মওলানা তর্কবাগীশ, মানিক ভাই (ইত্তেফাঁকের সম্পাদক), ফজলুল হক ও আমি পাঁচশত কর্মী নিয়ে একদিন সিলেটে পৌঁছি। আমাদের জন্য সিলেটের গণভোট কমিটির কিছুই করতে হয় নাই—শুধু কোন এলাকায় কাজ করতে হবে, আমাদের সেখানে পৌঁছিয়ে দিতে হয়েছে। যাবতীয় খরচপত্রের ব্যবস্থা শহীদ সাহেব করে দিয়েছিলেন। কারো মুখাপেক্ষী আমাদের হতে হবে না। শামসুল হক সাহেব ঢাকা থেকেও বহু কর্মী নিয়ে সেখানে পৌঁছে ছিলেন। শহীদ সাহেবের অনুরোধে দানবীর রায়বাহাদুর আর. পি. সাহা হিন্দু হয়েও কয়েকখানা লঞ্চ সিলেটে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই লঞ্চগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল মুসলিম লীগ কর্মী এবং পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ, যানবাহন খুবই প্রয়োজন ছিল। শহীদ সাহেবের বন্ধু ছিলেন রায়বাহাদুর, তাঁর কথা তিনি ফেলতে পারেন নাই। রায়বাহাদুর আজও পাকিস্তানী। মির্জাপুর হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস গার্লস হাইস্কুল, কুমুদিনী কলেজ তারই দানে টিকে আছে।
২৩.
সিলেট গণভোটে জয়লাভ করে আমরা কলকাতায় ফিরে এলাম। দেখি, মুসলিম লীগের এক দল ঠিক করেছেন নাজিমুদ্দীন সাহেবকে শহীদ সাহেবের সাথে নেতা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাবেন। কেন্দ্রীয় লীগ দিল্লি থেকে হুকুম দিয়েছেন ইলেকশন করতে। জনাব আই আই চুন্দ্রিগড় কেন্দ্রীয় লীগের পক্ষ থেকে এই নির্বাচনে সভাপতিত্ব করবেন। এদিকে দু’দেশের সম্পদের ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে যে গোলমাল চলেছে, সেদিকে কারো খেয়াল নাই। নেতা নির্বাচন নিয়ে সকলেই ব্যস্ত। নাজিমুদ্দীন সাহেব নির্বাচনের সময় নমিনেশন দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন লন্ডন ও দিল্লিতে। শহীদ সাহেব সমস্ত নির্বাচনটা নিজে চালিয়েছিলেন, টাকা পয়সার বন্দোবস্ত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি একদিনের জন্যও বিশ্রাম পান নাই। কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্তদের সহায়তা দান, মুসলিম লীগের সংগঠন, দিল্লি, কলকাতা দৌড়াদৌড়ি সকল কিছুই তাঁকে করতে হয়েছিল। আর যখন পাকিস্তান কায়েম হয়েছে তখন নেতা হবার জন্য আর একজনকে আমদানি করা যে কত বড় অন্যায় সেকথা ভবিষ্যৎ বিচার করবে। শহীদ সাহেবের বিরোধীদের প্রপাগান্ডা হল তিনি পশ্চিম বাংলার লোক; তিনি কেন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবেন? শহীদ সাহেব তো কোনোদিন দুই গ্রুপ চিন্তা করেন নাই, তাই নাজিমুদ্দীন সাহেবের সমর্থকদেরও নমিনেশন দিয়েছিলেন, মন্ত্রী করেছিলেন, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি, চিফ হুইপ, স্পিকার অনেক পদই দিয়েছিলেন। এরা সকলেই তলে তলে শহীদ সাহেবের বিরুদ্ধাচরণ করছিলেন। অন্যদিকে, পশ্চিম বাংলার মুসলিম লীগ এমএলএরা ভোট দিতে পারবেন না, কারণ তারা হিন্দুস্তানে পড়ে গিয়েছেন। তার নিজের দল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে ঘরে বসে আছেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন করবেন না। হাশিম সাহেব কোনো কর্মীকে নির্দেশ দিলেন না। অনেককেই নিষেধ করে দিলেন এবং তলে তলে বলে দিলেন, শহীদ সাহেবকে সমর্থন না করতে। শহীদ সাহেবের এদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। কোন চেষ্টাই করছেন না। কাউকেই অনুরোধ করছেন না, ভোট দিতে। তাঁকে বললে, তিনি বলতেন, “ইচ্ছা হয় দিবে, না হয় না দিবে, আমি কি করব?”
