কোন্ সিনেমাতে?
আমার ঠিক মনে নেই। এখনকার এলিট-এই হবে বোধকরি। স্মরণীয় হলেও কোনো কিছু আমার মনে থাকে না, ধরে রাখতে পারে না আমার মন। এমনিই আমার স্মরণশক্তি। কিন্তু আশ্চর্য স্মরণশক্তি ওর, সিনেমা হলের সামান্য খুঁটিনাটিটা পর্যন্ত সে মনে করে রেখেছে। তার সেই লেখাটাতেই দেখা গেল। না মশাই, তাতে আমার বিষয়ে কোনো অত্যুক্তি নেই। প্রায় সব ঠিক কথাই।
প্রায়?
একেবারে ঠিক ঠিক এ দুনিয়ায় কিছুই হয় না, হতে পারে না। সবই যেন প্রায় প্রায় হয়ে যায়।
আবার অচিন্ত্যবাবুও আপনার কথা লিখেছেন তাঁর কল্লোলযুগে।
শুনেছি, কিন্তু পড়া হয়নি। সেটাও নিশ্চয় অচিন্তনীয় কিছু হবে। ওর মন তো কারো কোনো খুঁত দ্যাখে না, সবার ভালো দিকটাই দ্যাখে কেবল, ওর কলমও ঠিক ওর মই, নিতান্ত সাধারণকে অসাধারণ করে দেখায়।
পড়ে দেখেননি? আপনার কথা আপনি পড়ে দেখেননি। তিনি একটু অবাক হন।–আশ্চর্য তো।
কী করে পড়ব! পাইনি তো। কেনাও হয়নিকো, বেজায় দাম বইটার, কিনতে পারিনি তাই। পয়সা কই আমার।
অচিন্ত্যবাবু দেননি আপনাকে?
দিয়েছিল, মানে, দিতে চেয়েছিল। বলেছিল, ডি এম লাইব্রেরী থেকে নিয়ো। চাইতে গেলে গোপালবাবু বললেন, কী করবেন বই নিয়ে? ফুটপাতে বেচে দেবেন তো! নাম খারাপ হবে আমাদের। তার চেয়ে তার দামটাই না হয় দিয়ে দিই। এই নিন পাঁচ টাকা। ধরুন।
কী করলেন?
ধরলাম। তক্ষণাৎ। সমঝদার লোক তো। এ বিষয়ে আমিও বুঝদার বেশ। ওই পাঁচ টাকায় ওঁরই দোকানের সামনে ফুটপাথ পেরিয়ে চাচার হোটেলে গিয়ে নিজেকে বাঁচালাম। কল্লোলযুগে শুনেছি আমার সম্বন্ধে বিস্তর ভালোমন্দ কথা ছিল, পড়া হল না। কিন্তু ভালোমন্দ খাওয়া গেল খুব। ডি এম অচিন্ত্যর দৌলতে কাটলেট খাওয়া গেল মজা করে।…নিজের প্রশস্তি পাঠের চেয়ে সেটা আরও প্রশস্ত ব্যাপার নিশ্চয়।
কারো কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পড়তে পারতেন তো বইটা?
কৌতূহল হয়নি আদৌ। সত্যি বললে, কৌতূহল বস্তুটা আমার কম। কোনো বিষয়েই তেমনটা নেই, নিজের বিষয়ে তো আরো কম। কেননা, আমার কাছে আমার কিছুই বোধহয় অজানা নেই। নিজের বিষয়ে নিশ্চয় আমি অপরের চেয়ে একটু বেশি জানি।
তাহলেও এটা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকছে। তিনি বললেন : বইটা হাতে পেলে কি আর আপনি পড়ে দেখতেন না?
ভদ্রলোক ধরেছিলেন ঠিকই। দামী বইটা নিয়ে বেচেই দিতাম আমি, ফুটপাথে ঠিক না হলেও। তবে বইটা আগাগোড়া পড়ার পরেই বেচতাম যদিও। কী করব বই নিয়ে? আমার বাসায় বই রাখবার জায়গা কই? একটাও আলমারি কি বুক-শেলফ আছে? কোনো বই-ই
আমার কাছে নেইকো, এমনকি নিজেরও একখানা নয়। চেয়ে দেখুন, চারধারে।
তাই তো দেখছি। লেখকের ঘরে একখানা কারো বই নেই? আশ্চর্য!
