তুমি চরিত্রবান হবে। জীবনের সকল লক্ষ্যের উপর হবে তোমার লক্ষ্যচরিত্রবান হবার দিকে। নিজের মনকে শাসন করবার দিকে, মিথ্যা ও পাপের বিরুদ্ধে আত্মাকে বিদ্রোহ করে তোেলবার দিকে, মানুষের মহত্ত্বই এইস্থানে। এছাড়া পৃথিবীতে আর কি আছে, যার জন্য মানুষের জীবনের আবশ্যকতাও হতে পারে?
টাকা-কড়ি, অর্থ-সম্পদ জীবনের উদ্দেশ্য নয়। অন্যায় ও মিথ্যার উপর যে সম্পদের ভিত্তি সে অর্থ তুমি ঘৃণায় বন-জঙ্গলে ফেলে দাও-আঁখি তোমার সেখানে ক্ৰোধে রক্তময় হোক।
চরিত্রবানই সম্মানী। সে-ই মানুষের শ্রদ্ধার পাত্ৰ-সে ভদ্রলোক, জ্ঞানী, কমী, সত্যবাদী মানুষই ভদ্রলোক আর কেহ নয়।
বাড়ীতে দালান মানুষকে অপমান করে, তুমি তোমার গৌরব প্রচার করা। তোমার বাপ নবাবী আমলে বিচারক (কাষী) ছিলেন। সেই খাতিরে তুমি নিজেকে ভদ্রলোক বলতে পার না।
তুমি কি সত্যনিষ্ঠ? তুমি কি মানুষের নিন্দা করতে ঘৃণা বোধ করা? তুমি কি আত্মাকে কলঙ্কিত করতে লজ্জা বোধ করা। তুমি অন্যায়ের শক্র? তুমি নিত্যনতুন জ্ঞান লাভ করতে সচেষ্ট? মানুষের সঙ্গে তোমার ব্যবহার সদাই মধুর। নিজে যা, তাই হয়ে প্রকাশ হতে তোমার সঙ্কোচ হয় না? আমি তোমায় নমস্কার করি, তোমার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করতে চাই না, তোমার মহত্ত্বকে আমি শ্রদ্ধা করি।
এক যুবক একদিন এক ট্রাক চালকের হাতে একটা সিকি দিয়ে টিকিট আর দুই আনা ফেরত চাইলেন। তখন চালক তাকে দু’আনার পরিবর্তে চৌদ্দ পয়সা দিয়ে বললে, আপনি নেমে যান।
যুবক বললেন— আমি আমার হাতকে কলঙ্কিত করতে চাই না, এই নাও তোমার বাকী পয়সা। তুমি সব চুরি করো, আমি এক পয়সাও নিতে পারি না।
চরিত্রবান ব্যক্তি যে, সে এমন করে মিথ্যা ও নীচতার প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। মানুষকে ফাঁকি দিতে পেরেছ বলে নিজেকে চতুর মনে করো না। টিকিট না কিনে রেলে ভ্ৰমণ করতে সক্ষম যদি হয়ে থাক, তবে নিজেকে খুব হীনই মনে কর। গার্ড সাহেব তোমাকে দেখে নাই, কিন্তু বিবেক তোমার ভিতরে বসে তোমার এই নীচতা দেখে অবাক হয়েছে।
লোককে ফাঁকি দিয়ে পয়সা উপায় করে তুমি জানিয়ে দিয়েছ তুমি তস্কর। কর্তব্যকে অবহেলা করে নীচের মতো তুমি মানুষের পয়সা সংগ্রহ করেছ, বুঝবো তুমি নীচ। ঘুষের পয়সা দিয়ে ধর্ম উৎসব করে আত্মপ্রসাদ লাভ করছ? তোমার বিবেক ভিতর হতে হেসে বলছে, তস্করের ধর্ম কার্যের কোন মূল্য নাই।
মধ্যযুগে ইউরোপে নাইট নামে এক সম্পপ্রদায় ছিল। তারা দুস্থ ও অত্যাচারিত মানুষের সেবা করার জন্য দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতেন। পীড়িত রমণী জাতির সম্মান রক্ষার্থে তারা প্রয়োজন হলে জীবন পর্যন্ত দান করতেন। ন্যায় ও সত্য ছাড়া আর কিছু জানতেন না। দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান বাদ দিয়ে দুস্থ মানুষের দুঃখ মোচনে, চরিত্রবান ব্যক্তি নাইট ছাড়া আর কিছু নয়। চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক করে রাখা, জীবনকে সত্যপরায়ণতা, ভদ্রতা, ন্যায়বান ও নৈতিক শক্তি দিয়ে অলস্কৃত করে রাখা হোক তোমার ব্ৰত। লোভ তোমাকে তোমার সৎ পথ হতে আকর্ষণ করতে পারবে না। তোমার দুর্জয় চরিত্রবলের সম্মুখে পাপ, নীচতা ও দুর্বলতা চুৰ্ণ হয়ে যাবে, তবেই হবে তুমি খাটি ভদ্রলোক।
