তখন আমি দেখতে পাইনি যে, বীরভূমের রুক্ষ ভূঁয়ের পাশ দিয়েই রূপনারায়ণ বয়ে চলেছে। রাঙামাটির রস জমাটি–সেই রসরাপের দেখা পেলাম ওই কবিইে। কবির প্রতাঁকের ভেতর দিয়ে তিনি জগৎ-কবির প্রতিকৃতিই প্রকাশ করেছেন-সেই বিরাট প্রতীকক্রিয়ায় করিয়া খাইয়ার তাবৎ ক্রিয়াকে ছাড়িয়ে গিয়েছে কোথায়।
প্রভাতীতে তার যথার্থ পরিচয় পাবার পর আমার প্রতিক্রিয়া পত্রিকাঁপাঠ পত্রপাঠ তাঁকে জানিয়েছিলাম, তারও কোনো জবাব তিনি দেননি। সত্যদ্রষ্টা মহৎস্রষ্টারা স্বভাবতই সব নিন্দা-প্রশংসার উর্ধ্বে থাকেন, কিছুতেই তাঁরা বিচলিত হন না। রমেশবাবুর আড্ডায় নিজের কুচ্ছায় যেমন অবিচল, সাধুবাদেও তেমনি তিনি অনুচ্ছসিত।
আমার চিঠির জবাব পেয়েছিলাম অবশ্যি পরে–অনেক পরেই। রঙ্গমঞ্চে নাট্যরূপে কবির উপস্থাপনার কালে। কলাবাগানের গলিখুঁজি পেরিয়ে কত কষ্ট করে মেহনত পুইয়ে আমার বাসার ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আমার আস্তাবলে তিনি এসেছিলেন-কবির অভিনয় দর্শনের আমন্ত্রণ নিয়ে। রচনার মত রঙ্গমঞ্চে তার উপস্থাপনাও অপরূপ-অবিস্মরণীয়।
পরে আমি তাঁর রচনার আরো পরিচয় পেয়েছি। দেখেছি যে, জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর এহেন বিস্তৃত, বক্তব্য এতই বেশি যে বিস্তারিত না হয়ে তাঁর উপায় ছিল না, সংক্ষেপে বলা অসম্ভব, সব বলা সব কথা বিশদে না বলা পর্যন্ত তাঁর রেহাই নেই। ইঙ্গিত ইশারায় সারা যায় না, বিশল্যকরণী সেই মৃতসঞ্জীবনীকে আনতে হলে গোটা গন্ধমাদনকেই উপড়ে আনতে হয়। মহাবীর্যবান সহিত্যকলার চাল কখনই চটুলগতি ঠুমকির মত হতে পারে না।
তাই তার গতিবেগ রূপনারায়ণের ন্যায় এমনই দুর্দাম যে, কোথাও একটু বসে থিতিয়ে থেমে নিজের ভাষাকে মেজে ঘষে একটু ঘুরিয়ে বলার কসরত করার তাঁর ফুরসত নেই। অনেক কথার ভেতর দিয়ে যে একটি কথা তিনি কন, সেই এক কশারই দাম অনেক। ভাস্কর্যের সৌন্দর্যে সেই এক কণাই কশারক।
এক মণ ভারী কয়লার তুলনায় এক ভরি সোনা যেমন।
তাছাড়া, ভেবে দেখলে, আঙ্গিকের ভঙ্গিমা ছাড়িয়ে–ছাপিয়েই তো সাহিত্য। অঙ্গভঙ্গীর চেয়ে মানুষটাই বড় যেমন।
তারাশঙ্করের সাহিত্যে সেই মানুষের কথাই।
রমেশবাবুর আখড়ায় সেই প্রথম আমার সাহিত্যিক সংঘর্ষ। মুখোমুখি যদিও নয় ঠিক, কেননি। আমি মুখিয়ে গেলেও তিনি এড়িয়ে গেছেন, মুখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হননি, কিন্তু দ্বিতীয়বার যথার্থই একটা হাতাহাতি হয়ে গেল। অদ্বিতীয় পবিত্র গাঙ্গুলির সাথেই।
সেখানের বৈঠকে সাহিত্যজিজ্ঞাসায় আমার শেষ ঠোকাঠুকি সেইটাই।
কমলদের বাড়ির সদর চৌকাঠে বসে তার সঙ্গে গল্পগুজব করছি, এমন সময়ে পাশের আসর থেকে সোরগোল এল–কী নিয়ে বেজায় তর্কাতর্কি বেধেছে যেন।
বিতর্কিত ব্যাপারে গলা বাড়াতে না চাইলেও সব সময় পারা যায় কি! হট্টগোলের একটা আকর্ষণ থাকেই, সেটাই আগ বাড়িয়ে এসে কান পাকড়ায়। ইচ্ছে করলেও তর্কাতীত থাকা যায় না।
কৌতূহলবশে হট্টমালার দেশে গিয়ে বসেছি, একটুখানির জন্যেই, রমেশবাবু শুখিয়েছেন শৈলজা আর অচিন্ত্যর মধ্যে কে বড়? বলুন তো, আপনার কী মত?
