শুধু গালমন্দর উপর দিয়েই যাবে না, হাতে পায়ে খোঁড়াও হতে হবে আমায়। কিন্তু রুদ্রমূর্তি পবিত্রবাবুকে থামায় কে?
বাহ্বাস্ফোটে তিনি এগিয়ে আসতেই না আমি তাঁকে এইসা এক ধাক্কা লাগিয়েছি…গিয়ে পড়েছেন ঘরজোড়া তক্তপোষের কিনারায় দেয়ালঘেঁষা দাবাইয়ের আলমারিগুলোর ঘাড়ে। তাদের ভেতরে সারে সারে খাড়া-করা থাকবন্দী রমেশবাবুর যত ওষুধ আর বটিকা-টোটকা এবং টুটকি, মকরধ্বজ আর চ্যবনপ্রাশ-ব্রাহ্মঘৃত আর শ্রীগোপাল তৈল, কামেশ্বরমোদক আর ভাস্কর লবণ–কটুক্তিকষায় রসায়ন যত না।
অকুস্থলে পবিত্রবাবুর পাঁচনের ওপর পড়ল গিয়ে বেটর আমার ঐ মুষ্টিযোগ!
তারপর আর কিছু বলতে হল না। ওতেই কাম ফতে! দেখতে হল না তারপর।
পবিত্রবাবু আলমারির ওপরে গিয়ে পড়লেন, আলমারি তাঁকে নিয়ে পড়ল। তার পরে দুজনে মিলে জড়াজড়ি করে ভাস্কর-লবণ-জর্জর পঞ্চতিক্ত কষায়ে কষিত সালসাদের সহিত ওতপ্রোত হরিতকি আমলকি বহেড়ার আলুথালুর মধ্যে বটিকাদের ছড়াছড়ির ছত্রাকারে সেই তক্তপোষের উপরে গড়াগড়ি যেতে লাগলেন।
বিফলাদ্য বিতর্কের ত্রিফলাদ্যযোগে তাবৎ ঈশগুল গুলঞ্চ আর মশগুল সাহিত্যরসিকরা একাকার হয়ে একশা সবাই! ইলাহী কাণ্ড!
পবিত্রর গায়ে জোর আমার অন্তত ছগুণ। ই কবরেজখানার মকরধ্বজের ন্যায় ষণ বলি-জারিত হতে সেখেনে আমি দাঁড়াই আর? পবিত্রবাবুকে ঐভাবে রেখে সেখেন থেকে আমি উধাও! মেষের মতই ল্যাজ গুটিয়ে আমি পলাতক। নিমেষের মধ্যেই নিজের মেসের বিছানায় এসে পর্যবসিত।
হাত থাকতে মুখে কেন? এটাও একটা তর্কের প্রশ্নই।
কেননা, কোনো তর্কের জবাবই মুখে মুখে খেলে না, ওই হাতে হাতেই মেলে। শেষ অবধি হাতাহাতিতেই সব তর্কের নিষ্পত্তি হয়।
তার পরে আর মুখ খোলার দরকার থাকে না, পরস্পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। এর চেয়ে ভাল মুখবন্ধ আর হয় না।
.
৮৩.
নারাণ গাঙ্গুলির অকালমৃত্যুর জন্য আমি নিজেকেই দায়ী মনে করি।
নারাণবাবুর বাড়ি গেছি একদিন, গৌরাঙ্গদের বাড়ি যাবার পথে গোলপার্কের কাছেই তাঁর আস্তানাটা-নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছিল আমাদের।
কথায় কথায় শরীর গতিকের কথা উঠল। আমার হাই ব্লাডপ্রেশার, ওঁর তো তা রয়েছেই, তার ওপরে আবার ডাইবিটিস।
আমার ওই ব্লাডপ্রেশারই ভালো মশাই! ডাইবিটিস আমি চাই না।
চান না?
না। ব্লাডপ্রেশারে নুন না খেলেই চুকে যায়, সল্ট-ফ্রী খাবার হলেই হলো, কিন্তু ডাইবিটিসে সুইট-ফ্রী থাকতে হয়। সে ভারী মুশকিল। মিষ্টি না খেয়ে আমি থাকতে পারি না।
তা বটে।
সঙ্গে সঙ্গে ওঁর বাড়ির ভেতর থেকে ফরমায়েসী গরম গরম রসগোল্লা এসে পড়ল। তার সদ্ব্যবহারে লেগে বললুম, ডাইবিটিস হলে এসব আর মুখে তুলতে পারব কী। শুধু সেই একটিমাত্র মিষ্টি ছাড়া আর কিছুই তো মুখে তোলা যাবে না। এবং সেই মিষ্টিই বা পাব কোথায় এখন? এই বয়সে কে দেবে আমায় আর?
