বটে বটে? আপনি দেখছি বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প এনে ফাঁদলেন–বত্রিশ সিংহাসনের একখানা নিয়ে এসেছেন আমার কাছে। বেতালের মত বললাম।
উক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর দুই পত্নীকেই পরের পর দত্তক পুত্র গ্রহণের অধিকার দিয়ে যান। রাণী সিদ্ধেশ্বরী প্রথমে সেই অধিকার খাটাবেন, তিনি ব্যর্থকাম হলে তারপর দ্বিতীয় রাণী। তাঁর সেই ইচ্ছে মতন রাণী সিদ্ধেশ্বরী দেশের থেকে নিজের বোনের ছেলেকে নিয়ে এসে দত্তকরূপে গ্রহন করেন বা করতে চান…বোনের নামটা কী ছিল কেউ বলতে পারল না।
ধরুন না, প্রেতেশ্বরী। সিদ্ধেশ্বরী ভূতেশ্বরী প্রেতেশ্বরী–এক সুরে না হলেও এক স্বরে মিলে যায় বেশ।
বিন্ধ্যেশ্বরী হবে যেন শুনেছিলাম। যাই হোক, এই বিন্ধ্যেশ্বরীর সন্তান স্বর্গীয় শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী হলেন…
আমার বাবা। এ তো আমি জানতাম। বাবার নাম আমি জানতাম না? এই জানতে আপনি অদূর কষ্ট করে এত নাস্তানাবুদ হতে গেছলেন! 1,
উক্ত ঈশ্বরচন্দ্রেরও মনোগত অভিপ্রায় ছিল যে…তার স্বর্গত হবার পর…
স্বর্গে তত গেছেন। এখন ঈশ্বর ঈশ্বরচন্দ্র বলুন তাহলে। কিংবা চন্দ্রবিন্দু ঈশ্বরচন্দ্রও বলতে পারেন। আমি বাধা দিলাম।
হ্যাঁ। ঈশ্বরচন্দ্রের মনের ইচ্ছা ছিল প্রথমা পত্নীর বোনের ছেলেকেই উত্তরাধিকারী করার…রাণী সিদ্ধেশ্বরী হয়ত তাঁকে দত্তক নিয়েও থাকতে পারেন…
না মশাই, না। নেননি। আমি জোর গলায় বলি- আমার বাবা কারো পোয্যপুত্র হবার পাত্র ছিলেন না, তাঁর স্বভাব-চরিত্রের যর আমার জানা আছে। শালীর প্রতি টান থাকা স্বাভাবিক, আমি মানি। এমন কি অপত্যস্নেহবশে তার ছেলেকে রাজতক্তে বসিয়ে যাওয়ার বাসনা থাকাও শক্ত নয়, কিন্তু সেই ছেলেটির ধনশালী হওয়ার বাসনা ছিল না কোনদিনই। যতটা জানি তিনি রাজাগজা কিছু হননি, হতেও চাননি কখনো। কখনো না।
কেন হননি বা কেন হতে চাননি তার মূলে একটা রহস্য আছে। সে কথা পরে। এখন বলুন তো আপনার বাবা যে সন্ন্যাসী হয়ে গেছলেন এ খবর কি আপনার জানা?
জানি বই কি। এমন কি তাঁর সন্ন্যাসী বেশে ধ্যানমগ্ন চেহারার একখানা ফটোও ছিল আমার কাছে। অনেকদিন অযত্ন করে রেখেছিলাম-কি করে হারিয়ে গেছে কে জানে। নইলে দেখাতে পারতাম আপনাকে। জটাজুট সমন্বিত সেই হোরা।
হরিয়ে গেছে, কি করে হারালো?
কবে কেন কোথায়–কিছুই আমার মনে নেই। কেমন করে জানি না, সব কিছুই আমায় হারিয়ে যায়। কিছুই কখনো ধরে রাখতে পারি না আমি।
তার সন্ন্যাসী হয়ে হঠাৎ এভাবে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে বেরিয়ে যাবার গরুটা আপনি বলতে পারেন?
জায়গাটার দোষ বোধ হয়।
জায়গার দোষ?
