যিনি সাধু, কর্মী ও পরিশ্রমী তার উন্নতি যেমন অবশ্যম্ভাবী অন্যের তেমন নয়।
তুমি সাধু ও জ্ঞানী, তুমি দরিদ্র হয়ে থাকবে, এরূপ ইচ্ছা পোষণ করো না। তোমাকে ধনী হতে হবে, কেননা তুমি জান অর্থ কীভাবে ব্যয় করতে হয়।
অর্থাপিশাচ, নীচ, সঙ্কীর্ণ হৃদয় ব্যক্তি যদি অর্থ উপায় করে, তবে তার উপার্জনের কোন মূল্য নাই।
সৎ উদ্দেশ্যে পয়সা উপায় করা উপাসনারাই তুল্য। সত্য কথা বলতে কি, ইহা শ্রেষ্ঠ উপাসনা।
মানুষের কল্যাণ করবে কি দিয়ে? পয়সা কই?
খোদার নামে পয়সা উপায় করা। তুমি শ্ৰেষ্ঠ সাধকের অন্যতম হবে। স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণ করার জন্যও পয়সা চাই। সংসারে বাস করে পরিবারের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানো তোমার কর্তব্য, তা না করলে তুমি অন্যায় করবে।
পয়সাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখো। চিন্তাশীল জ্ঞানী ব্যক্তিরা পয়সাকে অশ্রদ্ধার চোখে দেখেন না।
পয়সার প্রতি মমতাহীন হয়ে বেহিসাবীর মত খরচ করলে বুদ্ধি ও ধর্ম নষ্ট হয়। পয়সাকে ঘৃণা করো না। পয়সার প্রতি অন্যায় মমতা পোষণ করে নিজেকে হীন করো না।
বিবেচক ও মিতব্যয়ী ব্যক্তি হিসেবী না হয়ে পারে না। তিনি ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবেন। বর্তমানে ছোট ছোট আরাম ও সুখ ভোগের ইচ্ছগুলিকে দমিয়ে রেখে তিনি সামনের শীতের দিনের কথা চিন্তা করেন।
যে সমস্ত মানুষ বেহিসেবী হয়ে রসনাকে সংযত করতে জানে না, মূর্থের মতো যত খেয়াল চাপে আর খরচ করে, তারা মনুষ্যত্বের অবমাননা করে।
দুঃখের পর সুখ, অশান্তি ও বেদনা তাদের জীবনের অনেক শক্তি নষ্ট করে দেয়।
মানুষ যদি একটু বুঝে সুঝে খরচ করে, তাহলে তার দুঃখ অনেকটা কমে যায়। মানুষ নিজের দুঃখ রচনা করে-নিজেকে নিজে দরিদ্র করে।
অভাবগ্ৰস্ত যে তার চিত্তে স্বাধীনতা থাকে না। তুমি মিতব্যয়ী হও, তোমার মনের স্বাধীনতা বেড়ে যাবে।
সোজা কথা নয়। এজন্য কম সাধনা আবশ্যক হয় না। অনেক মানুষ চরিত্রের সব ভুল দেখে আতঙ্কিত হন, কিন্তু মিতব্যয়ী হওয়া লজ্জাজনক মনে করেন না, বস্তুত সত্যবাদী হওয়া যেমন জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ কাজ, মিতব্যয়ী হওয়াও তেমনি একটি বড় কাজ।
যাদের অভাব সারে না তারা চিরকালই ছোট। দুর্ভিক্ষের দিনে তারাই আগে মরে। তুমি সমাজে আজ শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করে আছ-কিছু বাঁচাও না-যদি সহসা তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তোমার স্ত্রী-পুত্রের কি হবে? যেখানে আছ নিজের বর্তমান আর্থিক অবস্থা হতে উন্নত হতে চেষ্টা করা সব খরচ করে নিজেকে ইতর মানুষের কৃপার পাত্র করো না।
আমি বলছি না, জীবনের সুন্দর মধুর গুণগুলি বিসর্জন দিয়ে পিশাচের মতো অর্থ জমাবে। আমি বলি, নিজেকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য, চিত্তের স্বাধীনতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সতর্ক হও। সব সময়েই যদি অভাব তোমাকে ব্যস্ত করে, তাহলে তোমার মনের বল থাকবে না। নিজের ত্যাগ কর।
