যদিও ঠিক আমার নয়, আমার মারও নয় কথাটা–আমাদের সাবেক কালের কথাই পরমহংসদেব বলে গেছেন এসব কথাই, কিন্তু একালের ছেলেদের কানে কি করে একথা পৌঁছানো যায় কী ভাবে কোন্ ভাষায় বললে তারা শুনবে–তা কি আমি বলতে পারব। ভারতবর্ষের প্রাণের কথা-সেই ভগবানের কথাই বটে, কিন্তু এ যুগের সংঘাত সমস্যায় কী করে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে? কষ্টের পাথর চিরকালই রয়েছে–সর্বজনের সম্মুখেই–দিনদিনই থাকবার–সেই-কষ্টিপাথরে তার যাচাই করার কথাটাই কেবল! কিন্তু কী করে বলা যায়!
সাধুসন্তরা ভগবানের কাজে লাগবার কথা বলেছেন, তাঁর সেবা করবার কথাই। আমার মতন অসাধু স্বার্থপরের কথা হচ্ছে আলাদা–আমরা ভগবানকেই নিজেদের কাজে লাগাতে চাই–তাকেই সেবক বানাবার আমাদের সানা।
কিন্তু ভগবান কখনো কারো কাজে লাগেন না, কাজে লাগাবার নয়, পিতৃতুল্য তাঁর সে রকম কোনো মতলবই নেই আপদে, বলতেন মা। মা-ই ছেলেদের কাজে লাগেনতাদের সেবায় সজাগ রয়েছেন সর্বদাই–সেই মা-ই একমাত্র।
সেই মাকেই আমাদের চাই।
এবং একটু ডাকলেই তাঁকে পাই। যা পাওয়ার, যা যা চাওয়ার, পেয়ে যাই তাঁর কাছেই।
কী করে তাঁকে পাওয়া যায়? তুমি কি পেয়েছে মাকে? দেখেছো মাকে? ঠিক করে বলো আমায়। শুধিয়েছিলাম আমি।
দুর বোকা! মাকে কি চর্মচক্ষে দেখা যায়? দেখতে পায় কেউ? তাঁর স্নেহের মধ্যেই তাঁর দর্শন মেলে। বরাভয়েই তাঁর পরিচয়। তাঁকে ডেকে যখন কোনো সঙ্কট থেকে ত্রাণ পাই, তখনই তাঁর দেখা পেলাম। যখন তিনি স্তন্য দেন, তখনই তো মা। অন্নপূর্ণা মাকে স্তন্যপূর্ণারূপেই দেখা যায়। দুহিতা হয়েই তিনি দর্শন দেন।
তার মানে?
মা নিজেই কি তা জানিয়ে যাননি? কতবার তো বলেছেন!
বলেছেন? কোথায় বলেছেন? জানিনে তো।
ঐ বাকসুক্তেই বলেছেন। সেটা অবশ্যি মন্ত্রের ভাষা। তাছাড়াও মার জানাবার ভাষা আছে আরো। তাঁর ওই প্রতিমার ভাষা। সে ভাষা বোঝা একটু শক্তই বটে, কিন্তু খোলাখুলিও বলে গেছেন আবার। রামপ্রসাদের কাহিনীটা জানিস না? তিনি ঘরের বেড়া বাঁধছিলেন, বাঁধনের দড়া ফুরিয়ে গেছে, ঘরের ভেতরে মেয়েকে ডেকেছেন–কাতাটা দে মা! মেয়ে এসে বেড়ার ফাঁকে গলিয়ে বাবার হাতে বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়ে কিন্তু যোগায়নি তা, ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিল সে, বাবার ডাক কানেই যায়নি তার। মা কালী মেয়ে সেজে এসে নিজে যুগিয়ে গেছেন।
ঘরের বেড়া বাঁধার ছলনায় ওই রামপ্রসাদকেই মায়ার বাঁধনে বাধতে-যে মায়া নাকি নেহাত মিথ্যেই–নিজে এসে কাতা বাড়িয়ে দিয়েছেন কাত্যায়নী!
হাঁ হাঁ, জানি না। তাঁর গানেই রয়েছে তত-রামপ্রসাদের বাঁধলো বেড়া।
তারপরে কলকাতার কাছেই কোথায় কাঁকনতলার ঘাট আছে জানিস? এক পূজারী বামুন রাতদিন ডাকতো মাকে, কেউ কোথাও ছিল না তার, একদিন এক শাঁখারী এসে বলল, তোমার মেয়ে পুকুরঘাটে পৈঠায় বসে শাঁখা কিনেছে আমার থেকে, তার দাম দিতে বলেছে তোমায়। দামটা দাও।
মেয়ে কোথায়! তিন কুলে কেউ নেই আমার! গরিব মানুষ, কোথা থেকে দেব শাঁখার দাম।
শাঁখারী ফিরে গেল পুকুরঘাটে। পূজারী ঠাকুরের কথাটা মেয়েকে গিয়ে বলতেই সে বললো, বাবাকে বলো গে, লক্ষী ঠাকরুণের ঝাঁপিতে সিঁদুর মাখা টাকা আছে একটা-সেইটে দিতে বলল।
শুনেই ঠাকুর টের পেয়ে যায়–এ মেয়ে তার কে! হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় ঘাটে কোথায় কে! কেউ কোথাও নেই। শাখারী তখন কাঁদতে থাকে এই বলে–কোথায় গেলি মা? আমাকে মিথ্যেবাদী বানিয়ে গেলি! আর পূজারী কাঁদে এই বলে-শাঁখারীর কী ভাগ্যি, কি ভাগ্যি! সে তোর দেখা পেল। আর আমি কী হতভাগ্য, আমি তোর দর্শন পেলাম না। তখন সেই পুকুরের মাঝ থেকে দু খানি হাত উঠলো শাখা-পরা। দুহতেই শঙ্খকঙ্কন। দেখে সব সন্দেহভঞ্জন হোলো দুজনের। মা যেমন মন্ত্রের ভাষায়, প্রতিমার ভাষায় কথা কন, তেমনি ঐ প্রতীকী ভাষাতেও। তাঁর দেখা পেতে হলে বৃত্তপথে বৃত্তির পথেই দেখতে পাই-দোহন করলেই দেখা পাই তাঁর-দুহিতা রূপেই তিনি দেখা দেন। দুহিতা হলেই। মা নিজেই তো বলে গেছেন কথাটা–বললেন আমার মা।
বাবাও একবার বলেছিলেন যেন এই রকমটাই। গো অর্থে পৃথিবী, গো আবার মাতাও। শ্রীকৃষ্ণের গোদোহনের অর্থ হচ্ছে এই পৃথিবীকে দোহন করা। পার্থিব জগত থেকে অপার্থিব রস আহরণ। তিনি এই দোহনবৃত্তির ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন আমাদের।
মার কথাটা মনে ধরেছিল আমার। যাঁর স্নেহধারায় আমাদের পুষ্টিতুষ্টি–বাছুরের মতন তাঁকে ঢুঁ মেরে মেরে দোহনের জন্যেই আমরা। দোহনের হেতুই ভগবান–দুইবার জন্য, দুয়ে নেবার জন্য তো।
ভগবান কি গোরুর অধম হতে পারে?
– সমাপ্ত –