আমার কথায় তিনি মৃদু হাসলেন।
ব্লাডপ্রেশার নিয়ে খাসাই আছি বলতে কি! দুটি মাত্র ভয় তো, করোনারি গ্লুমবোসিস আর সেরিব্রেল হেমারেজ-এর। করোনারি আটকাতে চর্বিজাতীয় কিছু না খেলেই হোলো। চর্বিতচর্বণ বাদ দিয়েছি একদম। আর সেরিব্রেল হেমারেজের হাত থেকে রেহাই পেতে ওষুধ খাই। যা সব চমৎকার ওষুধ বেরিয়েছে না আজকাল!
কী করেন?
ডাক্তার যা বলেছেন। কাজকর্ম সব বন্ধ করে দিই, আডেলফিন উইথ ইসিড্রেক্স এক বটি খেয়েই না লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি বিছানায়। সলিড কিছু খাই না আর তারপর। খালি হরলিকস্। ঐ বটি আর বিশ্রাম। দেখতে না দেখতে আরাম!
কি করে টের পান আসন্ন হেমারেজের?
মাথা ক্রিক্ ক্রিক করলেই বুঝতে পারি যে, গড়বড় হয়েছে হেড আপিসে। নইলে অকারণে সহসা তার এই ক্রিংকার কেন? যতক্ষণ না সে ঐ ক্রি রোডের মোড় থেকে ফিরেছে, স্বস্তি নেই আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আমার। ওষুধ খাবার আর বিশ্রাম নেবার খানিক বাদেই মাথা সহজ হয়ে আসে আবার। তার পরে হরলিকস্ খেয়ে টানা ঘুম লাগাই। সেদিন আর কোনো কাজ নেই।
আরে মশাই, আমারো যে মাথা ক্রি করে মাঝে মাঝেই। তিনি জানান।
কী করেন আপনি?
কিছুই না, কী করব? কাজকর্ম যা করার করে যাই তেমনি।
লেখেন-টেখেন তখনো?
নিশ্চয়।
কোনো ওষুধ-টষুধ খান না? ঐ ইসিড্রেন্স অ্যাডেলফিন…
কেন খেতে যাব অকারণে? তাছাড়া, না লিখে কি থাকা যায়? দায় আছে না মাথায়? ডিউটি ফার্সট।
তা জানি। কিন্তু ওষুধ ফোরমোস্ট। সব কর্তব্য ফেলে রেখে ওষুধ খেতে হয় সবার আগে।
নারাণবাবু যেমন লেখা-পাগলা দেখা গেল, আমার ভয় হল, কোনদিন না ঐ লেখার জন্যেই তিনি শহীদ হয়ে যান।
ওষুধ বেশি খেতে নেই, যখন তখন তো কখনই নয়। ওষুধের একটা প্রতিক্রিয়া আছে-সেই বিষক্রিয়াতেও ভুগতে হয় আবার। তিনি বললেন।
জানি। কিন্তু এই ভোগবতী বসুন্ধরায় ভোগ এড়াবার উপায় নেই। হয় অসুখে ভুগুন, নয় ওষুধে ভুগুন-ভুগতেই হবে আপনাকে। ওষুধে ভোগাটাই ভাল নাকি? হাজার প্রতিক্রিয়া হোক, আরাম আছে তার মধ্যে। আর ব্যারামে ভুগলে আপনারও কষ্ট, আপনাকে নিয়ে আশপাশের আর সবারও ভোগান্তি।
তা বটে। তবে ডাক্তাররাও কারণে-অকারণে ওষুধ খেতে বলেন না…
না বলুন। আমার মনের মধ্যে বলে যে! মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে–খা খা! ওষুধ খা। কাজকর্ম সব ফেলে রেখে শুয়ে পড় চট করে। করছিস কী? একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে তোর? শুনেই আমি শুয়ে পড়ি চট করে–একটা পিল ঠুকেই না। ওষুধের ব্যবস্থা দিয়েছে ডাক্তার-কাজ তার সেইখানেই খতম। তারপর থেকে আমার মতিগতির বাধ্য আমি। মনের কথায় চলি। সব বিষয়ে সব সময়।