আপনি লিখেছেনও তো নেহাৎ কম না মশাই!
জীবনও তো বিপুল। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, দিগ্বিদিকে বিস্তৃত। ইতো নষ্ট স্ততো ভ্রষ্ট। বেশির ভাগই ট্রাজেডি। তবে কিনা, একজনের দুঃখের কারণ অপরের উপভোগের বস্তু হতে পারে। আমার জীবনের বিয়োগ-যোগগুলি আমি তাই অপরের উপভোগ্য করে তুলেছি। নিজের দুঃখেই কাঁদছি, কতক্ষণেরই বা সে কান্না! তাই দিয়ে আবার অন্যকে কাঁদিয়ে কী লাভ?
তা বটে।
তবে কিনা, সর্বজনীন সাহিত্য সৃষ্টি করতে সবার জীবন দেখে, সকলের জীবন থেকেই নিতে হবে। কিন্তু বলেছি তো, আমার ক্ষমতা অতি সীমিত, উৎসাহও পরিমিত। কুলী কামিনের কাহিনী লিখতে হলে কয়লা-কুঠিতে কাটাও, বস্তির চরিত্র বানাতে পাঁকের মধ্যে মজো, গঙ্গার গল্প লিখতে গিয়ে জেলে হও, জেলেদের সঙ্গে মেশো গিয়ে, আর কয়েদখানার কাণ্ড জানতে হলে কষ্ট করে জেলে যাও। এবং জেলে গিয়ে কষ্ট করো। পাহাড়ে পরিবেশের পরিচয় দিতে বিস্তর চড়াই উতরাই পেরোও। কিন্তু পায়ের হাড় শক্ত নয় যে পাহাড় পার হই, তাই কোনো মহাপ্রস্থানের পথে না গিয়ে ঘরে বসে নিজেকে দেখে নিজের থেকেই আমার এই প্রবোধলাভ।
নিজেকে জানলে সবাইকে জানা যায় বলে যে। তিনি বলেন- তাই বা মন্দ কি?
হ্যাঁ, মন্দ কি! পহেলা, আত্মানং বিদ্ধি। প্রথমে নিজেকে বিদ্ধ করে তারপর আর সবাইকে বিদ্ধ করা। লক্ষ্যভেদ করা নিয়ে কথা। আমিও সেই কথাই বলি। সেই সঙ্গে এই কথাও বলি, আমার সাহিত্য সর্বজনীন, সর্বকালীন এমনকি সর্বাঙ্গীনও হয়নি। সত্যি বলতে, তা সাহিত্যই নয় হয়ত।
সাহিত্যই নয়। তাহলে কী হবে?
বলেছি তো জগাখিচুড়ি। তবে কিনা খিচুড়িও একেক সময়ে ভালো লাগে। বাদলার দিনে তাতেই মজে যায় সবাই। তাই যদি বা কখনো মানুষের পাতে পড়ে, ভোগে লাগে। তার জীবন যন্ত্রণার একটুখানি ভোলানোর জন্যেই আমার এই হাসির পরোয়ানা। দুঃখের পরোয়া না করার। তবে তাতেও কতটা সিদ্ধকাম হয়েছি তা জানিনে।
আপনার গল্পকথা থাক, সে তত আপনার বই পড়লেই জানা যায়। আমি এসেছি আপনার কথা জানতে, আপনার নিজের মুখ থেকে। আপনার ঠিকুজি কুলজি নিতে।
আমার কোনো কুলের খবর আমি রাখিনে। ছোটবেলায় বাড়ির মায়া কাটিয়ে পারিবারিক সম্পর্ক ছিন্ন, পিতৃকুলে, বাবার নামটুকু জানি খালি, ঠাকুর্দার নাম জানিনে। মাতৃকুলে দাদামশায়ের নাম জানতাম, ভুলে গেছি এখন। বেণীমাধব চৌধুরী না কে। কোন না কোথাকার জমিদার ছিলেন, নেহাত জমিদার না হলেও কোনা বলে কোনো জায়গার ভারী জোতদার জাতীয় ছিলেন বোধ হয়, তাঁদের বংশের কে বেঁচে বর্তে আছেন জানা নেই। তিনকুলের পিতৃকুল মাতৃকুল মামাতৃকুল গেল, তারপর জামাতৃকুল। তাও আমার নাস্তি।
জামাতৃকুল?
