গাড়িতে বসে খাড়া পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই অনীশ ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের দেওয়া ফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। হিমালয়ান উলফ রিহ্যাবিলিটেশন ক্যাম্প বা নেকড়ে খামার-টার সম্বন্ধে নানা তথ্য দেওয়া আছে এই ফাইলটাতে। এমনকী প্রাণীগুলোর ছবি, খামার মালিক ভন ভাইমার ও তার কর্মচারীদের ছবি, সরকারি চিঠিপত্র সবই সংযোজিত আছে তার মধ্যে।
মিস্টার ভাইমার আর সরকারের মধ্যে যে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে তা দেখে অনীশ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে সরকার মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে প্রাণীগুলোকে মারার। তাই মিস্টার ভাইমার একটা শেষ চেষ্টা করেছেন ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফকে একটা চিঠি দিয়ে প্রাণীগুলোকে বাঁচাবার। আর এই চিঠিটার জন্যই কিছুটা হলেও থমকেছে সরকার। তারাও তাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগে প্রাণীগুলোর সম্বন্ধে বিশ্ব বন্য প্রাণ সংস্থার মতামত জানতে চেয়েছেন। সংস্থা তাই এদেশে তাদের সংস্থার প্রতিনিধি হিসাবে অনীশকে নেকড়ে খামারটাতে পাঠাচ্ছে সরেজমিনে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দেবার জন্য।
সরকার পক্ষকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না তেমন। হিমালয়ান মাউন্টেন উলফ বা তুষার নেকড়ে যদি মানুষ মারে তবে সে যত দুষ্প্রাপ্য প্রাণী হোক না কেন তার জীবনের দাম গ্রামবাসীদের জীবনের চেয়ে বেশি নয়। তবে সরকারি তরফে নেকড়েগুলোকে মারতে চাওয়ার পিছনে নাকি আসল কারণ অন্য। সেটা অবশ্য এ ফাইলে লেখা নেই, থাকার কথাও নয়। অনীশেরই ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে কাজ করা এক সহকর্মী খবরটা কীভাবে যেন সংগ্রহ করেছে স্থানীয় এক সেনা অফিসারের কাছ থেকে। সেই সহকর্মী অনীশকে জানিয়েছে যে ওই তুষার নেকড়েগুলোকে। নিয়ে নাকি সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আসলে সরকার এ ব্যাপারটা নিয়েই বেশি ভাবিত। কিন্তু মুখে প্রকাশ করতে পারছে না ব্যাপারটা। এ অঞ্চল দেশের অন্যতম দুর্গম ও উত্তেজনা প্রবণ সীমান্ত অঞ্চল। তাই সরকার কোনও অবস্থাতেই চায় না যে-কোনও কারণেই। এখানকার সীমান্তরক্ষীদের কাজের সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটুক।
ফাইলটা দেখছিল অনীশ। তার চিন্তাজাল ছিন্ন হল ড্রাইভার পবন বাহাদুরের কথায়– স্যার, আমরা এখন নাথুলা পাসে। প্রায় চোদ্দ হাজার ফিট ওপরে উঠে এসেছি আমরা।
ফাইল থেকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকাল অনীশ। সত্যিই অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে অনীশ। নীল আকাশের বুকে উঠে গেছে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি। তাদের বরফমোড়া কিরীটগুলো সূর্যালোকে ঝলমল করছে। নীচের ধাপের পাহাড়গুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে গিরিবর্ক্স। যে জায়গাতে গাড়িটা এসে পৌঁছেছে সে জায়গা একটু সমতল। অনেক লোকজন, ট্যুরিস্ট গাড়ির ভিড় সেখানে।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলেছে। গাড়িগুলো সব মুখ ঘুরিয়ে নীচে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ড্রাইভার আঙুল তুলে কিছুটা দূরে একটা ছোট পাহাড়ের মাথা দেখিয়ে বলল, ওটাই হল, টিবেট, চায়না। ওখানে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা যে সব লোকজনকে দেখতে পাচ্ছেন তারা হল-পিপিলস লিবারেশন আর্মি অব চায়না অর্থাৎ চীনা সেনাবাহিনী। আর তার উলটোদিকের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ভারতীয় সেনারা।
অনীশ জানতে চাইল আমরা যে জায়গাটাতে যাব সে জায়গাটা এখান থেকে কতদূর?
পবন বলল, ও জায়গাটা রেশমপথের ভিতর। আরও ওপরে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ভিতরে। স্থানীয় লোক ছাড়া ট্যুরিস্টদের ওখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। রাস্তার এক পাশে চায়না, অন্য পাশে ইন্ডিয়া। ওই নেকড়ে খামারটা আর একটাই ছোট গ্রাম আছে সেখানে।
কথা বলতে বলতে ট্যুরিস্ট গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে অনীশদের গাড়িটা গিয়ে থামল একটা চেকপোস্টের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ানরা।
গাড়ি থেকে নামতে হল অনীশদের। তাদের গাড়ির উইন্ড শিল্ডে আটকানো ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ অরগানাইজেশনের লোগো দেখে সেটা চিনতে পেরে এক অফিসার এগিয়ে এলেন। সরকারের পক্ষ থেকে অনীশদের সে জায়গাতে যাবার খবর আগাম তাদের কাছেও ছিল। অনীশের কাগজপত্র আর তাদের কাগজ মিলিয়ে দেখে আশ্বস্ত হবার পর চেকপোস্ট খুলে দিল তারা। অনীশদের গাড়ি প্রবেশ করল ভিতরে।
রেশমপথ! সিল্করুট! নামটা শুনলেই কেমন যেন রোমাঞ্চ হয় মনের ভিতর। কত হাজার বছরের প্রাচীন এই বাণিজ্যপথ। হাজার হাজার বছর ধরে এ পথ বেয়েই দু-দেশের মধ্যে বাণিজ্য আর সংস্কৃতির লেনদেন হয়েছে। কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে এ পথের সঙ্গে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউ-এন-সাং-ও একদিন এ পথে হেঁটেছিলেন।
অনীশও বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করল প্রথম এ পথে প্রবেশ করে। সর্পিল গিরিবর্ত এঁকে বেঁকে উঠেছে ওপর দিকে। কখনও রাস্তার দুপাশেই পাহাড় আবার কখনও অতলান্ত খাদ।
পাহাড়ের মাথাগুলোতে কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে দু-দেশের সীমান্তরক্ষীরা। হাতে তাদের স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র, ইস্পাত কঠিন মুখ। ঠিক যেন পাথরের মূর্তি তারা। আর্মির গাড়ি ছাড়া এ পথে অন্য কোনও গাড়ি নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু লোকজন চোখে পড়ছে। ঘোড়া, খচ্চর বা গাধার পিঠে মালপত্র চাপিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয় লোকজন সব। ড্রাইভার জানাল ওই সব বস্তায় আর্মির জন্য রেশন যাচ্ছে।