সাধারণের অর্থ সাহায্যে উইলিয়ম চার বছর পরে নতুন জাহাজে আবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন। আগের মতই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস সমুদ্রতল অন্বেষণে কেটে যেতে লাগল। উইলিয়ম মাঝে মাঝে ভাবতে লাগলেন, তার বিশ্বাস কি মিথ্যা হলো?
হঠাৎ একদিন একজন ড়ুবুরি জলের তল থেকে উঠে বললো, একখানা জাহাজের পাটাতনের মত কি যেন আমার হাতে ঠেকেছে।
বিপুল উদ্বেগে উইলিয়ম আরও কয়েকজন ড়ুবুরি পাঠালেন। কয়েক মুহূর্তের ভিতর একজন এক খণ্ড সোনার টুকরা নিয়ে ভেসে উঠলো। উইলিয়ম আনন্দে করতালি দিয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন-ভাগ্য আমাদের ফিরেছে—আর ভয় নাই।
এত পরিশ্রম, আশা ও বিশ্বাস ব্যর্থ হলো না। উইলিয়মের অধ্যবসায় ও সাধনার মূল্যস্বরূপ কয়েকদিনেই ড়ুবোজাহাজ হতে ৪৫,০০,০০০ লক্ষ টাকা উদ্ধার হলো।
ইংলণ্ডে উইলিয়ম যখন প্ৰত্যাবর্তন করলেন তখন অনেকে সম্রাটকে বলেছিলেন—এই অর্থে উইলিয়মের কোন দাবী নাই, এসবই রাজ্যভাণ্ডারের প্ৰাপ্য। উইলিয়ম ভাল করে সব কথা সরকারকে জানিয়ে ছিল না, এই অপরাধে তার সমস্ত টাকা বাজেয়াপ্ত করা হউক।
ন্যায়নিষ্ঠ সম্রাট সে কথায় কৰ্ণপাত না করে কঠোর সাধনা ও অধ্যবসায়কে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। তিনি উইলিয়ামকে স্যার উপাধি প্ৰদান করে শ্রেষ্ঠ আভিজাত্যের গৌরব প্ৰদান করলেন।
উইলিয়ম শেষ বয়স পর্যন্ত বিনয়ী ও সরল ছিলেন। তিনি কখনো কারো কাছে তাঁর পূর্ব জীবনের ইতিহাস গোপন করতেন না। হীন বংশে তাঁর জন্ম হয়েছিলো— আত্মশক্তিতে তিনি উচ্চাসন ও বিলেতের শ্রেষ্ঠ সম্মান লাভ করেন— একথা বলতে তিনি সব সময়েই গৌরব বোধ করতেন।
উইলিয়াম পেটিট বলে এক মহাত্মার কথা জানি। তাঁর বাপের ছিল। কাপড়ের দোকান। পেটিট ফরাসী দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেখানে যেভাবে তিনি কলেজ ও নিজের ব্যয় নির্বাহ করতেন, তা শুনলে তোমাদের অনেকের মনে সাহস আসবে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ছোট ছোট মনোহারী দোকান দেখেছ? পেটিট তেমনি করে পথে পথে ফেরী করে ছাত্রজীবনের ব্যয় সংগ্ৰহ করতেন।
পড়া এক রকম শেষ হলে তিনি দেশে ফিরে এক জাহাজে চাকরি গ্ৰহণ করেন। সে কাজ তার পোষাল না।
জাহাজের কাপ্তান তাঁকে একদিন অপমান, এমনকি প্রহার করেন। ঘৃণায় ও লজ্জায় পেটিটি কাজ পরিত্যাগ করে পৌরী শহরে ডাক্তারী পড়তে চলে গেলেন।
পেরী শহরে এসে তার যারপরনাই কষ্ট হতে লাগিল। খালি পেট জলে ভর্তি করে অনেক সময় তাকে পড়ে থাকতে হতো।
এই দুঃখ ও অভাবের মধ্যেই অতি কষ্টে কয়েকটি টাকা সংগ্রহ করে। পেটিট আগের মতো আবার ফেরী করা আরম্ভ করলেন। ফেরী করেই তিনি ডাক্তারী পড়া শেষ করলেন।