চরিত্র, চিন্তা ও জীবন যার উন্নত, যিনি সর্বাংশ নিৰ্মল, উচ্চ মানবতা যার লক্ষ্য, তিনিই ভদ্রলোক।
নিম্নলিখিত গল্পে একটা আশ্চর্য উন্নত চরিত্র মাহাত্ম্য প্ৰকাশ পেয়েছে। স্পেনে এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে এক সন্ধ্যায় এক ব্যক্তি এসে কাতর কণ্ঠে করতে আসছে। এখনই তারা আসবে।” ভদ্রলোক ব্যথিত অথচ ক্ষিপ্ৰকণ্ঠে বললেন— আপনি আর এক মুহুৰ্তও দেরি করবেন না। ভিতরে আসুন।
পরদিন প্ৰাতঃকালে গৃহস্বামী একটা অশ্ব আর একখানি তরবারী এনে অতিথিকে অত্যন্ত বিস্মিত করে বললেন— ভ্ৰাতঃ! এই নাও তরবারি। আর এই ঘোড়া। তোমাকে এই দণ্ডে পালাতে হবে। আমার ছেলেকে তুমি গতকাল হত্যা করেছি। তুমি বিপন্ন হয়ে আমার কাছে এসেছিলে, আমি তোমার রক্ষা ছাড়া ক্ষতি করতে পারি না। তবুও পিতা যখন আমি, আমার মধ্যে দুর্বলতা আসতে পারে— তুমি এই দণ্ডেই পালাও, প্ৰভাত হয়েছে।
চরিত্র যার উন্নত— যিনি ভদ্রলোক, যিনি বোঝেন সম্মান তার কোন জায়গায় নষ্ট হবে। তিনি সম্মানহানির ভয়ে মহত্ত্বের পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করেন না। সম্মান কোথায় এবং কিসে হয়- তাঁর ভাল করে জানা আছে। সিসিলি ও নেপলস দ্বীপের রাজা পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটা লোক একটা বোঝা সামনে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কত লোক সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল, কেউ সম্মানহানির ভয়ে বোঝাটি লোকটির মাথায় তুলে দিল না। সম্রাট নিজ হাতে বোঝাটি বেচারার মাথায় তুলে দিয়ে আত্মপ্ৰসাদ লাভ করলেন। যারা পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আর সেই নিরুপায় লোকটির দিকে উদাসীন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল, তাদেরই সম্মানহানি হয়েছিল।
ঘৰ্মাক্ত কলেবরে তোমার পার্শ্বে এসে একটি লোক দাঁড়ালো। হোক ছোট, তাকে দেখে তুমি কি উঠে দাঁড়িয়ে তোমার চেয়ারখানি ছেড়ে দেবে না? তাতেই যে তোমার মহত্ত্ব, এ তোমার মনুষ্যত্ব কি শিক্ষা দেয় নাই? ধর্ম যে মনুষ্যত্বেরই আর এক নাম।
অপরের জন্য তুমি তোমার প্রাণ দাও- আমি বলতে চাইনে। অপরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ তুমি দূর কর, অপরকে একটুখানি সুখ দাও। অপরের সঙ্গে একটুখানি মিষ্ট কথা বলা পথের অসহায় মানুষটির দিকে একটি করুণ কটাক্ষ নিক্ষেপ কর- তাহলেই অনেক হবে।