সে কি! তুমি জানতে না? সে সুধালো।
না এই দ্বিতীয় সংস্করণ বের হবার পর টের পেলাম। আমি বলি–দ্বিতীয় সংস্করণটাই দিয়েছ বুঝি আমায়? প্রথম সংস্করণটা কাকে দিয়েছিলে?
কেন তোমাকেই তো! তুমি জানতে না? সে তো হতবাক। বইয়ের প্রথম সংস্করণ একজনকে, দ্বিতীয় সংস্করণ আরেকজনকে–এরকম দেওয়া যায় নাকি।… আশ্চর্য! বইটা বেরুবার দিনই তো দিয়েছিলাম তোমায়, তোমার বাসায় গিয়ে, মনে নেই।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন। আমি বাসার থেকে বেরুচ্ছি আর তুমি এলে-পথেই তো দেখা হল, মনে আছে বেশ।
বইয়ের মলাটও উলটে দ্যাখনি নাকি?
উলটে দেখার কী ছিল? তোমার সব লেখাই তো মাসিকে বেরুনোর সঙ্গে সঙ্গেই পড়া। একবার নয়, বারবার। সেই সব জানা গল্প আবার নতুন করে জানতে যাবার কী আছে–তাই কোন কৌতূহল হয়নি আমার।
মনে পড়ল তখন। হাতে পেয়ে বইটার মলাট দেখেই খুশি হয়েছিলাম। মলাটের পাতা উলটে আরো বেশি খুশি হবার সৌভাগ্য আমার ঘটেনি যে, সেটা আমার ললাট। প্রেমেনের বই তখন লোকের হাতে হাতে লত, তাই মনে হয়েছিল এই দুর্যোগের দিনে এটাকেও হাতে হাতেই চালিয়ে দিই এই সুযোগে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে এম সি সরকারে গিয়ে বেচে দিয়ে এসেছিলাম বইটা।
.
০৪.
জীবনজিজ্ঞাসু সেই চমকপ্রদ ভদ্রলোকটি কিছুদিন বাদে আবার এসেহজির একদিন আচমকাই।
যতই সচকিত হই না, যথোচিত স্বাগত জানাতেই হয়-আইয়ে জনাব। আসুন।
আপনার কুলকিনারা করে ফিরেছি এবার। ঠিকুজি কুলজী সব নিয়ে। তিনি জানালেন–এর জন্যে মশাই, খোঁজখবর করে আপনার দেশে পর্যন্ত ধাওয়া করেছিলাম শেষটায়।
আমার দেশ! কোথায় আমার দেশ? চমকাতে হল আমাকে।
কেন, আপনার দেশ কোথায় আপনি জানেন না?
একটা মহাদেশ তো জানি, এই ভূভারত। তাছাড়া একটা খণ্ড দেশের বাসিন্দা আমি বটে–এই চোরবাগানের। আমি জানাই, তবে এটাকে কলাবাগানও বলা যায় আবার। সত্যি বলতে, উভয় দেশের মধ্যপ্রদেশে-চোর আর কলা-এই চাতুর্যকলার মাঝামাবিই আমি রয়েছি। কলাচাতুর্যের নোম্যান-ল্যাণ্ডের সীমান্তে আমার আস্তানা।
আপনি উত্তরবঙ্গের নন? জন্মেছিলেন কোথায় শুনি?
উত্তরবঙ্গে নয়, কলকাতারই কোনো অলিগলিতে হবে বোধ হয়। আমি বলি-মার মুখে শুনেছিলাম দর্জিপাড়ায় জন্ম আমার–দাদামশায়ের বাড়িতেই। নয়ানচাঁদ দত্তের লেন—না কোথায় যেন ছিল সেটা।
কত নম্বর বাড়িতে?
