লেখা আমার পেশা হলেও পিষ্ট হয়েই আমার লেখা। বেশ, মজদুর বলতে না চান মুটে বলতে পারেন আমায়। মোট ফেলেই আমার খাওয়া; মোটামুটি লিখে মোটের উপর কিছু পেয়ে যাওয়া।
যাই বলুন, এদেশের মাপকাঠিতে আপনাকে সাহিত্যিকের মধ্যেই গণ্য করা যায়…
আমি গণ্য করি না। সাংবাদিক বলতে পারেন ইচ্ছে করলে। আসলে আমি হচ্ছি ছোটদের লেখক–ছোট লেখক।
বড়দের লেখা দিয়েই আপনি শুরু করেছেন বলে শোনা যায় …
সেসব লেখা দেখা যায় না আর। কোথায় তলিয়ে গেছে কে জানে! আমারও সেই দশা হত, কোথায় চলে যেতাম অ্যাদ্দিন, ভাগ্যিস সেই ছেলেবেলাকার ছড়াটা মনে পড়ে গেল বড়ো যদি হতে চাও ছোট হও তবে-তাই আমি ছোট-র হয়ে গেলুম ছোট লেখক,– ছোটদের লেখক হয়ে গেলুম-রয়ে গেলুম শেষ পর্যন্ত।
বড় হলেন তো শেষ পর্যন্ত।
আমি হইনি ঠিক। আমার পাঠকরা হয়েছে। বেড়ে উঠে তারা দিল হয়েছে একেকটা। তারা আমায় টেনে তুলতে চেয়েছে বলে আজ আমার এই বাড়বাড়ন্ত।
এরকম তো হয় না বড় একটা। বড় হয়ে ছোটবেলার লেখকদের ভুলেই যায় ছেলেরা।
কারণ আছে তার। আমার লেখায় ছোটদের কখনই আমি ছোট বলে ধরিনি, অবোধ শিশু বলে গণ্য করিনি কখনো। আমার সমকক্ষ বলেই ধরেছি তাদের। বয়স্ক বন্ধুর মতন বিবেচনা করেছি। বড় হবার উপদেশ নয়, বড়ত্বের স্বাদ পেয়েছে তারা আমার লেখায়।
সেই আস্বাদ তাদের মনে লেগে রয়েছে এখনো। সেই কারণেই হয়ত এটা হবে।
আপনি ছোটদের একজন প্রিয় লেখক আমি জানি। আপনার শিশুসাহিত্য ছোটরা খুব ভালবাসে।
সে আমি শিশু সাহিত্য করি না বলেই। করি নানা বলে পারি না বলাটাই ঠিক। সত্যিকার শিশুসাহিত্য করেছেন দক্ষিণারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, কুলদাচরণ, সুখলতা রাও, সুকুমার রায় প্রভৃতিরাই-শিশুদের জন্যই লিখেছেন–শিশুদের মত করেই লেখা। সে কলম আমি পাব কোথায়! এ যুগে সে লেখনী আর সেই লেখা হারিয়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়। কারো কারো হাতে সে ধরনের লেখা এখনও খেলা করে বটে, কিন্তু সে অতি বিরল।
একালের সেই বিরল দৃষ্টান্ত কারা? তিনি জানতে চান।
মোহনলাল, সুকুমার দে সরকার, সতীকান্ত গুহর নাম করা যায়। এর পরের ধাপে মানে কিশোর সাহিত্যের পর্যায়ে পড়েন, হেমেনদা, প্রেমেন, নারাণ গাঙ্গুলী। লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, ধীরেন ধরকেও ধরা যায়…