পৃথিবীর বড় বড় কাজ, সঞ্চয়ী লোকদের দ্বারা অথবা তাদের সাহায্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অভাবগ্ৰস্ত ব্যক্তি নিজের অভাব নিয়েই ব্যস্ত-সে সমাজের কি কাজ করবে? কোন ভাল কাজের জন্য পয়সা ব্যয় করতে কষ্টবোধ না করে সে পারে না।
একদিন সন্ধ্যাকালে দেখলাম একটা অপরিচিত রমণী হঠাৎ আমাদের ঘরের ভিতর প্রবেশ করলো। কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে বললে একজনের কাছ থেকে সে কিছু হাওলাত করেছিল, দিতে পারে নাই, রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ভয়ে সে এখানে একটু সরে দাঁড়িয়েছে।
তোমার অবস্থাও যদি এমনি হয় তবে সে কত দুঃখের হয় বল দেখি? যদি কারো নিকট হতে টাকা নিয়ে থাক-কিংবা যদি তোমার কাছে কিছু পায়, তাহলে সে যত ছোট লোকই হোক না, তার সামনে তোমার একটু সঙ্কোচ হবেই। জীবনের এই অবস্থা বড় পীড়াদায়ক, বড় বিরক্তিকর। তোমার ভিতরে যদি মনুষ্যত্ব থাকে, তাহলে নিজেকে এই লজ্জাজনক অবস্থার ভিতরে টেনে এনো না।
হাতে যদি পয়সা না থাকে তাহলে মনে মনে পরদুঃখকাতর হয়েও কোন লাভ নেই। এক ভদ্রলোক এক সময়ে তাঁর যা কিছু ছিল সব এক বিপদগ্ৰস্ত মানুষকে দিয়ে নিজেই বিপদে পড়েছিলেন।
তোমার হাতে যদি পয়সা-কড়ি কিছুই না থাকে, তবে মানুষের দুঃখের সামনে বোকার মতো তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
জীবনকে যদি স্বাধীন করতে চাও তাহলে কিছু কিছু জমাও-অল্প হলেও জমাতে থাকা হযরত মোহাম্মদ (সঃ) বাতির পলতে চিপে তেল বের করতেন, তা জান?
হযরত ঈসা (যীশু) বলেছেন-ছোট বলে ফেলে দিও না, কুড়িয়ে রাখো।
এক পয়সা বলে ঘৃণা করো না! দুটি চাল, একটা লঙ্কা নষ্ট হলে কি ক্ষতি, এ কথা ভেবো না।
সামান্য মুষ্টি চালের শক্তিতে কত বড় বড় কাজ সম্পাদিত হয়।
তোমার মিঠাই খাবার ইচ্ছা হচ্ছে, খাওয়ার আগে ভেবে দেখ; তোমার চাল কেনবার পয়সা আছে কিনা।
এক ভদ্রলোক তাঁর পুত্রের কাছে চিঠি লিখলেন, হিসেব করে খরচ করা জীবনের এক প্ৰধান গুণ। অনেক লোক টাকা-পয়সা নিয়ে হিসেব করা ভাল মনে করে না। তুমি তাদের একজন হয়ো না।
জগতে অনেক প্রতিভাশালী লোকের চরিত্রে এ-গুলি ছিল না বলে তুমি তাদের বন্দস্বভাবটি অনুকরণ করো না, তাদের যদি এই দোষ না থাকতো তাহলে তারা জগতে আরও বেশি উপকার করতে পারতেন।
তাদের সদগুণগুলি অনুসরণ না করে, তাদের বদঅভ্যাসগুলি অনুসরণ করাতে গৌরব। নাই। চাঁদে কলঙ্ক আছে বলে কে কবে নিজের দেহকে কলঙ্কিত করে?
বর্তমানের অবস্থাকে মেনে নিয়ে কষ্টে-সৃষ্ট তোমাকে দিন কাটাতে হবে। চলে না বলে সীমা অতিক্রম করো না। যে মুহূর্ত পর্যন্ত আয় না বাড়ে সে পর্যন্ত তোমাকে দরিদ্রের মতো থাকতে হবে। তুমি বর্তমান সত্যকে অবিশ্বাস করতে পার না। তোমার আয় যখন সামান্য তখন জোর করে এই সামান্য অবস্থাকে। অস্বীকার করে বেশী খরচ করলে চলবে না। বর্তমানকে সত্য বলে গ্ৰহণ করো। বর্তমানকে অসত্য মনে কর, হয় তুমি চোর না হয়। পরদিয়া প্ৰত্যাশী হবে। পরে যে পর্যন্ত দান না করে সে পর্যন্ত অন্তত তুমি নিজেও সীমার ভিতর দাঁড়িয়ে থাক।