ভুলে গেছি অ্যাদ্দিনে। কানে শোনা মাত্র, কোনোদিন নয়নে দেখিনি সেই গলিটাকে। দেখতে যাইনি, কৌতূহল হয়নি। আমি নিশ্বাস ফেলি-তা ছাড়া সে গলি কি আর রাস্তায় পড়ে আছে অ্যাদ্দিন! কলকাতা এর ভেতর কতবার ভোল পালটালো। পথঘাটের নামঠিকানাও পালটে যাচ্ছে।
হতে পারে জন্ম আপনার দর্জিপাড়ায়, কিন্তু আসলে আপনি উত্তরবঙ্গের কোনো রাজবংশের সঙ্গে জড়িত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের থেকে এসেছেন জেনে এসেছি আমি।
কী সর্বনাশ! শুনে এবার চমকে গেছি সত্যিই! রক্ষে করুন, প্ৰলিতারিয়েত, পাতিবুর্জোয়া যা খুশি বলুন, কিন্তু এভাবে আমাকে বংশ দেবেন, এমন কি, কোনো রাজবংশও নয়। ভ্রান্তভাবেও না দোহাই আপনার! আমি রাজবংশীদের কেউ নই।
বললে কী হয়! আপনার মাতামহকুলও প্রায় রাজবংশই; ঠিক রাজগোত্রের না হলেও জমিদারগোষ্ঠীর তো বটে। তখনকার কালে ওই জমিদারদেরই রাজা বলত সবাই। কোনার না কোথাকার জমিদার ছিলেন নাকি তাঁরা।
পৃথিবীর কোন কোনায় কে জানে! আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি। বিশ্বাস করুন, আমার পিতৃকুলে মাতৃকুলে কোনো কুলেই রাজাগজা কেউ নেই কো। তবে হ্যাঁ, মাসতুতো কুলে, তাও আমার আপন মাসির নয়, দূর সম্পর্কের মাসতুতোই, আমার বাবার মাসির, মানে বাবার এক মাসতুতো ভাই একটা রাজাই ছিলেন বটে। খেতাবী রাজা। তবে তাঁর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক! এক রোদে ধান শুকোবার সম্বন্ধেও না।
তাহলেও আপনাকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন বলতে হবে।
কি করে ভদ্রলোকের এই সভ্রান্তি দূর করি, ভারি মুশকিলে পড়ি আমি। বংশের খোঁজে– জীবনে জীবনে ঘুরে ঘুরে বাঁশবনে ডোমকানা হওয়ার মতই তাঁর এই দশা বুঝতে পারি। কার স্বকপোলকল্পিত কে জানে, একটা কানা বাঁশ নিয়ে এসে ধরে বেঁধে কষে লাগাতে শুরু করেছেন আমায়।
দেখুন, আমার নিজের ধারণা ছিল আমি কলকাতার কোনো বস্তির থেকে আমদানি কিংবা ফুটপাথের কোনে কুড়িয়ে পাওয়া। কেন যে আমায় এভাবে অযাচিত অবাঞ্ছিত এই বংশ ধারণ করতে বলছেন তা জানিনে। আমি তো জানি, কলকাতার ফুটপাথে ঘুরে ঘুরেই আমি মানুষ। কেয়ার অব ফুটপাথই আমার ঠিকানা ছিল অনেক কাল। সেখান থেকেই উঠে এসেছি এই মেসের বাসায়। কিন্তু ফুটপাথ আমায় ছাড়েনি, চেয়ে দেখুন, আমার ঘরে যত রাজ্যের জঞ্জাল। কলকাতার রাস্তার মতনই পুঞ্জীভূত। ফুটপাতের প্রতি আমার এই স্বাভাবিক আসক্তি, এটা কি আমার রক্তের টান নয়?
হতে পারে। সে খবরও একেবারে মিথ্যে নয় হয়ত। সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু তাহলেও সামাজিক সম্পর্কটাকে তো আর অস্বীকার করা যায়না মাশাই। আপনার বংশধারার বিবরণ শুনুন আমার কাছে–উত্তরবঙ্গে চাঁচোর নামে একটি সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রাম আছে, এখন উদ্বাস্তুদের সমাগমে সে গ্রাম প্রায় উপনগরের মতই, যাই হোক, সেই গ্রামে একদা রাজা ঈশ্বরচন্দ্র নামে এক নৃপতি বাস করতেন। তিনি সিদ্ধেশ্বরী এবং ভূতেশ্বরী এই দুই পত্নী রাখিয়া অপুত্রক অবস্থায় দেহরক্ষা করেন…