জানি বই কি। সেই জন্যেই বাধ্য হয়ে আমায় ডাক্তার বদলাতে হয় যে!
ডাক্তার বদলাতে হয়?
হবে না? বেঘোরে মারা পড়লে কী করা যায়। বিশ বছর আমি হাই প্রেশারে ভুগছি–এর ভেতর আমার তিন তিনটে ডাক্তার ঐ বোগেই স্বর্গীয় হয়েছেন–দুজনে মারা গেছেন, একজন পক্ষাঘাতে পড়ে। চতুর্থ ডাক্তার, আমার বন্ধুতুল্যই, ডাঃ কে. পি. রায়কে ধরেছি এখন, জেনেছি তাঁরও ঐ প্রেশার, তাই করজোড়ে তাঁকে নিবেদন করেছি-দোহাই। আমি মারা যাবার আগে যেন মহাপ্রয়াণ করবেন না দয়া করে। তাহলে আমায় দেখবার কে থাকবে? যে-ঔষধ আমার জন্য ব্যবস্থা করেছেন, আপনিও তাই খাবেন দরকার পড়লে, অন্যথা না হয়।
তবেই বুঝুন, নিজেদের ওষুধ নিজেরাই কেন খান না ডাক্তাররা। ওষুধেরও একটা বিষক্রিয়া আছে যে! বোগের থেকে যার বিপদ কম নয়।
দুই নিয়েই আমাদের চলতে হয়, বাঁচতে চাইলে চলতে হবে–উপায় নেই। যাক গে, ওকথা থাগে, আপনি ওষুধ খাবেন মোটের ওপর। রোগে যতটা ক্ষতি করে ওষুধ নিশ্চয় তার বেশি ক্ষতিকর নয়।
এই কথা বলে, যে কথাগুলি বলতে আমার বেধেছিল, বেশ সঙ্কোচ বোধ করেছি–সে কথা আমার ছিল না, ছিল আমার মার।
মা বলেছিলেন, অসুখ আর ওষুধ দুয়েরই বিষক্রিয়া মার কৃপায় নিরাকৃত হয়ে যায়। তোর বাবা বলতেন, ঔষধে চিন্তয়েৎ বিষ্ণু ওষুধ খাওয়ার আগে বিষ্ণুকে স্মরণ করবে। সেই বিষ্ণু কে? ওই দুর্গাই। তিনিই বিষ্ণুর শক্তি–তাঁকে বাদ দিয়ে বিষ্ণুর কোনো শক্তি নেই। চন্ডীতে বলেছে না? ত্বম্ বৈষ্ণবী শক্তিরনবীর্যা/বিশ্বস্য বীজমপুরমাসি মায়া/সমোহিত দেবি সমস্তমেতৎ/ত্ব প্রসন্না ভূবিমুক্তি হতু। সব শক্তি, সবার শক্তি ঐ মা দুর্গাই। কিন্তু তাঁর বাহন চাই। বাহন না হলে তিনি কাজ করবেন কী দিয়ে। কাকে নিয়ে? ওষুধই সেই বাহন। ওষুধই হলে গিয়ে সেই বাহনসিংহস্বরূপ-যে-বাহনে ভর দিয়ে তিনি অসুখরূপী অসুরকে সংহার করেন, বশীভূত করেন। মার কৃপায় ওষুধ আর অসুখ দুই-ই সমীকৃত হয়ে যায় তার পায়ের তলায়!
কিন্তু ওসব কথা নারায়ণবাবুর ন্যায় বুদ্ধিজীবীর কাছে ফলাও করতে কেমন যেন আমার আটকে ছিল সত্যিই। উনি কি বিশ্বাস করবেন? আমার দুর্বলতায় হাসবেন মনে মনে।
বুদ্ধিদীপ্ত তার সম্মুখে আমার প্রগম্ভ কণ্ঠও কুণ্ঠিত হয়েছে। উনি কি বিশ্বাস করবেন আমার কথাটা?
কিন্তু বিশ্বাস করা না করার কোনো প্রশ্নই ছিল না। মা বলতেন, তাকে জানানো নিয়ে কথা, অবিশ্বাস করে বললেও ফল হবে–বিশ্বাস না করে আগুনে হাত দিলে কি হাত পোড়ে না? সব কিছুই বাজিয়ে দেখতে হয়, এমন কি ঐ ঈশ্বরকেও। জীবনে অসুখবিসুখ দুঃখ দুর্বিপাক ইত্যাদি আসে কেন? ঈশ্বরের পরিচয় পাবার জন্যই তাকে বাজিয়ে নেবার জন্যই তো!
