সময়ের যারা সদ্ব্যবহার করে, তারা জিতবেই। সময়ই টাকা, সময় টাকার চেয়েও বেশী। জীবনকে উন্নত করো, কাজ করো, জ্ঞান অর্জন করো। চরিত্রকে ঠিক করে বসে। থেকে না! কৃপণের মতো সময়ের কাছ থেকে তোমার পাওনা বুঝে নাও। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন নষ্ট করো, বৎসর শেষে গুণে দেখো অবহেলায় কত কত সময় নষ্ট হয়েছে।
একঘণ্টা করে মাসে কত কাজ তোমার হয়েছে। তোমার কাজ দেখে তুমি নিজেই বিস্মিত হবে। প্রতিদিন তোমার চিস্তা একখানা কাগজে বেশী নয়, দশ লাইন করে রাখি, দেখবে, বছর শেষে তুমি একখানা সুচিস্তিত চমৎকার বই লিখে ফেলেছ। জীবনের ব্যবহার করো, দেখবে মৃত্যু তোমার কীর্তির নিশান উড়িয়ে দিয়েছে। জীবন আলস্যে, বিনা কাজে কাটিয়ে দাও, মৃত্যুকালে মনে হবে জীবনে তোমার একটা মিথ্যা অভিনয় ছাড়া আর কিছু হয় নাই—একটা সীমাহীন দুঃখ ও হাহুতশের সমষ্টি। জীবনশেষে যদি বলে, জীবনে কি করলাম? কিছু হলো না”—তাতে কি লাভ হবে? কাজের প্রারম্ভে ভেবে নাও, তুমি কোন কাজের উপযোগী, জগতে কোন কাজ করবার জন্যে তুমি তৈরী হয়েছ-কোন কাজে তোমার আত্মা তৃপ্তি লাভ করে।
সাধুতা ও সত্যের ভিতর দিয়ে যেমন উন্নতি লাভ করা যায়, এমন আর কিছুতে নয়। সত্য এবং সাধুতাকে লক্ষ্য রেখে ব্যবসা করো, তোমার উন্নতি অবশ্যম্ভাবী ৷ জুয়াচুরি করে দুদিনের জন্য তুমি লাভবান হতে পারো, সে লাভ দুদিনের। জগতে যে সমস্ত মানুষ ব্যবসায়ে উন্নতি করেছেন তাদের কাজ-কামে কখনো মিথ্যা-জুয়োচুরি ছিল না। ব্যবসা ভাল কাজ-এর ভিতর অমর্যাদার কিছু নাই। আগৌরব হয়। হীন পরাধীনতায়, মিথ্যা ও অসাধুতায়।
এক ব্যক্তি মুদি জীবনের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিল। মারার আগে একখানা কাগজে লিখে রেখে গিয়েছিলো—এ ইন জীবন আমার পক্ষে অসহনীয়। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের মনে কোন দয়ার উদ্রেক হয় না। লোকটি এত হীন। ছোট ছিল যে, তার মুদি হয়ে বাঁচবার অধিকার ছিল না। কাজ-কাম বা ব্যবসাতে অগৌরব নাই। ঢাকার সুপ্ৰসিদ্ধ নবাব বংশের নাম পূর্ববঙ্গে প্ৰসিদ্ধ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলিমউল্লা ছিলেন। একজন ব্যবসায়ী। জাতির কল্যাণ হয় ব্যবসার ভিতর দিয়ে। ব্যবসাকে যে শ্ৰদ্ধার চোখে দেখে না, সে মুর্থ। ইংরেজ জাতির এই গৌরব-গরিমার এক কারণ ব্যবসা। ব্যবসা না করলে তারা এত বড় হতে পারত না।
যে জিনিস নিজে কিনলে ঠিকেছ বলে মনে হলো, সে জিনিস ক্রেতাকে কখনও দিও না। কখনও অভিজ্ঞ ক্রেতাকে ঠকিও না। হয়ত মনে হবে তোমার লোকসান হলো, কিন্তু না— অপেক্ষা কর তোমার সাধুতা ও সুনাম ছড়াতে দাও, লোকসানের দাশগুণ এতে তোমার পকেটে ভর্তি হবে।