ডাক্তারীর সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যসেবা করতে লাগলেন। ক্রমে তার শক্তি ও প্রতিভার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো-দেশের মানুষের শ্রদ্ধা। তিনি লাভ করতে আরম্ভ করলেন। নানা বিষয়ে তিনি প্ৰবন্ধ লিখতেন। চিত্তা-কখনো দর্শনের জটিল তত্ত্বে, কখনো অঙ্কশাস্ত্রে, কখনও কাপড় তৈরীর পন্থা নির্ধারণে, কখনও রং প্ৰস্তুত করবার কৌশল নির্বাচনে নিবদ্ধ থাকতেন।
ব্যবসা করে পেটিটি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এই কমী উইলিয়াম পেটিটের গুণ ও শক্তি-সাধনা সম্রাট শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেছিলেন। সম্রাট কর্তৃক উইলিয়ম শ্ৰেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
নেলসন ও ওয়েলিংটন আদৌ বনেদী ঘরের ছেলে নন-অথচ বৃটিশ জাতির পিতা তাঁরাই। বিলেতের এক লর্ড একখানা ছোট স্যাতসেঁতে গর্তের মতো ঘরের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে তাঁর ছেলেকে একদিন বলেছিলেন—ঐ ঘরখানিতে তোমার বুড়ো দাদা মানুষকে ক্ষেউরি করতেন। তোমার দাদা ছিলেন। নাপিত—আমি হয়েছি। লর্ড। শক্তি-সাধনায় মানুষ বড় হয়—এই বিশ্বাস দেবার জন্য তোমাকে এখানে এনেছি।
উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ গোখেল ছিলেন দরিদ্র সস্তান। নিজের শক্তিতে তিনি ভারত ছাড়া বিদেশেও উচ্চাসন ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন। স্যার উপাধি গ্রহণ করতে তিনি স্বীকৃত হন নাই। দরিদ্র গোখেল নিজেকে কত উচ্চ আসন দিতে পেরেছিলেন।
সম্রাট সবুক্তশীন ছিলেন ক্রীতদাস। কুতুবুদ্দীন ও পরের কতিপয় সম্রাট ছিলেন দাস। দাসের জীবন হতে হয়েছিলেন তারা সম্রাট-মানুষের মহাসেবকজগতের ধর্ম, সভ্যতা ও শান্তিরক্ষক।
০৭. কর্মে প্ৰাণযোগ্য-দৃঢ় ইচ্ছা
যে কাজই কর না, তাতে যদি কোন রকমে তোমার মন ঢেলে দিতে পারে, তাহলে আর কোন ভয় নাই। সংশয়কে মনে স্থান দিতে নাই। সংশয়ে মনের বল কমে যায়, এমন কি কার্যে সিদ্ধিলাভ হয় না।
কোন কাজ করতে ইচ্ছা করেছ। ভেবে নাও-বিশ্বাস কর—তুমি কৃতকার্য হবে-তারপর পরিশ্রম কর। তুমি নিশ্চয়ই কৃতকার্য হবে।
ফরাসী দেশে এক ব্যক্তি ঘরের ভিতর ঘুরে বেড়াতেন। আর বলতেনআমি একজন বড় যোদ্ধা হবো, তাই তিনি হয়েছিলেন।
একটি ছাত্রকে জানি-সে। কয়েক বছর আগেকার কথা। তিনি পড়তে বসেছিলেন, গায়ে তখন জ্বর। সামনে পরীক্ষা-না পড়লেই চলবে না। পরীক্ষায় পাশ না হলে হয়ত তাকে মরতে হবে। জ্বর এসেছে, সে কথা ভুলে গিয়ে তিনি পড়তে আরম্ভ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর জ্বর চলে গেল।
এক ভদ্রলোকের অসুখ হয়েছিল—তিনি ইচ্ছা করলেন অবিলম্বে তাঁকে ভাল হতেই হবে-সত্যিই তিনি ভাল হলেন।
সম্রাট বাবরের কথা সবাই জানেন। পুত্রের ব্যাধি তিনি কেমন করে নিজের ভিতর টেনে নিলেন।