বিতর্কটা বেধেছে তাই নিয়েই বুঝলাম।
এ আর বলা শক্ত কি! কে কোন্ সালে জন্মেছে জানলেই তো বলা যায়। আমি বললাম।
বয়সের কথা হচ্ছে না…।
তবে কি বিদ্যে-বুদ্ধিতে? তা, অচিন্ত্য যেকালে মুনসেফ–আমি সেফ সাইডে থাকতে চাই-সে-ই বড়ো বলে আমার মনে হয়।
বিদ্যেবুদ্ধির কথা নয়, লেখক হিসেবে দুজনের মধ্যে বড় কে? এইটেই প্রশ্ন। পবিত্রবাবুর হুঙ্কার।
হ্যাঁ, তাই জানতে চাইছি আপনার কাছে। সায় দেন রমেশ সেন।
সত্যি বলতে, এরকম কোনো প্রশ্ন উঠতেই পারে না। শৈলজা আর অচিন্ত্যর ভেতর কে বড় লিখিয়ে তা কি করে বলা যায়? আম আর আনারসের মধ্যে বড়ো কে, এই ধরনের নয় কি প্রশ্নটা? কোনো ফলের সঙ্গেই কোনো ফলের তুলনা হতে পারে না, মূল্য বিচার হবে কি করে? তুল্যমূল্য করা যায় না ওদের।
রসের জিজ্ঞাসায় তরমুজ বড়ো কি তালশাঁস–এহ্নে প্রশ্ন আসাই উচিৎ নয়। ফলের বিচারে দুজনেই অনন্য, স্বাদ আর রসে পৃথক হলেও উভয়েরই সমান সাফল্য। কারো সঙ্গে কারো তুলনাই হয় না। ওই তরমুজ আর তালশাঁস–দুই-ই সমান তর করে দেয়–দুটোই মজাদার–তারিয়ে তারিয়ে খাবার।
কারো কাছে ওই আনারসই ষোলো আনা, এবং নিচুর স্থানই সবার উচোঁয়। যার কাছে যেমন লাগে।
এঁদের দুজনার মধ্যে কোঞ্জন লেখক হিসেবে বড়, বলুন তাই। শুধান সবাই।
আমার বিবেচনায় কে বড়ো জানতে চাইছেন? অচিন্ত্য আর শৈলজার মধ্যে?…এঁদের দুজনের মধ্যে, আমার ধারণায় প্রেমেনই বড়।
শুনেই পবিত্রবাবু খাপ্পা-এদের মধ্যে প্রেমেন বড়? প্রেমেনের কোনো কথাই হচ্ছে না এখেনে। প্রেমেন এর ভেতর আসছে কোত্থেকে?
কোত্থেকে আসছে কে জানে! আমার জবাব–কিন্তু বলতে গেলে প্রেমেনকেই এদের মধ্যে বড় বলতে হয়।
প্রেমেন বড়ো? সঙ্গে সঙ্গে পবিত্রবাবু আস্তিন গুটিয়ে খাড়া। এই মারেন কি সেই মারেন।
এবার আমি সতর্ক। পবিত্রবাবু বঙ্গদেশীয় কাঠগোঁয়ার আর শৈলজা দারুণ গোঁড়া।
আর, কাঠগোঁয়ার বললে কমিয়েই বলা হয় তাঁকে। শালকাঠ গোঁয়ার বললেই সঠিক হয়। আস্তিন গুটোতেই তাঁর শালপ্রাংশু মহাভুজঃ প্রকাশ হয়ে পড়ল। নাগালের মধ্যে পেলে আমার গালের দফা সারা, বুঝতে আমার দেরি হোলো না।