ব্যবসার ভিতর সাধুতা রক্ষা করে কাজ করায় অনেকখানি মনুষ্যত্বের দরকার হয়। যে ব্যবসায়ী লোভ সংবরণ করে নিজের সুনামকে বাঁচিয়ে রাখে। সে কম মহত্ত্বের পরিচয় দেয় না। মিষ্ট ও সহিষ্ণু ব্যবহার, ভদ্রতা এবং অল্পলাভের ইচ্ছা তোমার ব্যবসায়ী জীবনকে সফল করবে।
চাকরি, চাকরি-অনবরত চাকরির লোভে যুবকেরা সোনার শক্তিভরা জীবনকে দুয়ারে দুয়ারে বিড়ম্বিত করে দিচ্ছে। মিস্ত্রী, কামার, দরজী এরা কি সত্যিই নিম্নস্তরের লোক? অশিক্ষিত বলেই সভ্য সমাজে এদের স্থান নাই? যা তুমি সামান্য বলে অবহেলা করছ, তা কতখানি জ্ঞান, চিন্তা ও সাধনার ফল তা কি ভেবে দেখেছি? শিক্ষিত ব্যক্তি যে কোন কাজ করুক না কেন, তার সম্মান ও অর্থ দুই-ই লাভ হবে। আত্মার অফুরন্ত শক্তিকে মানুষের কৃপাপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ করে দিও না।
১১. চরিত্র ও চরিত্র-শক্তি
রায় নরেন্দ্রনাথ সেন বলতেন, ‘এশিয়া আধ্যাত্মিকতায় ইউরোপ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ। ইউরোপ এশিয়ার কাছে আধ্যাত্মিকতা শিখুন—” এ কথার অর্থ আমি এখনও বুঝি না। জ্ঞান, চরিত্র, মনুষ্যত্ব ও কর্ম ছাড়া যদি আধ্যাতিকতা স্বতন্ত্র জিনিস হয়, তবে সে আধ্যাত্মিকতায় কোন কাজে নেই।
মানুষের মূল্য কোথায়? চরিত্র, মনুষ্যত্ত্ব ও কর্মে। বস্তুত চরিত্র বললেই মানুষের জীবনের যা কিছু শ্রেষ্ঠতা বুঝতে হবে। চরিত্র ছাড়া মানুষের গৌরব করবার আর কিছুই নাই। মানুষের শ্রদ্ধা যদি মানুষের প্রাপ্য হয়, মানুষ যদি মানুষকে শ্রদ্ধা করে তবে সে শুধু চরিত্রের জন্য। অন্য কোন কারণে মানুষের মাথা মানুষের সামনে নত হবার দরকার নাই।
জগতে যে সমস্ত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের গৌরবের মূল এই চরিত্র-শক্তি। তুমি চরিত্রবান লোক, এ কথার অর্থ এ নয় যে, তুমি লম্পট নাও। তুমি সত্যবাদী, বিনয়ী এবং জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা। তুমি পরদুঃখকাতর, ন্যায়বান এবং ন্যায্য স্বাধীনতা ও ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করতে লজা বোধ করা।
চরিত্রবান অর্থ এও নয় যে, তুমি বোকা-কারো সঙ্গে কথা বল না। মানুষের দিকে চেয়ে সাহসের সঙ্গে কথা বলতে তোমার ভয় হয়। চরিত্রবান সব সময়েই সাহসী ও নির্ভীক। মানুষ অপেক্ষা নিজের অন্তর্নিহিত সুবুদ্ধি বা বিবেককে সে বেশী ভয় করে। নিজের কাজ ও কথার উপর সে সব সময় দৃষ্টি রাখে। মানুষ তার অপরাধের কথা না জানলেও সে নিজেই তার অপরাধের জন্য লজ্জিত হয়। চরিত্রবান ব্যক্তি অত্যাচারী বা তস্করকে সম্মান দেখাতে লজা বোধ করে। সাধু সত্যবাদীই তার সম্মানের পাত্ৰ। সে সর্বদাই আত্ম-মর্যাদা জ্ঞানসম্পন্ন।