হ্যাঁ। তাও নেই। মেয়ে থাকলে তো জামাই। মেয়েই নেই, বিয়ে হয়নি বলে।
বিয়ে হয়নি কেন?
পৈতে হয়নি বলে বোধহয়। সেকালে অসবর্ণ বিবাহ ছিল না। পৈতে নেই, অচেনা বামুনকে কে মেয়ে দেবে? আর, বিয়ে যখন হয়নি আমার শ্রাদ্ধও হবে না আশা করি। ছেলে নেই, পিণ্ডি চটকাবে আর ছেরাদ্দ করবে কে?
আপনি খালি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন। কোথায় গেলে আপনার কুলের খবর পেতে পারি তাই বাতলান।
কোথায় পাবেন। নিজের কুলকিনারা পাই এমন আমার ক্ষমতা নেই। কোথায় যাবেন?
আপনার বন্ধুকুলের কারো কাছে?
বন্ধুকুল। পৃথিবীতে বন্ধু বলে কেউ আছে আমি জানিনে। ধু আমার নয়, কারো আছে কি না সন্দেহ। বন্ধু পাওয়া যায় সেই ছেলেবেলায় স্কুল-কলেজেই। প্রাণের বন্ধু। তারপর আর না। আর না? সারা জীবনে আর না?
জীবন জুড়ে যারা থাকে তারা কেউ কারো বন্ধু নয়। তারা দুরকমের। এনিমি আর নন এনিমি। নন্-এনিমিদেরই বন্ধু বলে ধরতে হয়।
আপনার বেলায়?
আমার কেউ এনিমি নয়। এ পর্যন্ত পায়নি একটাও। কিন্তু তারা কেউ আমার কোনো খবর জানে না।
কেন, ভবানীবাবু তো অনেক খবর রাখেন আপনার। তাঁর লেখা অমৃতের কাছে বসে শোনা সিরিজে আপনার কথা বেরিয়েছিল…
তাঁর মহিমা। আগাগোড়া মনগড়া। আমি তাকে কাছে বসে কখনো কিছু শোনাইনি। তাকে শোনাবার আমার কিছু নেই এই কথা তাঁকে জানাতে যেদিন তাঁর বাড়ি গেলাম, শুনলাম তিনি আগের দিনই তার লেখাটা লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন কাগজে। যথাসময়ে আমি যেতে পারিনি তাই।
পড়েননি লেখাটা?
পড়েছি। পড়ে আমি তাজ্জব। বাল্মীকির যেমন রাম না হতেই রামায়ণ রচনা, তারও তেমনি এই ব্রিামায়ণ কাণ্ড! আপন মনের মাধুরি মিশায়ে সেই আশ্চর্য সৃষ্টি। তিনি যে অসাধারণ কথাশিল্পী তার এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর ছাড়া কিছু নয়।
বলেন কি!
আমার ভাঁড়ে ভবানী তা জানি, কিন্তু–ভবানীর ভাঁড়ে যে এতও আছে তা আমার জানা ছিল না। গল্প লেখায়, মহৎ জীবনী রচনায়, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমীক্ষা, সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর জুড়ি নেই, আর ভাঁড়ারও অফুরন্ত তা জানতাম, কিন্তু একটা নগণ্য ভাঁড়কে এমন কাণ্ড করা–সত্যিই অদ্ভুত! অবাক করা কাণ্ডই! সামান্য ভাণ্ডে ব্ৰহ্মাণ্ড দেখানোর মত বাহাদুরি আর হয় না!
প্রেমেনবাবুও তো আমার বন্ধু শিব্রাম বলে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন কোন কাগজে, পড়েননি? সেটাও কি বানানো?
পড়েছি। কে একজন এনে পড়িয়েছিলেন লেখাটা। না, সেটা বানানো নয়। সত্যি ঘটনাই। প্রেমেনের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনাই। এক সিনেমা হাউসেই সেটা হয়েছিল। অবশ্যি, তার আগে কল্লোল কার্যালয়ে তাকে দেখেছিলাম, কিন্তু সেখানে কোনো কথা হয়নি–আলাপ হয়নি–আলাপ জমেছিল সেই সিনেমাতেই।