যেমন লেখক, তেমনি আমি পাঠক। যেমন লেখায় তেমনি পড়ায় আমার অনীহা। লেখাপড়ায় আমি সমান চৌখস।
কিন্তু আপনি যে বইটা নিয়ে বেচে দেবেন, গোপালবাবুর এটা ধারণা করা অন্যায়। উনি সেটা টের পেলেন কি করে?
বারে! উনি টের পাবেন না? ওঁর কাছেই তো বেচেছি কত বই! আমার কোনো ৭২ বেরুলে তার কমপ্লিমেন্টারির পঁচিশ কপি তো ওঁর দোকানে গিয়েই বেচে আসতুম, একটু বেশি কমিশন দিয়ে নগদ মূল্যে। উনি কিনতেন আর উনি জানবেন না!
তাই নাকি! নিজের নতুন বইও বাড়ি এনে দেখবার সাধ হতো না আপনার?
সাধ্য হত না। পাড়ার ছেলেমেয়েরা কেড়েকুড়ে নিত রাস্তাতেই। ভাব ছিল তাদের সঙ্গে। তাছাড়া, বাসার লোকরাও পাবার আশা করত। দিলে আর তা ফিরে পাবার প্রত্যাশা ছিল না। কৃথা বাজে বরবাদ না করে তার চেয়ে নিজের আশ মেটানোটা কি ভাল না মশাই?
নিজের আশ মেটানো?
ভালো একটা প্রাতরাশ। টোস্ট মাখন ডিমের পোচ দিয়ে কোনো রোস্তোরাঁয় গিয়ে। তারপর ধরুন, তেমনি পরিপাটি একখানা মধ্যাহ্ন আশকোনো পাইস হোটেলে নানারকমের মাছ মাংসে, সন্ধ্যায় আবার তেমন ধারার একটা সান্ধ্য আশ-দেলখোস কেবিনে চর্বিওলা মাটন চপ সহ। তারপর? না, তারপর আর কোনো আশ নেই। তারপর একটানা সারা রাত্তির লাশের মতন লম্বা ঘুম একখানা।
এরকম করতেন কেন? না, আপনার ঐ খাওয়া কি ঘুমের কথা বলছি না। এই বই। বেচাটা…
ঠিক লেখকসুলভ নয়, এই তো? কিন্তু আমিও তো সুলভ লেখক নই। খবর কাগজ বেচেই জীবিকার্জনের শুরু হয়েছিল বলেই হয়ত অভ্যেসটা এসে থাকবে। তারপর সেই সব কাগজে লেখা শুরু করেই আমার লেখক-জীবনের সূত্রপাত হল। আর সব লেখকের কেমন আয় হত জানি না, আমার প্রায় যায় দশাই ছিল। ভারী টানাটানির সময় গেছে সেটা। যেমন ছিল লেখার দর, তেমনি তার আদর। তিনশ লাইন লিখে তিন টাকা পেতাম তখন।
বলেন কি।
এমন ছিল সেকালটা। এখন অবশ্য তিন লাইন লিখে তিনশ টাকা পাই। তবে তার কতটা আমার আর কতখানি খোদার কুদরং তা জানি না। একটা কথা বলব আপনাকে? কাউকে বলবেন না। প্রেমেন জানলে মনে ব্যথা পাবে, অবশ্যি এখনও যদি তার ব্যথা পাবার মতন মন থেকে থাকে।
বলুন।
প্রেমেনের প্রথম বই পুতুল ও প্রতিমা, বেরিয়েছিল গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় থেকে। গল্পের বই। অতুলনীয় গল্প সব। অনেকদিনের পর তার দ্বিতীয় সংস্করণ বেরুল সিগনেটের থেকে। তার একখানা কপি হাতে পেতে পাতা উল্টে দেখি, বইটা আমার নামেই উৎসর্গ করা। এ কী! আমি অবাক হয়ে গেলাম দেখে। তোমার প্রথম বইটা আমাকেই দিয়েছ দেখছি। গদগদ কষ্টে তাকে বললাম।