নিশ্চয় নিশ্চয়। তিনি মেনে নেন আমার কথাটা।
দুধের বদলে পিটুলি গোলায় ভোলালে তাদের চলবে না। সেকালে যেমন সদ্যকিশোরকে ব্রহ্মবোধের দীক্ষা দিয়ে ঈশ্বর সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া হত, একালে তেমনি জীবনবোধের শিক্ষা দিয়ে তাকে বিশ্বের সাক্ষাতে নিয়ে যাওয়া–সে যুগের উপনয়নের মতই এই উপনয়ন দুনিয়ার দরবারে তাকে পৌঁছে দেওয়া। এই জন্মের মধ্যেই আরেক জন্ম লাভ, শুধু দ্বিজত্ব মাত্র নয়, আরো আরো অনেক জন্ম লাভের বোধ সাহিত্যের মাধ্যমেই আমরা লাভ করি। সাহিত্যই আমাদের তৃতীয় নয়ন তার সাহায্যেই আমরা নিজেকে অপরকে জগতকে যথার্থরূপে দেখতে পাই। সাহিত্যই সেই দৃষ্টি-প্রদীপ। সাহিত্যিকের দায়িত্বও তাই এই মনের চোখ খুলে দেওয়া। হৃদয়কে জাগানো।
সে কথা মানি।
আমিও সেই দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি–আমার সাধ্যমত। কতটা পেরেছি জানিনে, কিন্তু ছোটবেলাতেই যাতে তারা নিজেদের পরিবেশ-সমাজ সংসার মানুষের ধরণধারণ সম্বন্ধে সচেতন হয়, জীবনের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটে, প্রয়াস পেয়েছি তার। জীবন আর জগতের সব কিছুই তাদের জানাতে চেয়েছি–যদিও একটু তির্যকভাবে আড় চোখে দেখলে দেখা যায় আরো। সোজাসুজি না বলেও বোঝাবুঝির কোনো অসুবিধা হয় না-বুঝলেন? এমনিতেই ছোটরা আমাদের চেয়ে বেশি বোঝে, বেশি বুঝদার।
এটা কী বললেন?
ঠিকই বলেছি। ছোটবেলায় বোধশক্তি স্বভাবতই তীব্র থাকে। অনুভবের দ্বারা তারা বোধ করে–কেমন করে যেন বুঝতে পারে সব। ছেলেবেলায় সকলেই খুব চালাক চতুর চৌকস থাকে, তারপরে যতই বড় হয়, হতে থাকে, চারধারের ধাক্কা খেয়েই হয়ত বা, ততই আরো ভোঁতা হয়ে বোদা মেরে যায় কেমন! নিতান্ত বোকা কিংবা অতিবুদ্ধি হয়ে, বুদ্ধিজীবী বনে বন্ধু হয়ে যায় বোধ হয়।
হ্যাঁ, ছোটরা যে বড়দের চেয়ে চালাক, চৌকস সেটা লক্ষ্য করেছি–
আর আমার গল্প পড়ে হয়ত তারা আরো একটু চোখা হয়। আমার লেখার পয়েন্ট সেইখানেই… যা এ কথা, আপনি কী বলছিলেন?
আমি এসব কথা আলোচনার জন্য আসিনি। আপনার জীবনকথা জানার জন্যই এসেছিলাম, কিন্তু আপনি ধান ভানতে…
কথাটা যেন তিনি উলটো বললেন মনে হলো। ধান ভানতে শিবের গীত নয়, শিবের গাজন শুনতে এসে টেকির বাদ্যি শুনতে বাধ্য হয়েছেন! টেকির ঢক্কা নয়, শিবের গীত শুনতেই তিনি উগ্রীব।
আমার জীবনকথা আবার কী! সবার জীবনও যা আমারও তাই, আমি জানাই।–এমন কিছু ভিন্নতর নয়, সবার মতই। কোথাও হয়ত বা একটু ইতরবিশেষ, কোথাও একটু বিশেষভাবে ইতর। এই যা।
তা কি কখনও হয় নাকি?