আর আপনি? আমি এঁদের ধারেকাছেও নিজেকে ধরাতে পারি না। আমার ছোটদের লেখায় কিছু পোলা থাকে আর কিছু পান্ থাকে–এছাড়া কী আছে আর? পোলাপানদের জন্যে লেখা আমার শিশুসাহিত্য পড়ে তাই কি আপনার ধারণা হয়নি? আমার লেখায় বেশ ভেজাল আছে, সেই অ্যাডালটারেটেড লেখা ছেলেমেয়েদের অ্যাডাল্ট বানিয়ে ছাড়ে। আর সেই জন্যেই হয়ত তারা তা ভালোবাসে…। কোনো হিতোপদেশ নেই আমার লেখায়, আদর্শ স্থাপনের বালাই নেই কোনো, কোনো বাণী দিইনে আমি সেই জন্যেই হয়ত শোনার যোগ্য মনে করে তারা। বলুন, বাণী দেবার আমার কী আছে, সোনাই আসলে নেই যেখানে। খাঁটি সোনার নয়, পরিপাটি গিটির–সেই কারণেই আমার রচনায় এত ঝুটো অলঙ্কার, এমন পানঝাল, বুঝেছেন? পারা বাদ দিলে আমার লেখায় কী থাকে, আর এই কারণেই একটা গিটি বোধ সর্বদাই আমার মনে।
ভদ্রলোক চুপ। আমার নিজের প্রতি নিজেরই দাক্ষিণ্যের অভাব দেখে বুঝি তিনি নিরুত্তর হয়ে গেছেন।
আমার নিজের কী মনে হয় জানেন? শিশুসাহিত্যের সেই স্বর্ণযুগ আর নেই। শিশুই নেই তো শিশুসাহিত্য। শিশু কোথায় এখন? শিশুরা আর জন্মায় না, জন্মালেও বেঁচে থাকে না বেশিদিন, মানে, ঐ শৈশব অবস্থাটা অতি ক্ষণস্থায়ী এখন। সময় গতিকে শিশুরা সব বয়স্ক হয়েই জন্ম নিচ্ছে, দেখতে না দেখতে বুড়িয়ে যাচ্ছে–দেহের দিকে নয়, মনের দিক থেকে। এখনকার ছেলেমেয়েদের ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গল্প দিয়ে ভোলানো যায় না, পক্ষিরাজ ঘোড়া আর তালপত্রের খাড়াঁয় তারা ভোলে না, চন্দ্রাভিযানের এই যুগে চাঁদের রকা কাটার বুড়ির সুতোর মায়ায় জড়ানো যায় না তাদের। কল্পলোকের গল্পকথা এখন অচল। শিশুসাহিত্যের সেই সত্যযুগ গেছে, এখন তার এই ঘোর কলিতে তাই আমার এই গাঁজার কল্কি।
না, কী বলছেন। আমার তরফে তাঁর ওকালতি–গাঁজা নয়।
গাঁজা কি না আমি জানি না। গাঁজানোই। তবে কী জানেন? লেখা মাত্রই নেশা ধরায়-গাঁজা হোক বা না হোক। নেশা না ধরলে–না ধরাতে পারলে, পেশা চলে না। এটা সব শিল্পেরই কুলকথা, মূলকাহিনী। তবে আসল কথাটা এই, ছেলেমেয়েদের আমি ভোলাতে চাইনি, ঠকাতে চাইনি, সজাগ করে দিতে চেয়েছি তাদের চোখ কান মন ফুটিয়ে দিয়ে…আজকের পৃথিবীর, এখনকার জীবনের একেবারে মুখোমুখি করে দিতে চেয়েছি।
সেই কথা বলুন।
এখনকার ছেলেমেয়েরা যেন তেল সলতে নিয়ে তৈরি হয়েই জন্মেছে, প্রদীপের মতই উন্মুখ। দেশলাই কাঠি ঘষে দিলেই প্রদীপ্ত। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ। শৈশবের থেকে এক লাফেই, এক ধাপেই যৌবনে। সত্যি বলতে, সব শিশুর মধ্যেই সম্পূর্ণ মানুষটি রয়েছে। পরিণত হবার প্রত্যাশায়–পুরোপুরি জেগে উঠতে চায় সে। সোনার কাঠি ছোঁয়ালেই হলো। তাহলেই চোখে কানে মনে সে সজাগ। বালক-বালিকার ছদ্মবেশে বিশ্বজয়ীর দল। সাহিত্যের কাজ হলো তাদের এই জাগিয়ে দেওয়া। এবং শিশুসাহিত্যই বলুন আর কিশোর সাহিত্যই বলুন, সর্বাগ্রে তাকে সাহিত্যই হতে হবে।