তাই কৈশোরেই কারো যদি এসবের টিকা নেয়া হয়ে যায়-খানিক খানিক স্বাদ পায় সেতো জন্মের মতই বেঁচে গেল বেচারা!
সটীক হয়ে থাকলে সঠিকভাবে বাঁচা যায় জীবনভোর। বাল্যে বসন্তের টিকা নিয়ে রাখলে তা যেমন কখনো প্রাণান্তকর হয়ে দেখা দিতে পারে না, দিলেও হামের মতই হামেশার সামান্য ব্যাপার হয় মাত্র, তেমনি প্রাথমিক এই ত্রিবিধ টিকায়–এই ট্রি অ্যানটিজে নেয়া থাকলে সারা জীবন ধরে পৃথিবী, ঈশ্বর আর ভালোবাসার পার্থিব আর অপার্থিব সেই বসন্তকালকে অল্পে অল্পে একটু একটু করে তারিয়ে তারিয়ে চেখে চেখে যাওয়া যায়-খাওয়া যায়।
তাকেই খাই, তাঁর খাদ্য হতে হয় না।
পরাৎপর হলেও সেই মহাকাল যেন পরাস্ত হয়ে থাকে।
বিবেকানন্দের ভাষায় অমৃত ভাণ্ডের কিনারে বসে তার কিনারা করা। তার ভেতরে ডুব দিয়ে মজে ভূত হয়ে যাওয়া নয়, তাকে কিনারায় রেখে বহালতবিয়তে থেকে দেখেশুনে চেখে যাওয়া।
ভবানীর ভাঁড়ে হারিয়ে না গিয়ে, মিলেমিশে তাঁর সাথে একাকারে নিজেও ভাঁড়ে ভবানী না হয়ে, নিজের ভাঁড়কেও ভবানী না বানিয়ে ভবানীর ভাড়ার লুঠ করা আর কি!
একদিন বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি মা আমার বিরাট দরদালানে কেমন যেন অভিভূতের মতন দাঁড়িয়ে।
আমাকে দেখে বললেন, জানিস কে এসেছিল আজ?
কে?
মা এসেছিলেন।
দিদিমা? তাই নাকি? কই কই? কোথায় দিদিমা? আমি লাফিয়ে উঠেছি।
না, তোর দিদিমা নয়। তোরও মা। তোর মা, আমার মা, সবার মা। তিনিই একটু আগে এসেছিলেন।
শুনে আমি হতবাক হই। বুঝতে পারি না ঠিক।
মা কালী আমায় দর্শন দিয়ে গেলেন একটু আগে। এই সামনে, ওইখানে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন–যেখানে তুই দাঁড়িয়েছিস। ওই জবাফুলটা দিয়ে গেলেন আমায়। আমার হাতে তুলে দিতে এসেছিলেন। ভয়ে আমি হাতবাড়িয়ে নিতে পারিনি। হতচ্ছাড়ী আমি!
সামনেই একটা জবাফুল পড়েছিল আমি দেখলাম। দেখেশুনে আমি শিউরে উঠেছি কেমন।
কাছেই একটা গোরু বসে জাবর কাটছিল, কিন্তু জাবর কাটা সে ভুলে গেছে কখন রোমাঞ্চিত হচ্ছে তখনো। মনে হয় সেও বুঝি মা কালীকে দেখেছে।
আর, সত্যি বলতে, দিব্যদর্শনের গোরুত্ব তখনই আমার মালুম হয়েছিল। সেই দণ্ডেই।
.
০২.