যেখানে আর সবার থেকে আমি আলাদা তা আমার আর্টে। এই আটই লেখক শিল্পীর শিল্পসত্তা। তার বেঁচে থাকা, পেশায় এবং নেশায়। এ ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। শিল্পীর এবং তার শিল্পের কোনো অতীত কথা নেই, ভবিষ্যৎ বার্তাও নেই কোনো। সমস্তটাই তার বর্তমান।
বর্তমান?
সব সময়ই বর্তমান। সবার চোখের ওপর–সর্বদাই। মহাত্মা গান্ধীর জীবনই যেমন হ্যাঁ বাণী, শিল্পায়া লেখকেরও তেমনি সে যা বানিয়েছে তাই তার জীবন। তার বাইরে কি নেই। সেই জীবনকাহিনীই তো জানালাম এতক্ষণ আপনাকে।
.
০৩.
বিলক্ষণ! নিশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক : আপনার আর্ট তো খালি কথার খেলায়।
বহির্লক্ষণ তাই বটে। কিন্তু এহ বাহ্য। বাহ্যদশার মতন অন্তর্দশাও থাকে, এমনকি ও শব্দদেরও। আমি বললাম : কথার খেলাকে নিতান্ত খেলার কথা ভাববেন না। শব্দকে ব্র বলা হয়েছে। ব্রহ্মের রহস্য কী, আমি জানিনে, কিন্তু শব্দদের চিরদিনই আমার রহস্যম মনে হয়। একেকটি word যেন একেকটি world! তার মন নিয়ে, মনন নিয়ে স্বত এক একটি শব্দ, প্রায় মন্ত্রের মতই, কেবল যে তার অর্থের সহিতই জড়িত তাই নয়, তা মধ্যে একাধিক অর্থ, বিচিত্র রস, আশ্চর্য দ্যোতনা, সব উহ্ন থাকে। আমি গুহ্য কথাট প্রকাশ করতে যাই।
এ আবার কোন শব্দতত্ত্ব আনছেন?
নিজেই জানি না। এক স্বরে একাধিক ব্যঞ্জনা এক ব্যঞ্জনায়, একাধিক স্বর, ভাবলে অবাৰ হতে হয়। এক কথার পাঞ্জনায় অর্থবহ একাধিক বাক্যের ব্যঞ্জনা। অবাক হয়ে ভাববার শব্দরূপ, শব্দরস, আর শব্দতত্ত্ব–সব মিলিয়ে পরম রহস্য–আমি হয়ত চেয়েছিলাম তা দিয়ে জগন্নাথের ভোগ বানাতে, জগন্নাথ মানেই জগজন। কিন্তু আমার অক্ষমতায় তা হয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নেহাৎ জগাখিচুড়ি।
আপনার ক্ষোভের কারণ নেই। জগজন না হোক, জগতের বালকজন আপনার সে খিচুড়ি খেয়ে বেশ খুশি। জগত বলতে অবশ্যি আমাদের এই বাংলা দেশ।
সুবোধ বালক তারা–যা পায় তাই খায়, তাতেই খুশি। তাদের কথা ছেড়ে দিন।
আপনিও ও কথা ছাড়ুন। কথার কথা থাক্, কাজের কথায় আসা যাক। যে জন্যে এসেছিলাম–ভুলে গেলেন নাকি? আপনার জীবনকাহিনী …
আমার জীবন আমার যত কাহিনীর মধ্যেই বিধৃত, বিবৃত। তার মধ্যেই তারা ধরা পড়েছে, ধরা রয়েছে। খুঁজে পেতে সমঝে নিতে হবে। আমার কাহিনীই আমার জীবন, আর জীবনই আমার যত কাহিনী।
তার মানে?
নিজের জীবন নিয়েই আমার যত গল্প লেখা, বুঝলেন কিনা, আমার জীবনটা অনেকটা গল্পের মতই। জীবন দেখে, জীবন থেকেই তো সাহিত্য ছেকে নিতে হয়। আমার জীবনে আমার নিজের জীবনটাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেছি কেবল, সীমিত ক্ষমতা নিয়ে তার বাইরে আর যেতে পারিনি, তাই ঘুরে ফিরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই জীবনটাকেই দেখিয়েছি আমার রচনায়।