এতই যদি তাঁর স্নেহ, আমি বলেছি, এসব দুঃখ দুর্যোগ আসেই বা কেন আদপে? তিনি কি আগের থেকেই রুখতে পারেন না এসব?।
তা কী করে হয় রে। তবে তো সব গুটি সরিয়ে খেলার ছকটাই গুটিয়ে নিতে হয় তাহলে। গোটা মায়াটাই কেটে যায় তবে-সমস্ত খেলাটাই মাটি। পাত্তাড়ি গুটোতে হয় সবাইকে। এই জগৎ-সৃষ্টি-সংসার, মা ছেলে ভালোবাসাটা কিছুই থাকে না আর!
না না না। আমি প্রতিবাদ করেছি-ভালোবাসাটা চাই আমাদের। চাই-ই। নইলে বাঁচবো কী নিয়ে? থা কী নিয়ে আমরা?
তবে বোঝ। তাহলে এই বসুন্ধরারও দরকার। ঐ ভালোবাসার জন্যই। নইলে সেই কেন্দ্রমূলে গিয়ে বিন্দুমাত্র হয়ে থাকায় কোন লাভ নেই। সেই তন্মাত্র অস্তিত্বের যদি কোন মূল্য থাকত, পরমেশ্বর স্বয়ং সাধ করে নিজের মায়াবৃত্ত ফেদে তার ভেতরে জড়াতে যেতেন না; মজা তো এইখানেই-এর মধ্যেই–এই মায়াবৃত্তে-মহামায়ার বৃত্তান্তে। আমরা ছোটখাট মায়াপাশে বদ্ধ, আর তিনি বেঁধেছেন মহামায়াপাশে আপনাকে। মুক্তি নেই কোথাও।
মার কথায় কবিগুরুর কথাটা আমার মনে পড়েছিল-মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় আছে? আপনি প্রভু সৃষ্টি বাধন পরে/বাঁধা সবার কাছে।
সবই ভালো। কিন্তু কেন যে এই সব দুঃখ দুর্বিপাক দুর্যোগ দুর্ভোগ… আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিলাম। –এসব নইলে কি চলতো না আর?
খেলার নিয়মেই এইসব। অঙ্কের ছকে বাঁধা। সেন্টার রেডিয়াস্ সার্কল–এই তিন নিয়েই তো সব। সার্কল-এ এসে বৃত্তপথে বৃত্তিপথেই এদের উৎপত্তি। বৃত্ত ধরে প্রবৃত্তি পথে এগুলেই পদে পদে বাধা পড়ে, মার নাম করে তাঁর সাহায্যে কাটাতে হয় এসব। কেন্দ্রেও যে বিন্দু, সেই বিন্দু রেডিয়াসেও, আবার বৃত্তপথে এসেও সেই বিন্দুই-একই বিন্দুবাসিনী। সবারই সমান শক্তি-তুল্যমূল্য সব। সর্বত্রই আত্মবিস্তার-প্ৰয়াস। সবাই নিজের গতিমুক্তি খুঁজছে। নিজের বৃত্ত রচনা করতে পারাতেই সেই বিমুক্তি। মনের মুক্তি যেমন মন্ত্রে–সুরে সুরভিতে সৌন্দর্যে। মন্ত্রের ঐ ক্রিয়াগুলি বৃত্তিগুলি আমাদের মধুর বৃত্ত। কিন্তু ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া রয়েছেই। বৃত্তও যখন উল্টে নিজেকে চাউর করতে চায়, সেই চেষ্টায় অসুর সৃষ্টি হয়–অসুখ দুঃখ দুর্ভোগ ইত্যাদিরা জোটে–তাই হচ্ছে বৃত্রাসুর। বৃত্তি থেকে বৃত্ত থেকে যা ত্রাণ পায় তাই। মার সাহায্য নিয়ে বৃত্রাসুরকে সংহার করতে হয়। বধ করেন বিই-মার সেই বৈষ্ণবী শক্তিই।
তুই দুর্গার পটের মধ্যে জীবনের পুরো ছকটাই পাবি। কেন্দ্রমূল, মধুর বৃত্ত, অসুর বৃত্ত সব কিছুর। সবই আছে তার ভেতর-সবটারই দরকার-সমস্তই চাই। নিজের বাহন সিংহের ওপরেও-মার যেমন বুকি, অসুরের প্রতি ঝোঁক তার কিছুমাত্র কম নয়। বেশিই বরং। দেখবি মা ডান দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।