শহীদ সাহেবের পক্ষে মোহাম্মদ আলী, জনাব তোফাজ্জল আলী, ডা, মালেক, মিস্টার সবুর খান, আনোয়ারা খাতুন, ফরিদপুরের বাদশা মিয়া, রংপুরের খয়রাত হোসেন কাজ করছিলেন। শহীদ সাহেবের দলের চিফ হুইপ মফিজউদ্দিন আহমেদ সাহেব গোপনে গোপনে নাজিমুদ্দীন সাহেবের দলে কাজ করছিলেন। মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদ (কুষ্টিয়া) চেষ্টা করছিলেন শহীদ সাহেবের বিপক্ষে। একমাত্র ফজলুর রহমান সাহেব—তখন মন্ত্রী ছিলেন, শহীদ সাহেবকে বলেছিলেন, তার পক্ষে নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। আমার কথাটা ভাল লেগেছিল। যা হোক, এর পরেও শহীদ সাহেবের পক্ষে ভোট বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত সিলেট জেলার সতেরজন এমএলএ কলকাতা পৌঁছাল, তারাও ভোট দিবেন। ভা, মালেক সিলেট গিয়েছিলেন, শহীদ সাহেবের পক্ষে কাজ করতে। তাকে সিলেটের এমএলএরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন শহীদ সাহেবের প্রোগ্রাম কি?
ডা. মালেক বলেছিলেন, প্রথম কাজ হবে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা। ফল হল উল্টা, তিনজন এমএলএ ছাড়া আর সকলেই ছিলেন সিলেটের জমিদার। তাঁরা ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন। হোটেল বিল্টমোরে তাঁদের রাখা হয়েছিল। আমরা এদের শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ধরে এনেছিলাম। শহীদ সাহেবের কাছে সিলেটের এমএলএরা দাবি করলেন, তিনটি মন্ত্রিত্ব দিতে হবে সিলেটে। শহীদ সাহেব বললেন, “আমি কোন ওয়াদা করি না। তাঁদের যা প্রাপ্য তাই পাবেন।” অন্যদিকে নাজিমুদ্দীনের পক্ষে ওয়াদা দেয়া হয়েছিল। দু’একজন ছাড়া সিলেটের এমএলএরা নাজিমুদ্দীন সাহেবকে ভোট দিলেন, তাতে শহীদ সাহেব পরাজিত হলেন। যেদিন নির্বাচন হবে তার পূর্বের দিন রাত দুইটার সময়–আমি তখন শহীদ সাহেবের বাড়িতে, শহীদ সাহেব বারান্দায় শুয়ে আছেন। ডা. মালেক এসে বললেন, “আমাদের অবস্থা ভাল মনে হচ্ছে না, কিছু টাকা খরচ করলে বোধহয় অবস্থা পরিবর্তন করা যেত।” শহীদ সাহেব মালেক সাহেবকে বললেন, “মালেক, পাকিস্তান হয়েছে, এর পাক ভূমিকে নাপাক করতে চাই না। টাকা আমি কাউকেও দেব না, এই অসাধু পন্থা অবলম্বন করে নেতা আমি হতে চাই না। আমার কাজ আমি করেছি।” মালেক সাহেব বললেন, “ঠিক, ঠিক বলেছেন স্যার, আমারও ঘৃণা করে।” সেইদিন থেকে শহীদ সাহেবকে আমি আরও ভালবাসতে শুরু করলাম। শহীদ সাহেব ইহজগতে নাই, তবে মালেক ভাই আজও জীবিত আছেন। আমরা তিনজনই তখন ছিলাম, আর কেউ ছিল না।