হ্যাঁ, ঐ যে চাঁচোর বললেন না? ওটার ইংরেজি নাম হল গে চঞ্চল–সেখানকার ডাকঘরের ছাপেও তাই পাবেন। CHANCHALI। তাই মনে হয়, সেই চাঞ্চলের ডাকে আমাকে যেমন এক সময় বাড়ি ছাড়া করেছিল সেইরকম বাবাকেও বোধ হয়…
মশাই, না। কোনো চঞ্চলতার জন্য নয়। চাঁচোরের খুব প্রাচীন এক ব্যক্তির কাছে জেনে এলাম, অন্য কারণ। তাঁরও কথাটা আবার আরও প্রাচীন আরেক ব্যক্তির মুখ থেকেই শোনা। আপনি শোনেননি হয়ত। যাই হোক, আপনার বাবার হঠাৎ এই সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে পড়ার কারণটা কী হতে পারে আপনার ধারণা?
চাঞ্চল্য তো হঠাৎই হয়ে থাকে–তার আবার কারণ কী। আমার কী মনে হয় জানেন? জায়গার যদি না হয় তবে এটা সেই সময়টারই দোষ। সন্ন্যাসব্যাধি তখন কেবল ব্যক্তিগত বা বংশগতই ছিল না। সামাজিক মহামারির মতনই ছিল অনেকটা। তখন তো খাওয়া-পরার ধান্দা ছিল না কোনো, জীবনসগ্রামই ছিল না বলতে গেলে। এখনকার মতন নয়, কারো কোনো ভাবনা চিন্তাই ছিল না সেকালে। আর নেই কাজ তো খই ভাজ। কোনো ভাষা না থাকলেই যত ভাব এসে মাথায় এসে চাপে। বৈরাগ্যভাবটাও সেইরকম। ঈশ্বরটি মানুষ পাগল হয়। ভগবানের খোঁজ খবর নিতে বিবাগী হয়ে বেরিয়ে পড়ে অকস্মাৎ। আর বাবাও সেইরকম…
না মশাই, না। এর মধ্যে অন্য রহস্য আছে…
হ্যাঁ, রহস্য তো আছেই। জীবনটাই এক রহস্য। আমি তো আজীবনই সেই রহস্য দেখছি–বিন্দুমাত্রও তার ভেদ করতে পারিনি যদিও। চাঁচোর থেকে এই চোরবাগান অব্দি সেই রহস্যে ওতপ্রোত হয়ে আছি। দেখছেন না আপনি?
কী রহস্যের কথা বলছেন?
সেই রহস্য। দেখছেন না আপনি, চাঁচোর আর চোরবাগান দুয়ের মধ্যেই একটা রহস্য রয়ে গেছে? লক্ষ্য করেননি?
না তো। কী রহস্য?
দুটি জায়গাতেই একই বিশেষণে একই বিশেষ্য-অভিন্ন রূপে এক বিশেষ ব্যক্তি বর্তমান? দেখছেন না?
উহুঁ।
এত বড়ো চোর আপনার নজরে পড়ছে না? আশ্চর্য!
চোর? সারা মুখটাই একটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ওঠে ওঁর–কোথায় চোর?
চোরই বলুন আর গোলামই বলুন–আপনার সামনেই। এই নরাধম। হাতের তাস ফেলি।
কী বলছেন মশাই? তাঁর মুখের রেখায় প্রশ্ন জিজ্ঞাসার ওপরে বিস্ময় চিহ্ন দেখা যায়।
হ্যাঁ। চাঁচোরেও যে চোর, এই চোরবাগানেও সেই চোরই–সেই আমিই এই আমি। আমার চোরামি ঠাওর হচ্ছে না আপনার?
আপনার অকারণ এহেন কবুলতির কারণ?
কারণ আবার কি! সত্যি কথা স্বীকার করাই কি ভালো নয়? আর সত্যি বলতে, আমার এই দেশ, এই আর্যাবর্ত ব্রহ্মচর্মর পীঠস্থান। এটা তো মানে? ব্রহ্মসূত্র আর কর্মসূত্র এক চৌর্যবৃত্তির দ্বারা এখানে বিধৃত। এর তুঙ্গ স্থানে সেই ব্ৰহ্ম, আর কর্মস্থলে কেবল চৌর্য-দুহাতে এই উভয়কে আঁকড়ে ধরে আমাদের জীবন। ব্ৰহ্মচৌর্য ছাড়া বাঁচা যায় না। বাঁচতে পারি না আমরা।