মানুষ করবার চেষ্টায় পাপ ও প্রবৃত্তির সংগ্রামে হঠাৎ জয়ী হতে কখনো ইচ্ছা করো না–তাহলে সব পণ্ড হবে।
তুমি হয়ত বড় বাচাল— পাগলের মতো বকতে অভ্যস্ত। আস্তে আস্তে অল্প কথা বলতে অভ্যাস করা। যে-কোন সৎগুণই লাভ করতে চাও না কেন, তাড়াতাড়ি করো না। হঠাৎ তুমি মহাপুরুষ হবে, এ অসম্ভব। চিত্তকে শাসনে আনা বড় ভয়ানক কথা। ধীরে ধীরে তুমি নিজেকে উন্নতির পথে টেনে তোেল। সাধনায় হতাশ হয়ে না, পুনঃপুন চেষ্টা কর, জয়ী হবে। সাধনায় অনেকবার তুমি পদম্মলিত হবে-কিন্তু ভয় পেয়ো না।
তোমার লোভ প্রবৃত্তিই খুব প্রবল অন্যের চেয়ে নিজের ভাগটাই তুমি বড় করে চাও। তাহলে এক কাজ কর-বড় খুঁয়ে ছোটকে গ্ৰহণ করতে চেষ্টা কর। লোভকে জয় করবার আর একটা পন্থা আছে। কোন প্রিয় জিনিসের খানিকটা না খেয়ে কোন শিশু, পশু-পক্ষী বা কুকুরকে দিতে অভ্যাস করবে। মাঝে মাঝে এই করো, তাহলে শুধু লোভ-প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে আসবে তা নয়, পরের সুখের জন্য নিজের কষ্ট স্বীকার করবার অভ্যাসও হবে। সাধনা ছাড়া চিত্তের উন্নতি স্বভাবের মহত্ত্ব লাভ করা যায় না। পরকে সুখ দিতে মন যখন বিরক্ত হবে না, তখনই তো তুমি মহাপুরুষ। এই ধরনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাধনা ও জয়ের উপর বড় বড় জয়ের ভিত্তি-এ যেন মনে থাকে।
মানুষ এক গালে চড় দিলে আর এক গাল ফিরিয়ে দেবে, এ আমি বলি না। যতটুকু ত্যাগ স্বীকার ভদ্রলোকদের পক্ষে সম্ভব, সেরূপ ত্যাগ স্বীকার করতে তুমি কখনও কুষ্ঠিত হয়ে না। শুধু ধৌত জামা পরে ও ইটের ঘরে মানুষকে নীচে বসিয়ে, তুমি ভদ্রলোক হতে চেষ্টা করো না। ভদ্রলোক হবার আরও পথ আছে।
ধীরে ধীরে আত্মাকে উন্নত করতে হবে। চিস্তা ও দৃষ্টির সাহায্যে তোমার সকল দোষ হতে তুমি মুক্ত হও। গুরুর আশীর্বাদ ও অনুগ্রহের কোন মূল্য নাই। তুমি তোমার শ্ৰেষ্ঠ গুরু। গুরু মানুষকে মুক্তি দেন না। মুক্তির মালিক তুমি— এ যদি না মানো, তাহলে বুঝবো তোমার আত্মার মৃত্যু হয়েছে। জাতি যখন অন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা গুরুর নাম বেশী নেয়। নিজের আত্মাকে একেবারে অস্বীকার করে।