ওষুধ হচ্ছে সিংহ, মার বাহন। আর ঐ অসুখ হলো গে অসুর। পরস্পরের অপোজিং পাওয়ার–কিন্তু মাকে টের পাওয়ার জন্য দুটোরই দরকার। মাকে মনে রেখে ওষুধ খেলি, সেরে গেলি, সঙ্গে সঙ্গে মার পরিচয় পেলি। এখন তখন, এই যাস কি সেই যাস, বিপরিত ফলও হতে পারে–কিন্তু মাকে মনে করে খেলে উলটো উৎপত্তির ফাড়াকেটে যায়–তুই রক্ষা পাস।
সব কিছুরই পজিশন আর অপোজিশন আছে–সব সময়েই। জীবনের পদে পদেই বিপদ আর সম্পদের দেখা পাবি-পাবি তোর মায়ের পরিচয়।
দুঃখ দুর্যোগের পাথারেই তো ভগবতীর সাক্ষাৎ। সেই কষ্টিপাথরে কষেই মার অস্তিত্বের বিচার। যে-ঈশ্বর আমার অসুখে-বিসুখে আপদে-বিপদে কাজে লাগে না সে-ঈশ্বরকে নিয়ে আমার কী কাজ?
কিন্তু তাঁর কথাটা মা যেভাবে বলেছিলেন তেমনি ফলাও করে নারায়ণবাবুকে বলাও কী যেত আমার!
কামারশালায় গিয়ে ছুঁচ বেচার মতই গোয়ার্তুমি হত না কি!
ছোট ছেলে হলে বলা যায়। বিশ্বাস অবিশ্বাসের কোন প্রশ্নই থাকে না। ঈশ্বরকে হাতে হতে বাজিয়ে দেখার কথায় তারা মজাই পায়। ঈশ্বরকে নিয়ে খেলাই যেন এক রকমের।–খেলার সাথীকে নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে যায়। তখন তখনই বাজাতে লেগে যায়–আমি যেমন ঐ করে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করতে লেগেছিলাম একদিন। জীবনভোর সেই বাজনা চলে-ঈশ্বর আর নিজের কাজ দুই-ই বেশ বাজানো যায় একসঙ্গে।
এই হেতুই কি সেকালে ঐ ব্রহ্মবিদ্যার প্রথম দীক্ষা কৈশোরের সেই উপনয়নেই দেওয়া হত নাকি?
জীবনের রান্ শুরু হবার গোড়াতেই এই সুরটা ভাঁজবার বোধহয়। নইলে বয়েস গড়িয়ে বুদ্ধিবৃত্তিতে পৌঁছে নারাণ হয়ে যাবার পর এমন কথা আর পাড়া যায় না বুঝি।
অতএব ক্যাম্ দেম্ ইয়ং! এ যুগের উপযোগী করে ইস্কুলের প্রাথমিক পাঠেই সেই নব নবীনদের কাছে এই প্রণবমন্ত্রের দীক্ষাদান হোক। মা-ফতেমা, মেরীমাতা কিংবা গায়ত্রী দেবীর কাছে (আসলে সবই সেই দুর্গাই) এই পুনর্নবনধারণের প্রার্থনা।
তবুও আমার মনে দুঃখ একটা রইলই! কথাটা তাঁকে বলতে আমার কী হয়েছিল? অপদস্থ উপহসিতই হতাম না হয়…তবুও যদি উনি কখনো ভুলেও ব্যাপারটা পরখ করে দেখতেন…মেঠায়ের স্বাদই তার মিষ্টতার প্রমাণ দিত, আমার কথার কোনো অপেক্ষা রাখত না তার পর।
হাজার ঘুণ হলেও তাঁর কাছে কি ঘুণাক্ষরেও কথাটা বলা যেত না!
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে, বাবার কাছেই কেমন নাজেহাল হয়েছিলাম একবার এই কথা কইতে গিয়ে। মার কথাটা পাড়তেই না ফোঁস করে উঠেছেন তিনি-যাঃ যাঃ। আমার কাছে আর তোর দুর্গার মহিমা ফলাতে আসিস না। আমি কি তোর মার মতন শাক্ত নাকি? ত্বমীশ্বরং ঈশ্বরানাং পরমঃ-আমাদের সন্ন্যাসীদের কাছে দেবাদিদেব সেই মহাদেব ছাড়া কিছু নেই। আর আমিই হচ্ছি সেই শিব। বুঝেছিস? চিদানন্দরূপ শিবোহ শিবোহ!