আত্মস্মৃতির পরিক্রমায় এগুবার আগে নিজের কুল পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন আছে বেঙ্গ করি! কিন্তু ছোটবেলাতেই যে নিরুদ্দেশের অকূলে ভেসেছিল আজ এত ঘাট পেরিয়ে, অবশেষের বালুবেলায় এসে জীবনের শেষ তীর্থ আত্মবিস্মৃতির উপকূলে পৌঁছে নিজের কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানো সম্ভব নয় বোধ হয়।
মহাকালের মোহনায় দাঁড়িয়ে গত কালের মোহ না রাখাই ভো ভালো। যখন সামনে চোখ রেখে কিছুই দেখা যায় না তখন পিছনে তাকিয়ে থেকে লাভ? মহাসাগরের অতলে ডুবে যাবার আগে নিজের মনে র দেওয়াই তো বেশ। কিন্তু…
দিন কতক আগে এক ভদ্রলোক এসে এমন বেকায়দায় ফেললেন আমায়! অমুক পত্রের পক্ষ থেকে আমি আসছি। তিনি জানালেন, আমাদের পত্রিকায় আমরা আপনার জীবনকথা ছাপতে চাই…।
শুনেই না আমি চমকে গেছি। আমার প্রতি কোনো পত্রিকার এহেন পক্ষপাতের হেতু খুঁজে পাই না আমার জীবনের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি জন্মালাম কবে যে আমার… বাধা দিয়ে বলতে যাই।
আমরা অমুক অমুক অমুক সাহিত্যিকের আত্মপরিচয় ছেপেচি, সেই পর্যায়ে আপনারটাও প্রকাশ করতে চাই আমরা।
তাদের পর্যায়ে আমি পড়ি না। সবিনয়ে জানাই তারা যথারীতি জন্মেছেন, বেড়ে উঠেছেন, বাড়ছেন, আরো বাড়বেন–তাঁরা জীবন্ত। তাঁদের পূর্বসূরী উত্তরসুরী দুই-ই আছে। তাঁদের জীবনী অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু আমার কথা আলাদা।
আলাদা কেন?
কারণ এই যে, আমি নিজেকে সাহিত্যিক বলেই মনে করি না। সাহিত্য বলতে যা বোঝায় তা আমি সৃষ্টি করতে পারিনি। গাইতে না পারলেও অনেকের গান বোঝার ক্ষমতা থাকে,আমারও অনেকটা সেইরকম। স্বয়ং সাহিত্যিক না হয়েও আমি সাহিত্য বোঝার সামান্য একটু ক্ষমতা রাখি।
সাহিত্য বলতে আপনি কি বোঝেন? জানতে পারি কি?
যা সর্বকালের সর্বজনের সহিত যায়, যেতে পারে। সহযাত্রার শক্তি রাখে। সর্বজনের সর্বক্ষণের সম্পূর্ণ মনের সঙ্গমক্ষেত্র, আমার মতে, তাই সাহিত্য। সে রকম লিখতে পারে কজনা? আমি তো পারি না। আমি তা পারি না। তাই আমি সাহিত্যিক গোষ্ঠীর থেকে আলাদা।
সাহিত্যিক নন কী আপনি?
সাহিত্যিকরা সবাই মহৎ স্রষ্টা, স্বভাবতই প্রেরণার বশেই তাঁরা লেখেন। সামান্য লেখকমাত্র, কলমচালক কেবল, আমি লিখি নিতান্তই টাকার জন্যে। লিখে খাই আর নিজের খাই মেটাবার জন্যেই লিখি। প্রেরণার আদায়ে নয়, প্রাণের দায়ে আমার লেখা।
প্রাণের দায়ে লেখা?– হ্য। লিখতে আমার একটুও ভালে লাগে না। যা কষ্ট হয় কী বলব! না লিখতে হলে বেঁচে যাই। লিখতে মেহৎ,বহুৎ পরিশ্রমের ফল সেই লেখার গা থেকে ঘাম মুছতে মেহনৎ আবার। আদৌ সাহিত্যিক নই। আমি মেহনতি জনতার একজন। মজদুরের সগোত্র।
সব লেখকই লিখে টাকা পান, তা বলে টাকার জন্য লেখেন এমন কথা বলা যায় কি? তিনি বলেন।
গায়ে জোর নেই বলে রিকশা টানতে পারি না তার বদলে এই কলম টানি। কলমের ওপর টান আমার এইটুকুই। আমি জানাই।–সাহিত্যের সঙ্গে আমার সংযোগ ততখানিই।
তাহলেও আপনি লেখক তো নিশ্চয়ই। অনেক লিখেছেন, শখের খাতিরে না লিখলেও নেহাৎ মজুরির জন্যেই আপনার এত লেখা এ কথা ঠিক মানা যায় না।