বলেই তিনি ভোম হয়ে রইলেন।
মার কাছে গিয়ে বাবার কথাটা পাড়লে তিনি বললেন–পাগল! ভগবতীর ওপরে আবার কেউ আছে নাকি রে? ভগবত্যাঃ পরং কুতঃ ভগবান নহি বিদ্যতে!
মা কী বলে জানো বাবা? ভগবত্যাঃ পরং কুতঃ ভগবান নহি বিদ্যতে…বাবার কাছে মার কথাটা গিয়ে কুঁথিয়েছি।
কোন্ শাস্ত্রে বলেছে? জেনে আয় গে, কোন্ সুক্তে আছে কথাটা? বললেই আমি। মেনে নেব নাকি? বললেন বাবা-জেনে আয় কার সুক্ত এটা।
কার সুক্ত–তার মানে?
সুক্ত থাকে না। যেমন ধর, তোর ঐ দেবীসুক্ত–চভীর গোড়াতেই রয়েছে। অঙ্কুণী ঋষির কন্যা বিদুষী বাক্-এর সুক্ত সেই–যাতে আছে ঐ–অহমেব রুদ্রেভিঃ বসুভিরামি/অহমাদিতৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।– ও! সেইটে! আমিই ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর সবাইকে রাচ্ছি–সেই কথাটাই বলছো তো? ওটা তো ঠিক মার কথাই, তাই না?
চরামি মানে চাচ্ছি নয়। তোকে ধরে আমি যদি একটা চড় কসাই তাহলে আমার রাগ যায় বটে, তবে চরামি হয় না-শুনেই আমি তিন হাত পিছিয়ে আসি-এখানে রামির অর্থ হচ্ছে তাদের সাথে বিচরণ করি। বুঝেছিস? না, আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেব তোকে?
শুনেই আমি সরে পড়ি সেখান থেকে। সুক্তর কথাটা পাড়ি গিয়ে মার কাছে এবার। জানা যায়, কোনো শাস্তরের কথা নয়
মা বললো যে, ওটা মার সুক্ত। আর কারো না। বুঝেছো?
তোর মার সুক্ত?
হ্যাঁ। বাক্-টাকের নয়। তাই বলল মা।
বুরবাকের মত কথা।
কেন, মার সুক্ত কি হতে পারে না? মা কি বানাতে পারে না নাকি? রোজ রোজ যে সুক্ত রাঁধে মা?
সুক্ত না ছাই! মুখ বিকৃত করেন বাবা–মুখেও তোলা যায় না–যাচ্ছেতাই!
একথাটা তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। মার সুক্তরা ভারী অখাদ্য। এক কথায় সায় দিয়ে বাবার সঙ্গে আমার সন্ধি হয়ে যায়।
কিন্তু নারাণের শোক কিছুতেই ভুলতে পারি না। যখনই কোথাও কোনো অপঘাত ঘটে, বুকটা আমার ছাঁত করে ওঠে, যখনই কোনো ছেলে পরীক্ষায় ফেল করে আত্মহনন করে, কি দুটি ছেলেমেয়ে ভালোবেসে ছাঁদনাতলায় গিয়ে মিলতে না পেরে পৃথিবীর থেকে পিঠটান দেয়, তখনই আমার মন টন টন করেনতুন করে দুঃখটা উথলায়, মনে হয়, এ আমার অপরাধ-এর জন্যে আমিই দায়ী। আমিই যেন অপরাধী।
কবে সেই ছেলেবেলায় মার কাছ থেকে এই বিশল্যকরণী মৃতসঞ্জীবনীর মন্ত্র পেয়েছিলাম, হেলাফেলায় যার ব্যবহার করে সব ফাড়াকাটিয়ে এসেছি, যে-ভেলায় চেপে অবহেলায় উতরে এলাম ঝাবিক্ষুব্ধ এই জীবনের পারাবার, সেই কথাটাই আমি বলে যেতে পারলাম না কাউকে–আমার ভাইবোনদের, দেশের ছেলেমেয়েদের-কাউকেই না। এই দুঃখটাই বড় হয়ে রইলো আমার।